হরু আসবে কি আসবে না কে জানে! গত তিন দিন ধরে রাতে খাওয়ার সময় আসছে। আজও হয়ত সবে টু এখনাে ফেরে নি তবে সে অবশ্যই ফিরবে তার যাবার জায়গা নেই এন যখন হরর মত কোথাও জায়গা হবে তখন সেও আসা বন্ধ করে।
চালালুদ্দিন রান্নাঘরে এসে উপস্থিত হয়েছেন। আজ তাঁর চোখের যন্ত্রণাটা একটু কম। আগের কবিরাজী ওষুধ বাদ দিয়ে পদ্মমধু দিচ্ছেন—এতে সম্ভবত কাজ হচ্ছে। তবে চোখ আটা আঠা হয়ে থাকে—এই যা কষ্ট।
জালালুদ্দিন নিচু গলায় বললেন—এক ফোঁটা চা হবে? মিনু ঠাণ্ডা গলায় বললেন—না।।
চুল বন্ধ? ই: বৃষ্টি-বাদলায় গলাটা খুসখুস করে। কর একটু চা। আদা-চা।
জালালুদ্দিন খানিকটা দূরত্ব রেখে স্ত্রীর কাছে বসলেন। আজ তাঁর চোখের যন্ত্রণা কম থাকায় মনটা বেশ ভাল। মিনুর সঙ্গে গল্পসল্প করতে ইচ্ছ করছে। প্রথম যৌবনে তাদের যখন নতুন সংসার হল—সােহাগী স্টেশনের কাছে বাসা নিয়েছিলেন। রান্নাঘর অনেক দূরে। মিনু একা রান্না করতে ভয় পেত। তখন কতই বা তার বয়স? তের কিংবা চৌদ্দ।
জনম জনম-পর্ব-(৩)-হুমায়ূন আহমেদ
নিতান্তই বাচ্চা মেয়ে! তাকে রাতের বেলা রান্নার সময় সারাক্ষণ স্ত্রীর পাশে বসে থাকতে হত। রান্না হবার পর খাওয়া-দাওয়া শেষ করে একবারে শােবার ঘরে আসা। কত মধুর স্মৃতি। কত বর্ষার রাত রান্নাঘরে পাশাপাশি বসে কেটেছে। অর্থহীন কত গল্প হাসি তামাশা মান-অভিমান। আজকের এই কঠিন মিনু সেদিন কোথায় ছিল? | জালালুদ্দিন ছোট্ট একটা নিঃশ্বস গােপন করে বললেন—চোখের যন্ত্রণা একেবারেই নেই এই যে আগুনের দিকে তাকিয়ে আছি—চোখ কিন্তু কড়মড় করছে না।
না করলে তাে ভাই। ও দেখি একটু ‘আগুন সিগারেট খাই একটা ই একটা পাকেট দিয়ে গেল।
মিনু দেয়াশলাই এগিয়ে দিলেন। জালালুদ্দিন সিগারেট ধরিয়ে তুষ্টচিত্তে টানতে লাগলেন। নরম গলায় বললেন, পদ্মমধু আসলে খুব ভাল মেডিসিন। তবে খাটি জিনিস হতে হবে। দুনিয়া ভর্তি ভোল। পাবে কোথায় খাটি জিনিস?
মিনু জবাব দিলেন না। ভাল চড়িয়েছিলেন, ডালের হাঁড়ি নামিয়ে এলুমিনিয়ামের একটা মগ চুলায় বসিয়ে দিলেন। চা হচ্ছে। জালালুদ্দিনের চোখ চকচক করছে। তিনি স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে খুশি খুশি গলায় বললেন- চোখ সত্যি সেরে গেলে প্রাইভেট টিউশ্যানি ধরব। দু’তিনটা ছেলেকে পড়ালেই হাজার বার’শ টাকা চলে আসবে। ঢাকা শহরে প্রাইভেট টিউটরে খুবই অভাব। নাই বললেই হয়। তুমি কি বল ?
জনম জনম-পর্ব-(৩)-হুমায়ূন আহমেদ
মিনু কিছু বললেন না, বিচিত্র একটা ভঙ্গি করলেন। জালালুদ্দিন চোখের অসুখের কারণে সেই ভঙ্গি দেখতে পেলেন না। দেখতে পেলে তার খুব মন খারাপ হত। তিনি বললেন, সংসারটা তখন ঠিকঠাক করা যাবে। তারপর ইরু একটা দোকান নেয়ার কথা বলছে, যদি সত্য সত্য দে– টাকা আসবে পানির মত।
ও দোকান দিচ্ছে? ও বলল তে কালই এল ‘ নােকানের টাকা পাচ্ছে কোথায়?
হীরু সিগারেট ধরাল। সিগারেটের আলােয় দেখা গেল সে দাড়ি কেটে ফেলেছে। ৫ শে খো হে লিল, ওই : কাজ শিখ?
ইরু অবাক হয়ে বলল, আমি মটর মেকানিকের কাজ শিখব? ইয়ার্কি করছিস? চোর-ছ্যাচড়ের কাজ শিখব আমি? অন্য কেউ এ কথা বললে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতাম। নেহায়েত তুই বলে এমনিউজ করে দিলাম।
হীরু কেরােসিন নিয়ে এসেছে। আশেপাশে খানিকটা খুজেও এসেছে। টুকু নেই। এই নিয়ে তার মধ্যে বিন্দুমাত্র উদ্বেগ দেখা গেল না। ভাত খাবার সময় অত্যন্ত সহজভাবে বলল, দুই-এক রাত বাইরে না কাটালে ছেলেপুলে শক্ত হয় না। থাকুক বাইরে। হার্ড লাইফ সম্পর্কে ধারণা হােক! মেয়ে হলে ভয়ের কথা ছিল। মেয়ে তাে না। | মিনু একটি কথাও বললেন না। যথানিয়মে খাওয়া-দাওয়া করলেন। বাসন কোসন ধুয়ে রান্নাঘরে শিকল উঠিয়ে দিলেন।
জনম জনম-পর্ব-(৩)-হুমায়ূন আহমেদ
রান্নাঘরের কাজ রাতের মত শেষ হল। আবার ভােরবেলায় খােলা হবে। গত রাতে বন্ধ হবে। এই ছােট্ট ঘরটার পেছনে ঊীবন কেটে যাবে তিখির জ্বর বেশ বেড়েছে। রাতে সে কিছুই খায় নি। মিনু দুটি আটার রুটি বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সে বিরক্ত হয়ে বলেছে—রুটি বানাতে তােমাকে বলেছেটা কে?
না খেয়ে থাকবি?
হ্যা, না খেয়ে থাকব। তুমি ও-ঘুমাও। ও আমার সঙ্গে এরকম করে কথা বলছিস কেন?
ভাল করে কথা বলা ভুলে গেছি এখন আমি শুধু বাইরের মানুষের সঙ্গে ভাল। করে কথা বলতে পারি খুব মিষ্টি করে বলি।
মিনু ঘর ছেড়ে বারান্দায় এলেন। উঠোনের পানি বেড়ে বারান্দা দুয়েছে। এবারাে কি আগের বছরের মত ঘরে পানি উঠবে? এবারাে হত ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে হবে। কিন্তু যাবেনই বা কোথায়?
মিনু সারারাত বারান্দায় বসে কাটালেন টুকুর জন্যে অপেক্ষা? হয়ত বা তাই। তবে টুকু বাড়ি না-ফেরায় তাঁকে খুব কার মনে হল না। তিনি ছেলে প্রসঙ্গে তেমন কোন দুশ্চিন্তাও করলেন না। শুধু বসেই রইলেন। শেষ রাতে মেঘ কেটে আকাশে চাঁদ উঠল। সুন্দর জ্যোৎস্না। একা একা জ্যোত্মা দেখতে তার ভালই লাগল।
অথচ হীরু যখন প্রথম কাউকে কিছু না বলে বাইরে রাত কাটাল কি অসম্ভব দুশ্চিন্তাই না তিনি করেছিলেন। ঘরের একটি মানুষও ঘুমায় নি। এখন সময় পাল্টে গেছে। টুর বাড়ি না-ফেরায় কারাে কিছু যাচ্ছে আসছে না। নিতান্তই যেন স্বাভাবিক ব্যাপার! যেন সবাই ধরে নিয়েছে এরকম হবেই: আগামীকাল ভােরে যথাস? সবার দুম ভাঙবে। দিনের কাজকর্ম শুরু হবে। আবার রাত আসবে। এর মধ্যে টুকু ফিরে এলে ভালই, ফিরে না এলেও কিছু আসে যায় না। কে জানে হাত বা ভালই হয়। তখন হাঁড়িতে চাল কিছু কম দিলেও চলবে।
জনম জনম-পর্ব-(৩)-হুমায়ূন আহমেদ
যখন আকাশ ফরসা হল ঠিক তখন মিনু বারান্দা ছেড়ে উঠলেন। অনেক দিন পর ফজরের নামাজ পড়লেন। এ বাড়ি থেকে ধর্মও উঠে গেছে। ধর্ম সুখী মানুনের
জন্যে, যাদের ইহজগতের কামনার পরও পরবর্তী জগতের জন্যে কামনা থাকে তার এখন কোন কামনা-বাসনা নেই। শুধ বেচে থাকা। তিনি রান্নাঘরে ঢুকলেন। চুলা ধরাতে খুব বেগ পেতে হল। শুকনাে কাঠ নেই। এবারের বর্ষা তাঁকে খুব কষ্ট দেবে।
তিথির ঘুম ভেঙেছে। মুখ না ধুয়েই সে এসেছে রান্নাঘরে। সে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, টুর বাড়ি ফিরে নি?
হীরু চলে যাবার পরও তিনি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। কাঁচা রাস্তা পানিতে দেবে গেছে। বাগরে রওনা হয়েছেন খালি পায়ে। থকথকে নােংব্রা কানায় পা ফেলে যেতে হচ্ছে। এককালে ৩া শুচিবায়ুর মত ছিল। নােংরা দেখলেই গা ঘিনঘিন কও।
যে শাড়ি পরে রাতে ঘুমুতেন ভােরবেলা উঠেই সেটা খুলে ফেলতেন। কোথায় গেছে। শুচিবায়। এখন নােংরা আবর্জনা পাশে নিয়েও হয়ত ঘুমুতে পারবেন।
তিথি বেরুচ্ছিল। জালালুদ্দিন বললেন, তুই বাইরে যাচ্ছিস? অর্থহীন কথা। জবাব দেয়ার কোন প্রয়ােজন নেই। তবু তিথি বলল-ই।
ও আমার চোখটা বেশ ভালই লাগছে। রােদের দিকে তাকাতে পারছি। পদ্মমধু জিনিসটা অসাধারণ।
তিথি কিছু বলল না। জালালুদ্দিন বললেন—একটু দেখ তাে মা-হীরু মনে হয় সিগারেটের প্যাকেট ফেলে গেছে। প্যাকেটটা দিয়ে যা। সিগারেট জিনিসটা খারাপ হলেও মাঝে মাঝে মেডিসিনের মত কাজ করে। সব খারাপ জিনিসের একটা ভাল দিক আছে। ইংরেজীতে একটা কথা আছে না—এভরি ক্লাউড হ্যাজ এ সিলভার লাইনিং।
জনম জনম-পর্ব-(৩)-হুমায়ূন আহমেদ
হীরু সত্যি সত্যি প্যাকেট ফেলে গেছে। বেশ দামী সিগারেট—বেনসন অ্যাও হেজেস। চারটা সিগারেট আছে। জালালুদ্দিন একটা ধরালেন। তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তিথি শীতল গলায় বলল, টুকু যে বাড়ি ফিরে নি তুমি জান?
জানব না কেন, জানি। ও চিন্তা লাগছে না তােমার? ও চিন্তা তাে লাগছেই। চিন্তা লাগবে না কেন? খুবই চিন্তা লাগছে। দেখে ন্তুি মনে হচ্ছে না মনে হচ্—সুখেই আহ।
ও চিন্তা কত্রে হবেটা কি? হার বেলায় তাে কম চিন্তা করি নি। তাতে লাভটা কি হয়েছে?
ও তা ঠিক! কোন লাভ হয় নি।
ও মাঝে মাঝে তাের বেলায়ও তাে এরকম হয়। রাতে বাড়ি ফিরিস না , তাের বেলাতেই যদি…
জালালুদ্দিন কথা শেষ করলেন না। তাঁর সিগারেট নিতে গিয়েছিল। তিনি সিগারেট ধরাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। তিথি বলল, আমি যাচ্ছি বাবা। ভয় নেই। রাতে ফিরে আসব’ তোমাকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। তিনি তার জবাব দিলেন না। সিগারেটটা ধরছে না। এত দামী সিগারেট অথচ বর্ষায় কোন ড্যাম্প মেরে গেছে। চুলার পাশে রেখে দিলে হত। সিগারেটের সঙ্গে এক কাপ চা খেতে ইচ্ছে করছে। তিথিকে বললে লাভ হবে না। সে এখন আর রান্নাঘরে ঢুকবে না। মিনু কখন ফিরবে কে জানে। বাজারে গেলে ফিরতে দেরি করে।