জল নয়, যেন অমৃত-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

জল নয় যেন অমৃত-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কয়েক হাত মাটি খোঁড়ার পরই শাবলে ঠংঠং করে শব্দ হতে লাগল। শক্ত পাথর। এখানে জল উঠবে না। মিস্তিরিরা হতাশ হয়ে বসে পড়ল।

এই নিয়ে চারবার।

টিউবওয়েল বসাবার চেষ্টা হচ্ছে, বড়-বড় পাইপ কেনা হয়ে গেছে, টাকাপয়সারও অভাব নেই, কিন্তু জল পাওয়া যাচ্ছে না। এই বৈশাখ মাসে জলের জন্য চতুর্দিকে হাহাকার।

একটা পাকুড় গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছে বড়কা মাহাতো। গ্রামের মানুষদের চেয়ে তার চেহারাটা অন্যরকম। জিনসের প্যান্ট আর টি-শার্ট পরা, মাথার বাবরি চুল ঠিকঠাক আঁচড়ানো, দাড়ি কামানো চকচকে মুখ।

বড়কা এই ভীমাগড় গ্রামেরই ছেলে, কিন্তু অনেকদিন সে এখানে ছিল না।

যখন তার চোদ্দো বছর বয়েস, তখন সে একা-একা বদরপুরের হাটে গিয়েছিল, তারপর আর ফেরেনি।

কেউ-কেউ বলেছিল, তাকে ছেলেধরারা চুরি করে নিয়ে গেছে, কেউ বা বলেছিল, খরগাঁও-এর গুণিন তাকে মন্ত্রবলে ভেড়া বানিয়ে ফেলেছে। মোট কথা এক বছর, দু-বছর, দশ বছর, এক কুড়ি বছরের মধ্যেও বড়কাকে কেউ আশেপাশের কোথাও দেখেনি।

এক মাস আগে ফিরে এসেছে সে হঠাৎ, গায়ে তার শহুরে বাবুদের মতন জামা আর পায়ে বুট জুতো। সঙ্গে আবার মোজা।

বড়কার বাবা এর মধ্যে মরে গেছে। তার এক বড় ভাই আর দুটো বোন ছিল। এক বোনের বিয়ে হয়ে চেলে গেছে অন্য গ্রামে, অন্য বোনটার বিয়ে হয়নি, কারণ তার গায়ে শ্বেতি আছে। বড় ভাইটার একটা পা ট্রেনে কাটা গেছে। তাই সে মাঠে কাজ করতে পারে না। বাড়িতে বসে বিড়ি বাঁধে।

আর বড়কার মা এখন অন্ধ। ছেলে এতদিন পরে ফিরে এসেছে বলে সে বুড়ির কী আনন্দ! কিন্তু ছেলেকে সে দেখতে পায় না। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝার চেষ্টা করে। কিন্তু চোদ্দো বছরের যে ছেলেকে সে দেখেছিল, তার বয়েস এখন চৌতিরিশ বছর। তার গায়ে হাত বুলিয়ে কি ছেলেকে চেনা যায়? তবু সে আনন্দে খলখলিয়ে হাসে।

তুই এতদিন কোথায় ছিলি রে বড়কা?

অনেকেই জিগ্যেস করে একথা। বড়কা সঠিক উত্তর না দিয়ে বলে, চলে গিয়েছিলাম সমুদ্দুর পেরিয়ে এক মরুভূমির দেশে।

এ গ্রামের কোনও লোক সমুদ্র দেখেনি। মরুভূমি কাকে বলে তাও জানে না।

বড়কা এখন মাঝে-মাঝে ইংরেজি বলে ফেলে। তার পকেটভরতি অনেক টাকা। সে তো বাবু। সেজে শহরেই থেকে যেতে পারত। কিন্তু সে ফিরে এসেছে গ্রামে, তার মাকে দেখবার জন্য।

এতদিন পরে কেন?

তার উত্তর সে দেয় না। কতদিন থাকবে, তাও ভালো করে বলে না।

তাদের মাটির বাড়ি, খোলার চাল, তাও ভেঙে পড়েছে প্রায়। বড়কা মিস্তিরি ডেকে সে বাড়ি সারিয়ে ফেলল খুব তাড়াতাড়ি।

কোনও হারানো মানুষ ফিরে এলে গ্রামের সব মানুষকে খাওয়াতে হয়। এটাই বহুদিনের নিয়ম।

বড়কা একদিন বিরাট ভোজ দিল। যে যত পারো ভাত আর মুরগি খাও। কয়েক হাঁড়ি মিঠাইও আনানো হল দূরের শহর থেকে। সবাই খুব খুশি। গ্রামের সব ছোট ছেলেমেয়েরা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে বড়কার দিকে। সে যেন এক অজানা দেশের মানুষ।

ছোট বোনটাকে একটা গোরু কিনে দিয়েছে বড়কা। সে বেচারির যদি বিয়ে না হয়, গোরুর দুধ। বিক্রি করে সে নিজের খরচ চালাতে পারবে!

অন্ধ মা একদিন বলেছিল, ও বড়কা, এই গাঁয়ে তুই পানি এনে দিবি? দে না বাবা!

সেই থেকে বড়কার মাথায় ঢুকেছে, গ্রামে একটা-দুটো টিউবওয়েল বসাতে হবে।

গ্রামের সব লোককে সে জানিয়ে দিল, এ গ্রামের দু-দিকে পানিকল বানিয়ে দেবে সে, খরচ যা লাগে চিন্তা নেই। কিন্তু গ্রামের লোকদেরই পরিশ্রম করে গর্ত খুঁড়তে হবে।

পরিশ্রম করতে তো অনেকেই রাজি। কিন্তু মাটির খানিকটা তলাতেই যে শক্ত পাথর। ইচ্ছে করলেই তো সব জায়গায় টিউবওয়েল বসানো যায় না!

খুব কাছেই পরপর দুটো পাহাড়। তার একটা পাহাড়ের ওপাশে আছে একটা বড় পুকুর। জল আনতে হয় সেখান থেকে। কিন্তু পাহাড় পেরিয়ে গিয়ে জল আনা কি সোজা কথা? কেউই এক কলসি, দু-কলসির বেশি আনতে পারে না।

সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় এই গ্রীষ্মকালে।

একসময় এই গ্রামের পাশে একটা ছোট নদী ছিল। দ্বিতীয় পাহাড়টার গা দিয়ে গড়িয়ে আসত একটা ঝরনা, নীচে নেমে সেই ঝরনাটাই হত নদী। কেন যে সেই ঝরনাটা শুকিয়ে গেল, তা কেউ জানে না।

এখনও সেই নদীর খাতটা আছে, কিন্তু প্রায় সারা বছর শুকনোই থাকে। খুব বর্ষার সময় খানিকটা জল হয়। তাতে পায়ের গোড়ালিও ডোবে না। বর্ষাকাল শেষ হয়ে শরৎকাল আসতে-আসতেই সে জলও পালিয়ে যায়।

চারবার টিউবওয়েল বসাতে ব্যর্থ হয়ে সবাই যখন হতাশ হয়ে পড়েছে, বড়কা মাহাতো তখনও হার মানতে চায় না।

সে বলল, চলো তো, ওই শুকনো নদীটার খাতে গিয়ে গর্ত করি! পানিকল না হোক, কুয়ো তো হতে পারে? কুয়ো হলেও কাজ চলবে!

সবাই মিলে গেল সেই নদীর কাছে। এবার বড়কা নিজেও তার জামাপ্যান্ট খুলে ফেলল। শুধু একটা জাঙিয়া আর গেঞ্জি পরে সে-ও নেমে পড়ল শাবল হাতে।

কালো পাথরের মূর্তির মতন তার শরীর। সে লাফিয়ে-লাফিয়ে প্রচণ্ড জোরে কোপ মারতে লাগল মাটিতে।

দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত ন-দশ জন মিলে খুব পরিশ্রম করল। তবু কোনও লাভ হল না। সাত আট হাত নীচেই নিরেট শক্ত। শাবল মারলে আগুনের ফুলকি বেরিয়ে আসে। জলের দেখা নেই।

তাহলে এ গ্রামের মানুষ কি চিরকাল জলকষ্টেই থাকবে?

তখন একজন বুড়ো লোক বলল, ওরে একবার দুর্জয় সিংকে পুছে দ্যাখ না। সে পাকা কথা বুলে দিবে।

অন্য একজন বলল, দুর্জয় সিং কি এখনও বেঁচে আছে? সে নাকি মাটির তলায় সেঁধিয়ে গেছে কবে।

আর-একজন বলল, না, আমি তাকে এক হপ্তা আগে হাটে দেখেছি। সে সবসময় গাঁজা টেনে বুদ হয়ে থাকে।

দুজ্জয় সিং-এর বাড়ি বুড়োশিবতলা মন্দিরের পাশে। তার সংসারে আর কেউ নেই। সে থাকে একা।

বড়কা কখনও দুর্জয় সিংকে দেখেনি। তবে ছোটবেলায় সে শুনেছিল, এই মানুষটা নাকি জলের গন্ধ পায়। বক্রেশ্বরে যেখানে গরম জলের ঝরনা আছে, সেখানে গিয়ে দুর্জয় মাঝি নাকি আরও তিনটে ঝরনা আবিষ্কার করেছিল। আরও অনেক গল্প আছে। হিরণমারি গ্রামে যখন একটা বড় কুয়ো খোঁড়া হয়, তখনও এইরকম হয়েছিল। কোথাও জল উঠছিল না। দুর্জয় সিংকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হল সেখানে। সে নাকি এক জায়গায় মাটিতে পা ঠুকতেই সেখানে তীব্র বেগে জল উঠে এসেছিল। এইরকম আরও কত গল্প।

বড়কা বলল, ঠিক আছে, দেখা যাক, দুর্জয় সিং কিছু করতে পারে কি না!

পাহাড়ের নীচে যে জঙ্গল, সেখানে বুড়োশিবতলার মন্দির। এ মন্দিরে এখন আর পুজো হয় না। একটা শ্মশান আছে, সেখানেও এখন আর কেউ আসে না।

একটা খাঁটিয়ায় শুয়ে আছে দুর্জয় সিং, খুবই বুড়ো হয়ে গেছে, বেরিয়ে গেছে বুকের হাড় পাঁজরা। সে কী খায়, কে তাকে খেতে দেয়, কে জানে!

বড়কাদের দলবল দেখে সে উঠে বসল।

তাদের প্রস্তাব শুনে সে মিটিমিটি হাসতে-হাসতে দু-হাত নেড়ে বলতে লাগল, আর তো হবেনি! আমার কোটা শেষ হয়ে গিয়েছে। এক সাধুবাবা আমারে এই বিদ্যে শিখিয়েছিল। সেই সাধুবাবা বারবার বলে দিয়েছে, ওরে পাগলা, এই বিদ্যে পাঁচবারের বেশি ব্যবহার করবি না। কারোর কাছ থেকে পয়সা নিবি না। সাবধান, পাঁচবারের বেশি লোভ করবি না!

বড়কা দেশ-বিদেশ ঘুরেছে, সে এসব কথা বিশ্বাস করে না।

সে বললে, তোমার পাঁচবারের কোটা শেষ হয়ে গেছে। তার বেশি হলে কী ক্ষতি হবে? এ তো মানুষের উপকারের জন্য!

দুজ্জয় সিং বলল, ওরে বাচ্চা, মাটি হচ্ছে আমাদের মা জননী। তার বুকে বারবার কোপ মারলে কি তার কষ্ট হয় না? আমি সেই পাপ আর করতে পারবনি!

বড়কা বলল, দাদু, মাটি আমাদের মা। মায়ের সন্তানরা যদি জলের অভাবে ছটফট করে মরে, চাষের ক্ষতি হয়, তাতে মাটি-মায়ের কষ্ট হয় না? মা যে তার জল বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে।

দুজ্জয় বলল, ওসব আমি বুঝি না। তোরা কি আমায় মারতে চাস?

বড়কা বললে, তুমি মরবে কেন? আমরা রয়েছি না? আমরা সবাই তোমাকে পাহারা দেব।

সঙ্গের অন্যরাও বলল, আমরা আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবই!

দুজ্জয় সিং মাথা নেড়ে বলতে লাগল, পারবি না, পারবি না! আমার গুরুজি বলেছেন, মাটি-মা আমাকে ভেতরে টেনে নেবে! বড়কার আসলে খুব দেখার ইচ্ছে, দুর্জয় সিং-এর সত্যিই এরকম ক্ষমতা আছে কি না! কারোর যদি এরকম সত্যি ক্ষমতা থাকে, তাহলে সে পাঁচবারের বেশি ছবার সেটা ব্যবহার করলে মরে যাবে কেন? মাটি কি কোনও মানুষকে টেনে নিতে পারে? সেটাও দেখতে হবে!

সে প্রায় জোর করেই দুর্জয় সিংকে তুলে নিয়ে গেল।

গ্রামে এনে আগে খাওয়ানো হল ভালো করে। সাতখানা রুটি, অনেকখানি ঢ্যাঁড়শের তরকারি আর আস্ত একটা ঝলসানো মুরগি!

তারপর এক ছিলিম গাঁজা টেনে বলল, ওরে, বুড়ো হয়েছি বটে, কিন্তু তবু এখনও মরতে ইচ্ছে করে না। তোরা আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবি তো?

বড়কা জোর দিয়ে বলল, আমি সবসময় থাকব তোমার পাশে।

দুজ্জয় সিং বলল, তাহলে আমাকে এক বাটি জল এনে দে!

এল এক বাটি জল।

দুজ্জয় সিং কিছুক্ষণ সেই বাটির জলের দিকে তাকিয়ে কী যেন বিড়বিড় করে। তারপর হাঁটতে শুরু করে।

বেশ কয়েক পা হেঁটে গিয়ে সে এক জায়গায় হঠাৎ থেমে গিয়ে একেবারে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। তারপর মাটির গন্ধ শুকতে থাকে কিছুক্ষণ ধরে।

বড়কা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। মাটির অনেক নীচে থাকে জল, ওপর থেকে সেই জলের গন্ধ পাওয়া কি সম্ভব? সবটাই গাঁজাখুরি ব্যাপার নয় তো?

এইরকমভাবে, মাটিতে দণ্ডি কেটে এগোবার পর, সাত বারের পর, এক জায়গায় দুর্জয় সিং উঠে দাঁড়িয়ে বলল, মিল গিয়া! এখানে খোঁড়ো, পানি পাবে!

বড়কা কিছু বলার আগেই অন্য লোকরা মহা উৎসাহে সেই জায়গাটা খোঁড়া শুরু করল।

আশ্চর্য ব্যাপার, অনেকটা খুঁড়েও এবার কোনও পাথরে ঠংঠং শব্দ হল না। নরম মাটি।

এবারে বসানো হতে লাগল টিউবওয়েলের পাইপ।

পাইপগুলো বেশ সহজেই ঢুকে যেতে লাগল। পরপর দশখানা পাইপ। এরপর অবশ্যই জল পাওয়ার কথা।

বড়কা এইটুকু জানে যে মাটির তলায় বিভিন্ন স্তর ঠিক সমতল নয়। ঢেউ খেলানো। তলায়। যেখানে ঢেউটা বেশ গভীর, সেখানে জল জমে থাকতে পারে। ওপরের দিকটা থাকে শক্ত পাথর।

সেরকম একটা ঢেউ-এর জায়গাই দুজ্জয় সিং খুঁজে বার করেছে। কিন্তু ওপর থেকে গন্ধ শুকে বোধহয় এরকম বিশেষ ক্ষমতা থাকে। এর মধ্যে ম্যাজিক কিছু নেই!

অতগুলি পাইপ বসিয়ে ওপরে লাগানো হল টিউবওয়েল যন্ত্রটি। এবার ওপর থেকে বেশ কিছুক্ষণ জল ঢেলে-ঢেলে পাম্প করতে থাকলে একসময় তলা থেকে জল উঠে আসতে শুরু করে।

সেরকম চেষ্টা চলল পুরো একবেলা ধরে। কিন্তু জল উঠল না।

এ কী অদ্ভুত ব্যাপার!

যারা অন্য গ্রামে টিউবওয়েল বসানো দেখেছে, তারাও হতবাক।

এতগুলো পাইপ ভেতরে ঢুকে গেল, ওপর থেকে এত জল ঢালা হচ্ছে। তাও বসে যাচ্ছে নীচে, তাহলে জল উঠছেনা কেন? এ কী অদ্ভুত ব্যাপার।

হাতের বাটির জলটা এক চুমুক খেয়ে নিয়ে দুর্জয় সিং বললে, এ আমার পাপ। মাটি-মায়ের গায়ে চোট লেগেছে। এবার দেখবি, এক জায়গায় মাটি ফাঁক হয়ে যাবে, আর ধরিত্রী আমাকে পাতালে টেনে নেবে!

বড়কা বলল, দাদু, আমি আপনার পাশে থাকব সবসময়। দেখি, কে আপনাকে টেনে নেয়।

সেই শুকনো টিউবওয়েলের পাশে টাঙানো হল একটা তাঁবু। সেখানে সবসময় শুয়ে থাকে দুজ্জয় সিং, আর তার পাশে জেগে বসে থাকে বড়কা মাহাতো!

আর জল ঢেলে-ঢেলে সেই টিউবওয়েল থেকে জল বার করার চেষ্টা চালাতেই লাগল।

এর মধ্যে কে যেন বলল, এবছর ইন্দ্র দেবতার পুজো হয়নি, তাই বৃষ্টিও আসছে দেরিতে। ইন্দ্রদেবতাকে খুশি করতে পারলে বৃষ্টিও নামবে তাড়াতাড়ি। তখন টিউবওয়েল থেকে জলও উঠবে।

ইন্দ্রদেবতা নাকি নাচ-গান ভালোবাসে।

তাই গ্রামের সব মেয়েরা নাচ-গান শুরু করল সেই তাঁবুর পাশে। তবু আকাশের কোনও দিকে মেঘের দেখা নেই।

দুজ্জয় সিং এখন আর কিছু খেতেও চায় না। শুধু গাঁজা টানে।

আর বারবার আপন মনে বলে, ধরিত্রী ফাঁক হয়ে যাবে, আমাকে ভেতরে টেনে নিয়ে যাবে! কেন যে আমি লোভ করলাম রে!

বড়কা বলে, দাদু, যদি ধরিত্রী ফাঁক হয়, আমিও যাব আপনার সঙ্গে। পাতাল দেখে আসব!

এরকমভাবে কেটে গেল চার-পাঁচ দিন।

অন্যান্য গ্রাম থেকেও দলে-দলে মানুষ আসে এই তাঁবু দেখতে। টিউকলে জল আসবে, না মাটি দু-ফাঁক হয়ে দুর্জয় সিংকে টেনে নেবে? কিছুই হয় না। টিউকলেও জল আসে না!

হঠাৎ একটা জিপ গাড়ি এসে থামল সেই গ্রামে। তার থেকে নামল ছ-সাতজন যুবক, তাদের তিনজনের সঙ্গে বন্দুক। তারা বড়কাকে খুঁজতে এসেছে।

তারা কিন্তু মারামারি করতে আসেনি। তারা বড়কাকে খুঁজতে এসেছে।

বড়কার সঙ্গে তাদের কী কথা হল কেউ জানে না।

একসময় বড়কা উঠে গেল সেই জিপ গাড়িতে। তার মাকেও কিছু বলে গেল না।

গ্রামের লোক ধরেই নিল, বড়কাকে আর কোনওদিন দেখা যাবে না। এরকম তো প্রায়ই হয়। জল পাওয়া তাদের ভাগ্যে নেই। এতকাল ধরে তাদের ভাগ্যে যে কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে, তাই ই চলবে এটাই তাদের নিয়তি।

কিন্তু দুর্জয় সিং-এর কী হবে?

সে যে দিন-দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। টিউবওয়েলেটাও শুকনো।

বড়কা চলে যাওয়ার পরের দিন বিকেলবেলা ঝড় উঠল।

প্রথমে ফিনফিনে হাওয়া। তারপর শোঁ-শোঁ শব্দ। তারপর যেন শুরু হল প্রলয়। আকাশেও প্রবল বজ্র গর্জন।

দুজ্জয় সিং যেন হঠাৎ চাঙ্গা হয়ে উঠছে।

তাঁবু থেকে বেরিয়ে দুর্জয় সিং নাচতে শুরু করে। বলতে লাগল, এসেছে রে। এসেছে। এবার মাটি ফাটিয়ে আমাকে নিয়ে যাবে। পালা, তোরা পালা!

কিন্তু কে কোথায় পালাবে?

এই পাহাড় আর জঙ্গল ঘেরা গ্রাম ছাড়া কেউ তো আর কোনও জায়গা চেনে না। আর যতই প্রলয়ের ঝড় উঠুক, নিজের বাড়ি-ঘর ছেড়ে কেউ কি যেতে চায়?

বিকেল, সন্ধে, সারারাত ধরে চলল সেই ঝড়।

সকালবেলা দেখা গেল দুর্জয় সিং-এর তাঁবুটা একেবারে উড়ে গেছে। দুর্জয় সিং-ও কোথাও নেই।

কিন্তু মাটি কোথাও দু-ভাগ হয়নি। কোথাও ফাটল নেই। তাহলে দুর্জয় সিং গেল কোথায়? কেউ জানে না। কেউ দেখেনি!

একটু বেলা হতেই এল জিপ গাড়ি। তার থেকে নামল বড়কা মাহাতো।

বড়কা ফিরে এসেছে। কী আশ্চর্য কথা! এই হতভাগা জায়গায় কিছুই পাওয়া যাবে না। জলও পাওয়া যাবে না। বড়কার তো এখন অনেক টাকা। সে তো তার অন্ধ মাকে নিয়ে শহরে থাকলেই পারে!

বড়কা গাড়ি থেকে নেমেই জিগ্যেস করলে, দুর্জয় সিং কোথায়?

লোকে নানারকম গল্প বানাতে ভালোবাসে। কেউ-কেউ বলল, তারা স্বচক্ষে দেখেছে দুর্জয় সিং ঝড়ের তোড়ে আকাশে উড়ে যাচ্ছে!

বড়কা তাদের ধমক দিয়ে বলল, দূর! মানুষ কখনও আকাশে উড়তে পারে নাকি? যতই ঝড় হোক।

কিন্তু দুর্জয় সিং গেল কোথায়?

ধরিত্রী তো তাকে টেনে নেননি। ভূমিকম্পও হয়নি। কিন্তু বুড়োটা, দুর্বল দুর্জয় সিং কোথাও নেই। একথাও ঠিক!

বড়কা তখন একদল সঙ্গীকে নিয়ে দুর্জয় সিংকে খুঁজতে বেরোল! তবে কি সে ফিরে গেছে বুড়োশিবতলায়? এত ঝড়ের মধ্যে সে একা-একা যাবেই বা কী করে?

বড়কারা কিছু দূর এগিয়েছে, এমন সময় শোনা গেল পেছন দিকে একটা দারুণ কোলাহল।

শব্দটা আসছে টিউবওয়েলের তাঁবুটার কাছ থেকে। সেটা ভয়ের, না আনন্দের ঠিক বোঝা গেল না!

প্রথমেই মনে হয়, ওখানে কোনও বিপদ ঘটল নাকি? গত বছর ওই জায়গায় একটা পাইথন সাপ বেরিয়েছিল।

বড়কার সঙ্গীরা পেছন ফিরে দৌড় শুরু করেছে।

বড়কাও যোগ দিল তাদের সঙ্গে।

সেখানে পৌঁছে দেখল, না। পাইথন সাপ বেরোয়নি, অন্য কোনও বিপদও হয়নি। সবাই আনন্দের ধ্বনি করছে।

সেই শুকনো টিউবওয়েল থেকে বেশ তোড়ে বেরিয়ে আসছে জল। কয়েকজন পাম্প করছে। অন্যরা অঞ্জলি পেতে পান করছে সেই জল, ছিটিয়ে দিচ্ছে চোখে-মুখে। কী ঠান্ডা, কী সুন্দর স্বাদ, জল নয়, যেন অমৃত!

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *