জুতোর সাথে আমার সম্পর্ক যে ভালো হবে না সেটা বড় হবার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে গেছিলাম। অন্তত পুজোর সময় নতুন জামা প্যান্ট পরে যখন নতুন জুতোর ভালোবাসাতে খোঁড়াতে খোঁড়াতে রাস্তাতে হাঁটতাম আর আমার দিকে বাকি সবাই করুণার চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করত, ‘আহা রে নতুন জুতো পরে পা কেটে গেছে, কি কষ্ট না !
’ মাথাটা গরম হয়ে যেত। কিন্তু কিছু করবার নেই।তাদের চোখের সামনেই আমার দুর্গতি চরমে উঠত। পায়ের জুতো কিছু সময়ের মধ্যেই হাতে উঠে যেত। আমি হাতে নিয়ে হেঁটে হেঁটে যেতাম আর বাকি সবার মুখের দিকে তাকিয়ে একা একাই কষ্ট পেতাম।
প্রাইমারি স্কুলে পড়বার সময় জুতোর ভালোবাসাতে আমার পা কেটে যাওয়া একরকমের নিত্যকারের ঘটনা হয়ে গেল।নতুন জুতো কেনার সাথে সাথেই চোখে কান্না আসত, ‘এই রে আবার পা কেটে যাবে!’ পা কেটে যাওয়া মানেই সারাটা পুজো মাটি, একটা চটি পরেই বাকি দিনগুলো কাটাতে হবে, নতুন জামা প্যান্টের সাথে চটি, কি বাজেটাই না লাগে। তা না হলে জুতোর ভেতরে তুলো বা কাপড়ে ওষুধ লাগিয়ে পরতে হবে।
যে ভাবেই পরা হোক খোঁড়াতে হবেই।মাঝে মাঝে মনে হত, ইস কেউ যদি একবার নতুন জুতোজোড়াটা পরে একটু পুরানো করে আমায় দেয় কত ভালো হয়! তবে নতুন জুতো কিনলে আমার আরেকটা বিষয়ে খুব ভয়ও লাগত। কোন কিছু হলে মা রেগে গেলেই এই জুতো জোড়ার একটা জুতোই হয়ে উঠবে মায়ের হাতের অস্ত্র, পুরানো জুতো সে রকম ভাবে হাত দিত না। যদিও পা কেটে গেলেই আমি পরম যত্নে জুতো জোড়া ভালো ভাবে পরিষ্কার করে তুলে রাখতাম।
একবার বাবা কি একটা কম্পানির জুতো কিনে এনেছিল।এক পুজো শেষ হয়ে আরেক পুজোর আগে পর্যন্ত জুতো কিছুতেই ছেঁড়ে না।শেষ কালে এক বন্ধুর পরামর্শ মত পাথরে লাথি মেরে জুতো ছিঁড়তে গিয়ে আরেক বিপত্তি হাজির হল।জুতোর সাথে পায়ে এমন আঘাত লাগল যে সেবারেও পুজোটা চটি পরেই কাটাতে হল।
ছোটবেলায় বৃষ্টির পরে জমা জলে জুতো বা চটি ভাসাতে খুব মজা লাগত। অবশ্য জুতো বেশির ভাগ সময় ডুবে গেলেও চটি মাঝে মাঝেই ভেসে থাকত। ক্লাস ফাইভে পড়বার সময় আরেকটা ঘটনা ঘটল। স্কুলের সামনে একটা বেশ বড় ড্রেন ছিল। একদিন বর্ষার সময় ড্রেনে তখন জল উবছে উঠেছে। কি ইচ্ছে হল জুতো পরেই ড্রেনের মধ্যে পা ডুবিয়ে বসে থাকলাম। কিছু সময় পর যখন পা দুটো তুললাম দেখি এক পায়ে জুতো আছে, আরেক পা ফাঁকা।
জুতো কই, জুতো কই কিছু সময় খুব খুঁজলাম। আমার সাথে আমার বন্ধুগুলো খুঁজতে আরম্ভ করল। কিন্তু জুতোর দেখা নাই। চোখ ফেটে জল পড়তে লাগল। অবস্থা এমন হল যে কোন জল বেশী সেটা নিয়ে রীতিমত গবেষণা করতে হত। বাধ্য হয়ে একপায়ের জুতো হাতে নিয়ে আরেক পায়ের জুতোর সলিল সমাধি দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। সেই পায়ের জুতোটা অনেক দিন পর্যন্ত রাখা ছিল। দেখলেই অন্য আরেক পায়ের জুতোর কথা মনে পড়ত আর মনটা হাউ হাউ করে উঠত।
আরেকবার টিউসন থেকে ফেরার সময় কোথাও একটা ঘুরতে গেছিলাম। একটা ছোট ক্যানেল কাঁধে সাইকেল তুলে ও সাইকেলের হ্যাণ্ডেলে জুতো ঝুলিয়ে পেরোনোর সময় জলে একটা জুতো পড়ে যায়। ক্যানেলে বেশ স্রোত ছিল। জুতোও ভেসে যাচ্ছিল। সেই ভেসে যাওয়া জুতোকে উদ্ধার করবার জন্যে সাইকেল কাঁধে তার পিছন পিছন কিছুটা যেতে হয়েছিল। তবে আনন্দের কথা সে যাত্রায় জুতোটা উদ্ধার করতে পেরেছিলাম।
জুতোতে পা কেটে যাবার পরে জুতো চুরিও আমার জীবনে আরেকটা দুর্ঘটনা। কতবার যে জুতো চুরি হয়েছে তার কোন কূল কিনারা আমার জানা নেই। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবার পর দুজন বন্ধু মিলে আমাদের শহরের শেষ দিকে একটা মন্দির দেখতে গেছিলাম। মন্দিরটাতে ঢুকেই দরজার কাছে জুতো খুলে রাখতে হত। খুলে রাখলাম, কিন্তু মন্দিরের বিগ্রহ ও সন্ধ্যা আরতির পর ফিরে এসে দেখি আমার বন্ধুর চটিটা ঠিক থাকলেও আমার চটি জোড়া হাওয়া।
খুঁজলাম, গেটে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম। কিছুই বলতে পারলেন না। এবারে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ‘ শেষকালে কি খালি পায়ে বাড়ি ফিরতে হবে!’ হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। বাকি চটিগুলো মধ্যে থেকে কোনটা ভালো এবং আমার পায়ে হবে দেখতে লাগলাম। তাও একটা ভয় শরীরের ভেতরটাকে এক্কেবারে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। যার চটি চুরি করে পরে পালাতে যাচ্ছি সেই লোকটিই যদি সেই সময় এসে যান!
আর দেরি করলাম না। চটি জোড়া পায়ে গলিয়েই মন্দির থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ির রাস্তায় পা বাড়ালাম। কিছুটা রাস্তা হেঁটে তারপর বাস চেপে বাড়ি আসতে হত। সারাটা বাস অবাক হয়ে নিজের পায়ের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। এই বুঝি কেউ একজন বলে বসে, ‘এই ছোকরা এটা তো আমার চটি!’
এরপর থেকে অবশ্য আর কোন মন্দিরে চটি খুলে ভেতরে যাই নি। সবাই গেলেও আমি দাঁড়িয়ে থেকে চটি পাহারা দিতাম, না হয় একটা ছোট্ট থলিতে চটি ভরে আরেকটা ব্যাগে ভরে নিতাম।
চটি চুরির আরেক জায়গা হল বিয়ে বাড়ি। একবার এক বন্ধুর বিয়েতে বরযাত্রী গেছিলাম। নতুন পায়জামা পাঞ্জাবির সাথে নতুন একজোড়া চটিও কিনেছিলাম। বন্ধুটিকে বাসর ঘরে ঢোকার আগে বহু কষ্ট করে বুঝিয়ে তার চটি জোড়াটা একটা ভালো জায়গায় লুকিয়েও রাখতে পেরেছিলাম। কিন্তু পরের দিন বউ বেরোনার সময় দেখি আমার নিজের চটি জোড়াটাই নেই।
কি কাণ্ড, জামাই মানে আমার বন্ধুর চটি না পেয়ে আমার চটি নিয়ে হাওয়া! অনেক খোঁজার ব্যবস্থা করলাম, কিছুতেই কিছু হল না। শেষকালে আমি আমার সেই পুরানো পদ্ধতি অনুসারে ঐ বাড়ির আরেকজনের চটি ঝেরে ব্যাগে নিয়ে বসে থাকলাম। গাড়িতে উঠে পরে বাড়ি চলে গেলাম। নিজের বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে আমার জুতোর ভেতর আরশোলা আর ব্যাঙের সাথে সহপথ চলা যে কি কঠিন সেটা আমি ছাড়া আর কেউ কোনদিন না বুঝবে না বুঝেছে।..তবে চটি নিয়ে আমাকে সব থেকে বেশি ভুগিয়েছে কুকুর। একটা ব্যাপার আজও বুঝতে পারিনি আরো চটি থাকলেও আমার চটিটাতেই ওদের যে কি লোভ তা ঠিক বলে বোঝা যেত না।
একবার এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে গেছি। বাইরে চটি খুলে বাড়ির ভেতরে ঢুকেছিলাম। যে চটিটা পরে গেছিলাম সেটাও এক মাস আগে কেনা ছিল। অনুষ্ঠান চলছে এমন সময় একজন এসে বললেন, ‘একটা কুকুর কার চটি মুখে করে নিয়ে গেল।’
প্রথমে ব্যাপারটা সেরকম গুরুত্ব না দিলেও পরে দেখলাম সেই চটিটা আমারই এক পায়ের চটি। কোন এক কুকুর ভালোবেসে মুখে করে নিয়ে চলে গেছে। বাড়ির কর্তা গিন্নি দুজনেই খুবই অপ্রস্তুতে পড়ে গেলেন। গিন্নি তো আমার দিকে লজ্জায় তাকাতে পারছিলেন না। কর্তার উপর কিছুক্ষণ চিল্লিয়ে বলে উঠলেন, ‘ওনার জন্যে একজোড়া চটি কিনে আনো।’ আমি তাড়াতাড়ি বারণ করে বলে উঠলাম, ‘কিনতে হবে না, শুধু আমার হারিয়ে যাওয়া চটিটা খুঁজতে একটু সাহায্য করলেই হবে।’
ওনাদের মুখ দেখে বুঝলাম যতটা সহজে কথাগুলো বললাম ব্যাপারটা ততটা সহজ নয়। ও বাড়িতে তখনও অনুষ্ঠান চলছিল। কিছু সময় পরেই অবশ্য কর্তা আমাকে একজোড়া রাবারের চটি দিয়ে বললেন, ‘চলুন তো আশপাশটা একটু দেখি।’
কোথায় যাবো কেন যাবো প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে যা দেখলাম এক্কেবারে অবাক হবার মত অবস্থা হল। ভদ্রলোক তার আশেপাশের প্রতিবেশীদের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর কেউ বেরোলেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কুকুরটা কি জুতো মুখে করে এনেছে?’
সেই ‘কেউ’ টি মাথা নেড়ে না বলবার সঙ্গে সঙ্গে উনি পাশের ঘরে পৌঁছে গেলেন। আবার সেই এক পদ্ধতি। আমি মুখে কিছু না বললেও বুঝতে পারলাম আমার আগে আরো অনেকের চটি বা জুতো সেই কুকুর বা কুকুরগুলো মুখে করে এদিক ওদিক নিয়ে গেছে। সে যাত্রায় ওনাদের দেওয়া একটা রাবারের চটি পায়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল। তবে ফিরে আসার সময় দেখি সেই বাড়ির দরজার ঠিক বাইরেই একটি কুকুর অম্লান বদনে আমার চটির চচ্চড়ি করছে।
বাইরে বেরিয়ে অনেকের চটি ছিঁড়ে যায়। এটা আরো অনেক বিষয়ের মত আমার কাছে জলভাত। কিন্তু ডেটিংএ গিয়ে যদি কারোর চটি ছিঁড়ে যায় তবে তার যে কি অবস্থা হয় সেটা আমি ছাড়া আর কেউ জানেনা। সেদিন জুতোর সোলটার যে অমন অস্বাস্থ্যকর অবস্থা হয়ে ছিল সেটা তো আগে বুঝতে পারিনি। দিব্যি হাওড়া স্টেশনে মিট করে লঞ্চ চেপে মিলেনিয়াম পার্কে নামলাম।
বাড়ির সবার দেখাশোনা করবার পর জীবনে প্রথম কারোর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। হবু শাশুড়িকে খুব পটিয়ে রাজি করিয়েছি, হবু বৌকেও বলেছি, ‘হাত ছাড়া কোথাও হাত দেবো না।’ সবই ঠিক চলছিল এমন সময় একটা পাথরে লেগে বাঁ’পায়ের জুতোর শোলটা গেল খুলে। ব্যস হয়ে গেল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে আরম্ভ করলাম। যাকে দেখতে পাচ্ছি তাকেই জিজ্ঞেস করছি, ‘কাছাকাছি কোন জুতো সারানোর লোক আছে?’
সবাই মাথা নেড়ে বলতে লাগলেন, ‘এই একটু আগেই আছে।’ এই একটু একটু করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মিলেনিয়াম পার্ক থেকে টি’বোর্ডে অফিসের কাছে পৌঁছে যাবার পরেই হবু উনি, ‘একটু দাঁড়াও’ বলে থামল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম হবু বউ তখন আমার জন্য ফুট থেকে একটা চটি কিনছে।
জীবনের যা ফালুদা হবার ছিল সবই আগে হয়েছিল শুধু এইটুকুই যা বাকি ছিল।
শুনেছিলাম অনেক ধোপা তাদের কাছে জামা কাপড় নিজেদের মত ব্যবহার করে। কিন্তু কোন জুতো সারাই করবার লোক আমার জুতোজোড়া যে পরতে পারে এটা আমার ধারণার বাইরে ছিল। নতুন জুতো, যেদিন পরে অফিস গেলাম সেদিনই হঠাৎ বৃষ্টিতে কাদা লেগে গেল। বাড়ি ফিরেই আবার জুতো জোড়াটা পাড়ার দোকানে দিয়ে এসে বললাম, ‘কালকের মধ্যে একটু পালিশ করে দেবে ভাই, বিয়ে বাড়ি আছে।’
দোকানের ছেলেটি আমার থেকে বয়সে ছোট হলেও চেহারাটি মোটামুটি আমার মতই। ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ জানাল। আমি প্রথমদিন দোকানে গিয়ে দেখলাম ছেলেটি নেই। তার বৌ আমাকে দেখে খুব কাতর ভাবে বলল, ‘ও তো নেই, আপনি কালকে আসুন।’
পরের দিন গিয়ে দেখি দোকান বন্ধ। মাথাটা এমন গরম হয়ে গেল যেন জল ঢাললেই ফুটে যাবে। কোন উপায় না দেখে একটা পুরানো ও একটু ছেঁড়া জুতো পরেই বিয়ে বাড়িতে যেতে হল। ওখানে গিয়ে একটা স্টলে ফুচকা খাবার সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলেকে দেখে কেমন যেন চেনা চেনা লাগল। বেশ ভালো পোশাক। কোথায় দেখেছি মেলাতে পারলাম না। ছেলেটি কিন্তু আমাকে দেখতে পেয়েই কোথায় যেন পালিয়ে গেল। আমি মুখে ফুচকা ভরে মাথার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত চষে ছেলেটিকে মনে করবার চেষ্টা করতে লাগলাম। না পেরে আশাহত হচ্ছিলাম এমন সময় মনে পড়ল, ‘ছেলেটাকে কেমন যেন সেই জুতো সারাইয়ের দোকানের ছেলেটার মত দেখতে।’
কিছু পরে অবশ্য নিজেকেই বোঝালাম, ‘না না, তা কি করে হবে?’
আমি সব ভুলে বিয়ে বাড়ি আনন্দ করবার চেষ্টা করছি এমন সময় একজনের সাথে ধাক্কা লেগে হাতের রুমালটা গেল মাটিতে পড়ে। কুড়োতে গিয়ে চোখ আটকে গেল একজোড়া জুতোতে। আরে এই জোড়া তো আমি চিনি। মুখ তুললাম। না এবার আর ভুল নয়, সেই ছেলেটিই এই ছেলেটি, আর ছেলেটিই দোকানের ছেলে। সব হিসাব গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল এমন সময় চোখের সামনে ছেলেটি আবার গায়েব হয়ে গেল।
এক মন রাগ নিয়ে এক রকম না খেয়েই বাড়ি ফিরে এলাম। পরের দিন ঘুম থেকে উঠেই দরজার সামনে খবরের কাগজ মোড়ানো আমার জুতো জোড়া ফিরে পেয়ে বুঝতে পারছিলাম না আনন্দ করব না অন্য কিছু। তবে ছেলেটি কোন দিন পালিশের টাকা নিতে আসেনি। হয়ত আমাকে আমার জুতো জোড়ার ভাড়া দিয়েছে। এত সব কষ্টের মধ্যেও পাশে বসে থাকা কারোর পায়ে ঠিক আমার জুতোর মত জুতো দেখলে আনন্দ হয়। কতবার এই রকম মানুষদের ওনাদের অজান্তেই জুতোতুতো বন্ধু করে নিয়েছি সেটা আর বললাম না।