টেকো বললে আর রাগি না-ঋভু চট্টোপাধ্যায়

টেকো বললে আর রাগি না-ঋভু চট্টোপাধ্যায়

‘টেকো, এই টেকো..’ আর এই কথাগুলো শুনলে রাগ হয় না। আর কেনই বা রাগবো, সত্যিই তো আমার মাথায় এখন সর্ব সাকুল্যে সাতাশটি চুল।সবগুলোই পিছনের কার্নিশে ঝুলে কোন রকমে বেঁচে থাকবার চেষ্টা করছে। কতদিন বেঁচে থাকতে পারবে এই ব্যাপারে আমার নিজেরই বিস্তর সন্দেহ আছে। কলেজ পাশ করে একবার পাড়ার সেলুনের কাকু চুল কাটার সময় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অম্লান বদনে বলে উঠেছিলেন, ‘খুব বেশি দিন তোমার এই চুল কাটতে হবে না, যা অবস্থা এরা বছর দুই বেঁচে থাকলে হয়।’

চুলের ভেতর একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করেছিলাম। বাড়ি ফিরে দাদু, বাবা এমনকি আমার নিজেরও একটা ছবি দেওয়ালে টাঙিয়ে তুলনা করবার চেষ্টা করেছিলাম। টাকের জন্যেই ঠাকুরদা ও বাবাকে দেখতে প্রায় এক লাগে। এরপর থেকে আমাকেও ওদের মতই লাগবে? হায় ভগবান আমার এত সাধের বান্ধবীরা হেলায় হারিয়ে যাবে? অবশ্য এক বান্ধবী একবার বাড়ি এসে বাবাকে দেখে একটা টোন কেটে বলে উঠেছিল, ‘টাক তোদের বংশগত? কাকুর দেখলাম ইয়া বড়..’ তারপরেই আমার তখনকার মাথা ভর্তি চুলের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে কি সব ভাবার চেষ্টা করেছিল। ওর মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝেছিলাম, ‘এটাই আমার বাড়িতে ওর শেষ আসা।’

অবশ্য ফোনে বহুবার ঠিক কি ভাবে চুল মাথাতে ধরে রাখতে হয় তার একটা লম্বা ফর্দ দিয়েছিল। সেই ফর্দ মত সকালে পেট পরিষ্কার করবার জন্যে গরম জল, কাঁচা হলুদ, রসুন, আদা, লিকার চা খাওয়া, শিশিরে মাথা ভেজানো, বেলার দিকে কালোমরিচ, জবাফুল, নারকেল তেল, অ্যালোভেরা মেখে স্নান কোনটাই বাদ দিইনি। এমনকি একবার তো ওর কথায় ছ’টা ডিম কিনে দুটো ঝেপে নিয়ে ছিলাম। ছাদে উঠে দুটো ডিম পেঁয়াজ দিয়ে না ভেজে খেয়ে মাথায় গোলাটা মেখে টানা দুঘন্টা বসে থাকবার পরিকল্পনা করেছিলাম। কাজের মাসিটার জন্যে সব কিছু এক্কেবারে ভণ্ডুল হয়ে যায়। ও কোথা থেকে আমাকে ডিম গুলতে দেখে ফেলে, আর যাস কোথা। মাকে বলতেই চুপিচুপি এসে মাথায় এক বালতি জল ঢেলে দেয়। শুধু এটাই নয় মাথায় ডিম মাখার জন্যে আমাকে সারাটা শরীরে গোবর মেখে স্নান করতে হয়। তারপর থেকে মাথাটাকে হাঁসমুরগির ডিম পারানোর উপযুক্ত জায়গা করে দিলেও নিজে ভুলেও মাথায় ডিম মাখিনি।

তবে আমি আশা ছাড়িনি। দিনরাত বিভিন্ন ম্যাগাজিন পেপার টিভি রেডিও কোন বিজ্ঞাপণই বাদ দিতাম না। নামি অনামী সাবান শ্যাম্পু আমার হাত থেকে মুক্তি পায় নি। এমন কি লম্বা চুলের কোন মহিলা দেখলেই তার সাথে আলাপ জমিয়ে জিজ্ঞেস করতাম, ‘আচ্ছা আপনার এতো বড় চুলের ঠিক কি রহস্য বলতে পারবেন?’

কেউ কেউ মুচকি হেসে জবাব দিলেও বেশির ভাগই সন্দেহের চোখে দেখত। একবার তো মার খেতে খেতে কোন রকমে বেঁচে গেছিলাম। পরে বুঝেছিলাম বেঁচে গেছি মনে করলেও বাঁচিনি। বাবার এক বন্ধু দূর থেকে ঝারি মারছিলেন সেকথা তো বুঝিনি। সন্ধেবেলা বাবার হাঁকাহাঁকি ও ডাকাডাকিতে বুঝতে পারলাম। কোন রকম নেট প্র্যাকটিস না করে সোজা এক চড় চালিয়ে দিল।বসে গেছিলাম তাই গালে না লাগলেও ছুঁয়ে গেল সেই টাকে।এবার আমিও রেগে গেলাম। ততক্ষণে মা এসে গেছে। বাবা আরো উত্তাল চিল্লিয়ে উঠল, ‘জানো বাইরের মহিলাদের এই ছেলে বিরক্ত করে।’

–না বিরক্ত করিনি, শুধু যে মহিলাদের বড়বড় চুল তাদের ঐ লম্বা চুলের রহস্য জিজ্ঞেস করেছি মাত্র।

বাবা রেগে আরো কিছু বলত, কিন্তু আমার মা একরকম ঢাল হয়ে আমার সে যাত্রার টাল সামলে দিল।

আমি আস্তে আস্তে দো’তলায় আমার ঘরে যাবার সময় মায়ের গলা শুনতে পাচ্ছিলাম।

‘তোমার জন্যেই এখন সংসারে এত অশান্তি। আমার বাড়ির দিকে তাকাও, বাবা দাদু, জ্যাঠা সবার মাথা ভর্তি চুল, কে বলবে ওনাদের বয়স হয়েছে, আর তোমাদের পরিবারে দ্যাখো।কুড়ি বছর পেরোতে না পেরোতেই মাথা এক্কেবারে পরিষ্কার হতে আরম্ভ করে।বাপের বাড়িতে আমার মান সম্মান কিছুই থাকছে না।’

পাড়ার লোকেরা অবশ্য অভ্যস্ত হয়ে গেছে। টাকের জন্যে ঝগড়া এ প্রায় নিত্য দিনের ঘটনা। তারা হাসে মজা নেয়।

আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কোন রকমে সেই সময় বাঁচলেও টাক বাঁচল না। বরং প্রতিদিন একটু একটু করে তার সাম্রাজ্য বাড়িয়েই চলল। ঘুম থেকে উঠে রোজ আয়নার সামনে একটা স্কেল নিয়ে টাকের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ মাপতে বসি।বাইরে বেরোলে মানুষের চোখেমুখেও আমার টাকের ভাষা বুঝতে পারি।তবে একদিন টাকটা বনবন করে ঘুরতে আরম্ভ করেছিল। বাসে চেপেছি, বেশ গরম, শরীর প্রায় ভিজে যাচ্ছে।পাশে দাঁড়ানো এক মাঝবয়সী মহিলা দেখছি আমার টাকের দিকে তাকিয়ে নিজের চুল ঠিক করছেন। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতেই কি রকম অদ্ভুত ভাবে হেসে উঠলেন। কিছু বলতে না পারলেও সারাটা শরীর কিড়মিড় করছিল।

এরমধ্যে কলেজটা পাশ করে গেলাম।এবার একটা চাকরির চেষ্টা করতেই হয়। কিন্তু কিভাবে করব, যে অফিসেই যাই আমার বায়েডেটা দেখবার আগে টাকের দিকে সবাই এমন ভাবে তাকিয়ে থাকেন যেন এই টাকেই বিশ্ব দর্শন হতে পারে।ও বলা হয় নি, তখন থেকেই আমার চুল ঘাড়ের এক পাশে ঝুলছে, এক দুই করে গোনা যায়। সেলুনে আর যেতে হয় না। পাড়ার কাকু হলেও আমার চুলের দিকে তাকিয়ে খিকখিক করে হেসে বলে, ‘তোর বাড়ির নেলকাটারেই এবার থেকে চুল কাটা যাবে।’ এবারেও টাক জ্বলতে আরম্ভ করে, নেলকাটার দিয়ে হেয়ার কাট, জাস্ট  হরিবেল।

এদিকে টাকের চিন্তা অন্যদিকে বাবার চেল্লামেল্লি একরকম স্যাণ্ডউইচ হয়ে যাচ্ছি। আমার সাথে বাবার দেখা সাক্ষাৎ কম হয়। তাও দেখা হলেই বলে, ‘কি রে চাকরির কিছু হল?’ কিছুতেই মুখ ফুটে বলতে পারি না, ‘বংশানুক্রমে এই টাকের উত্তরাধিকার আমার জীবনটাকে এক্কাবারে ভেজা কাক করে দিল।’

দু’একদিন পরে বাবা সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে আমাকে খোঁজ করতে আরম্ভ করে। না পেয়ে মাকে বলে আমার একটা টিউসনের ব্যবস্থা করেছে, যতদিন না চাকরির কিছু হচ্ছে ততদিন যেন মন দিয়ে এটা করি।

গেলাম, এক ছাত্রী ক্লাস সিক্সে পড়ে, আর ছাত্রটি সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। মাইনে খারাপ দেবে না। অন্তত মাসে আমার এই টাকায় মাথায় মাখবার জন্যে একটা দামি তেলের শিশি ঠিক কেনা যাবে। কিন্তু এখানেও কেলো।ছাত্রছাত্রী তাদের বাবা মা, বাড়ির অন্যান্য সবার চোখই আমার টাকের দিকে, যেন আর কারোর টাক দেখেনি আর আমার টাকেই বিশ্বদর্শন হয়। ক্লাস আরম্ভ করলাম।প্রথম দিনেই বুঝতে পারলাম যদি শুধু টাক দেখত তাহলে একটা কথা থাকত এরা দুজনে এই বয়সে আমার টাক নিয়ে নিয়মিত গবেষণা করতে আরম্ভ করল।

পড়াচ্ছি, একদিন ছাত্রী বায়না ধরে, ‘স্যার দিনরাত্রি এবং সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণ বুঝবো।’

বেশ উৎসাহিত হলাম।

পরেক্ষণেই ছাত্রী বলে উঠল, ‘আপনার মাথাটাকে পৃথিবী করব স্যার, খুব ভালো রিফ্লেকশন হবে।’

মুখ বুঝে মেনে নিতে হল।এরপরে প্রায় দিন আমাকে কোন একটা খাতা চেক করতে দিয়ে নিজে আমার টাকে টর্চের আলো ফেলে ঘরের চারদিকে প্রতিবিম্ব তৈরী করতে আরম্ভ করল।সেটা দেখে আর ভাইবোন দুজন মিলে হেসে লুটিয়ে পড়ে। ছাত্রটিকে নিয়ে আমার সমস্যা তো ছিলই, ছাত্রটাও যোগ হল। আমার টাকটা তার কাছে গাড়ি এমনকি এরোপ্লেন চালানোর জায়গা।সব হিসাব গোলমালিয়ে গেল যেদিন ছাত্র চেয়ারে উঠে দাঁড়িয়ে আমার টাকে নিজের মত করে ছবি আঁকতে আরম্ভ করল।

রুমাল ঢাকা দিয়ে টাক ভর্তি মাছ, নৌকা, পাখি ঘর বাড়ি ও মেঘ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।পরের দিন স্নানের সময় ঐ সব ওঠাতে গিয়ে আমার টাকের চামড়াও কিছুটা উঠে গেল।

ছেড়ে দিলাম টিউসনটাকে।এইরকম টাকের ইনসাল্ট নিয়ে আর যাই হোক পড়ানো যায় না। কিন্তু বাড়িতে বেকার বসে থেকেই বা কি করব। সরকারি চাকরির জন্যে দরকারি পড়াশোনা করতে আরম্ভ করলাম। বাবাকে একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তির জন্যে বলেছিলাম, কিন্তু বাবা আমার ভষ্মে আর ঘি ঢালতে রাজি ছিল না। অগত্যা নিজেই নিজের মাস্টার হয়ে দিন রাত এক করে খুব খাটতে লাগলাম।

বিকালে একটু বাজারের দিকে যেতাম। বিভিন্ন দোকানে নতুন কোন তেল বা ওষুধ এসেছে কিনা খোঁজ করতাম। ওদের মুখে হাসি দেখি আর মনে মনে ভাবি, ‘ বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না।’

একবার এক দোকানদার একটা ছোটবোতল হাতে দিয়ে বলে, ‘এটা মাখো, চুল হবেই, টাকা পরে দেবে।’

তাও মাকে পটিয়ে কিছু টাকা ম্যানেজ করে বোতলটা কিনে ফেললাম। সেদিন রাতের দিকে মাথায় মাখতেই সেকি কাণ্ড। মাঝরাত থেকে শুধু বাথরুমে যাচ্ছি আর আসছি। শেষে এমন অবস্থা হল সকাল দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা নামার মুখে বাবাকে কিছু না বলে পাড়ার জটু কম্পাউণ্ডারের কাছে যেতে হল। অনুরোধ করে এক ঘন্টা অন্তর একটা করে ইনজেকশন দিয়ে তবে সে যাত্রায় বাঁচলাম। কথাগুলো কিছুতেই ঐ দোকানি বিশ্বাস করতে চায় না। তারপর থেকে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, ‘যাই হোক মাথায় আর কিচ্ছু মাখবো না।’

ঈশ্বর আর কত কষ্ট দেখবেন, সেই সব ভেবেই মনে হয় একটা সরকারি দপ্তরে একটা কেরানীর কাজ জুটিয়ে দিল। জুটলে কি হবে এখানেও সবার চোখমুখে এমন অবস্থা যেন আমার নামে আরো হ্যাণ্ডসাম কাউকে আশা করছিল। আমাকে পেয়ে তাদের সব আশাতে এক্কেবারে জল পড়ে গেল। কাজ করতে করতে প্রায়ই কলিগরা আমার টাকে মোবাইল ফেলে চারদিকে নতুন নতুন প্রতিবিম্ব ফেলবার পরীক্ষা করে। অপমানের চূড়ান্ত হলাম যেদিন আমার ইমিডিয়েট বস ডেকে বললেন, ‘গাঙ্গুলি বাবু, আপনার চেয়ারটা জানলার ধার থেকে একটু সরিয়ে নেবেন।’

একটু নরম ভাবেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন স্যার আমার তো কোন অসুবিধা হচ্ছে না।’

-জানি, কিন্তু আপনার মাথাতে সূর্যের আলো পড়ে অন্যদের চোখের অসুবিধা হয়ে যাচ্ছে।

একবার এক বাইক চালক আমার টাকের প্রতিবিম্বের চোটে পড়তে পড়তে বেঁচেছিল। আমার উপর সেকি হম্বিতম্বি।

বসের কথায় সেদিনও সারাটা শরীর কেমন যেন কেঁপে উঠল। পরের দিন থেকে মাথায় একটা কালো টুপি পরে আসতে আরম্ভ করলাম। এখানেও অসুবিধা মাথার সাথে সারাটা শরীর ঘামতে আরম্ভ করল। যেন এই স্নান করে এলাম। সেই ঘামে আবার ড্রেনের জলের গন্ধ বেরোয়। আশেপাশের দু’শ আড়াইশো মিটার পর্যন্ত সেই ঘামের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। তখন প্রতিদিন এক বোতল করে পারফিউম বা বডিস্প্রে ঢেলেও লাভ হয় না। কোন রকমে জানলা থেকে চেয়ারটা সরিয়ে সে যাত্রায় বাঁচার চেষ্টা করলাম। বাড়ি থেকে এবার নতুন উপদ্রব আরম্ভ হল। বিয়ের জন্যে চাপাচাপি আরম্ভ করল। কিন্তু কিভাবে বোঝাবো আমার এ’জন্মে বিয়ের কোন যোগই নেই শুধুই বিয়োগ। মেয়েদের চোখ আমার টাকের থেকে আর নিচে নামে না।

সেই সময় বাবার এক বন্ধুর পরামর্শে রবিবার দেখে এক তান্ত্রিকের কাছে গেলাম। এর আগে হাত দেখিয়ে দুটো মাদুলি ও   তিনটে আংটি পরেছি। এই তিনটে আংটিতেই আবার সব পাথর ভেঙে ভেঙে বসানো আছে। মুশকিল হল তাতে মাথার বাকি চুলগুলোও এক্কেবারে ঝরে গেল। এখন মাথা নীল আকাশের মত পরিষ্কার, কোথাও মেঘ নেই। ঐ তান্ত্রিক মহাশয় আমার চুলের কথা শুনে একটু চমকে উঠলেন। অনেক ভেবে চিন্তে একটা উপায় বের করে বললেন, ‘খরচা হবে, বাঘ ও হরিণের লোম ভেড়ার লোম দিয়ে বেঁধে চুলের নামে একটা একটা মৃত্যঞ্জয় যজ্ঞ করতে পারলেই আর আপনাকে দেখতে হবে না। সারা মাথা ভর্তি চুল এমনি এমনিই গজিয়ে যাবে।’

একটু আশা ফিরে পেলাম। ভক্তি ভরে প্রণাম করে  জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি রকম খরচা হবে?’

ভদ্রলোক একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘সে রকম কিছুই না, জিনিসগুলো জোগাড় করতেই যা খরচ, ধরুন এই একান্ন হাজার টাকা।’

বাড়ি ফিরেও হেঁচকি বন্ধ হচ্ছিল না। কয়েক বোতল জল, চিনি, এমনকি একটা ওষুধও খেলাম। তারপর বিকালের দিকে ছাদে উঠে এক জায়গায় বসে থাকলাম। মাথার উপর সন্ধে নামার আকাশ, হাল্কা হাওয়া লাগছে। বসে থেকে ঘুম এসে যাচ্ছিল। হঠাৎ নিচতলা থেকে বাবার ডাক শুনে নেমে এলাম।

আমাকে দেখে বাবা বলে উঠল, ‘হ্যাঁরে শুনেছিস, আমাদের বাজারে একটা কি এসেছে, মাথায় চুল বসিয়ে দেয়। কাল অফিস থেকে ফেরার সময় একবার খোঁজ নিয়ে আসিস।’

কথাগুলো শুনলাম, বাবা দাদু সবার কথা মনে পড়তেই বলে উঠলাম, ‘না, আমার এই টাকই ভালো, দিব্যি আছি, তেল চিরুনি সাবান শ্যাম্পু কোন ঝামেলা নেই।’

–বিয়ের ব্যবস্থা তো করতে হবে, কতদিন আর এভাবে চলবে। বাবা চিৎকার করে উঠল।

বুঝলাম, আমার এই টাকেই বিয়ের সব যোগগুলোই পিছলে যাচ্ছে।

অগত্যা তার পরের দিনেই যেতে হল।ছোট চুলের একজন কম বয়সী মেয়ে আমাকে দেখে বিভিন্ন চুলের প্যাকেজ জানিয়ে তাদের রেট বলে দিল। তারপর আমার ছবি তাদের কম্পিউটারে নিয়ে বিভিন্ন চুলে বসিয়ে কোনটা আমার টাক থুরি মাথার সাথে ভালো ভাবে বসে বা মেশে সেটা দেখে যেতে লাগল। সে আরেক ঝকমারি। একটা করে চুল বসায় আমার মুখের দিকে তাকায় আর তাদের সেন্টারের বাকি সবাইকে ডেকে দেখতে বলে। এই করেই কয়েকঘন্টা পেরিয়ে গেল। বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে আসতে গেলাম অমনি একজন বলে উঠলেন,‘এই যে এটা আপনার মাথার জন্যে এক্কেবারে ঠিক।এই চুলটাই বসাবো।’ দিনক্ষণ সব বলে দিলেন। পাঁচশটাকা অ্যাডভান্সও নিয়ে নিলেন। আমার ঐ চুল ভর্তি মাথার ছবি চোখেই তোলা থাকল। রাতে উত্তেজনায় ভালো করে ঘুম এল না। রাতে স্বপ্ন দেখলাম আমার সারা মাথায় চুল কিন্তু পাড়ার কুকুর থেকে মানুষ কেউই চিনতে পারছে না। অফিসে গিয়েও একই অবস্থা, কেউ ঢুকতেই দিতে চায় না। বেরিয়ে যেতে বলে। নিজেকে কেমন যেন ঠগ জোচ্চর মনে হয়। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই চিৎকার করে উঠি, ‘আমি এই চুল রাখবো না গো, টাকই ভালো, আমার এই টাকই ভালো।’

ঘুম ভেঙে যায়। টাকে হাত বোলাই। ঘামে ভিজে গেলেও কি শান্তি। এটা কি আর কেউ বুঝতে পারবে?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *