টোটকা-রজত বন্দ্যোপাধ্যায়

টোটকা-রজত বন্দ্যোপাধ্যায়

টোটকা

 

  • রজত বন্দ্যোপাধ্যায়, ০৫/০৬/২০২১

 

আজ থেকে বছর তেত্রিশ চৌত্রিশ আগে রাঁচিতে তখনো একটু সবুজ বাকি ছিল, ইলেকট্রিসিটি আর লোডশেডিংএর মধ্যে সারাদিন যে কোন একের টিকে থাকার প্রতিযোগিতা ছিল, আলাদা ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দাবিতে রাজনৈতিক আবহাওয়া গরম ছিল। যেটা একেবারেই ছিল না সেটা হচ্ছে সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা; এককথায় সবাই ছিল সবার রাজা। আর রাজারা তো যখন তখন অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত। ঠিক ঐ সময়টাতে আমি রাঁচিতে পোষ্টেড ছিলাম। কাজকম্মের চাপ তেমন কিছু ছিল না। কারণ ঐ যে বললাম ‘সবাই ছিল সবার রাজা’।

 

সবুজ হয়ত বা একটু বাকি ছিল বলে বৃষ্টি খুব হত। রাঁচির সেই বৃষ্টি ছিল ভীষণরকম রোমাণ্টিক আর ভীষণরকম পুরুষালি। ঐ ম‍্যাড়ম‍্যাড়ে টিপ্ টিপ্, ঝিরিঝিরির ব্যপার ছিল না; শুধু ঝম্ ঝম্ ঝম্, ঝম্ – একটানা সারাদিন, দুদিন, তিনদিন। একবার তো একটানা পাঁচদিন পেয়েছিলাম; সেবার সুবর্ণরেখা পাগল হয়ে গেছিল।

 

রাঁচির সেইরকম এক ঘোর বর্ষায় আমাকে দুদিনের জন্য জামশেদপুর যেতে হয়েছিল অফিসের কাজে; আজ সকালে বেরিয়ে পরশু সকালে ফেরা। দ্বিতীয়দিন সকাল থেকে জামশেদপুরেও মুষলধারে বৃষ্টি শুরু। জানা গেল পুরো ছোটনাগপুর অঞ্চল জুড়ে এই নিম্নচাপ মেশানো বর্ষার বৃষ্টি অন্তত দিনতিনেক ধরে একটানা চলবে। এই পর্যন্ত্য তবু সবকিছু ঠিকই ছিল। অফিস পৌঁছতেই বোমাটা ফাটলো। জানা গেল ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত কোনো এক বা একাধিক শরীক সেদিন রাত বারোটা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ্ ডেকেছে। ওদের ডাকা বন্ধ্গুলো সত্যিকারের সিরিয়াস টাইপের বন্ধ্ হতো; পশুপাখীরাও কেমন যেন চুপচাপ হয়ে পড়ত। আর ঐসময়ে ‘অনির্দিষ্টকাল’ আক্ষরিক অর্থেই ‘অনির্দিষ্টকাল’ হত।

 

সেই পরিস্থিতিতে একমাত্র যা করনীয় সেটাই করলাম। অফিসেই এক কাপ চা দুটো বিস্কুট দিয়ে খেয়ে, নিজের ‘৭৪ মডেলের অ্যমবাসেডরে চড়ে স্টিয়ারিং ধরে সোজা রাঁচির উদ্দেশে রওনা বেলা এগারটায়। মুষলাধার বৃষ্টি, রাস্তার আলো সব জ্বালানো; মেঘের কালো আর কালো পিচ্ রাস্তা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়ে চারদিক আবছা কালচে আলোআঁধারি। একশ চল্লিশ কিলোমিটার মত রাঁচি পর্যন্ত্য একদম সোজা রাস্তা; কোথাও ট্যারাব্যাঁকা নেই। এই আবহাওয়ায় ঘণ্টা সাড়েতিন-চারেকের যাত্রা।

 

মিনিট পনের পরে শহর ছেড়ে হাইওয়েতে উঠতে না উঠতে সামনের ওয়াইপার্ শুধু অকেজো হয়েই ক্ষান্ত হলো না, একেবারে গোড়া থেকে খুলে বনেটের ওপর দিয়ে পিছলে রাস্তায় গিয়ে পড়ল। আমি আর গাড়ী দাঁড় করাই নি। সত্যি কথা বলতে খুব একটা কিছু অসুবিধা হচ্ছিল না চালাতে যেহেতু বৃষ্টিটা হয়ে যাচ্ছিল একটানা মুষলধারে।

 

যাই হোক, আস্তে আস্তে এগোচ্ছি। ওয়াইপারের মায়া কাটিয়ে, মানসিক দিক থেকে একটু ধাতস্থ হয়ে, কন্ফিডেণ্সটা একটু বাড়িয়ে গাড়ী চালাচ্ছি। সামনে চাণ্ডিল-পুরুলিয়া মোড়, প্রথম মাইলষ্টোন। হঠাৎ মনে হলো ব্রেক পেডালটা মাখনে ছুরি চালানোর মতন বসে গেল। সন্দেহ কাটাতে আবার পা রাখতেই সেই একই ব্যপার। মোড়ের মাথায় দু’তিনটে ঝুপড়ি। হাওয়া, পাংচার, ছোটখাটো রিপেয়ার, মদ এইসবের। গাড়ী দাঁড় করিয়ে একটু অনুরোধ করাতে একটা বছর দশ বারোর ছেলে একটা ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বনেট খুলে চেক করল। তারপর গাড়ীর তলায় শুয়ে ওখান থেকেই চেঁচিয়ে বলল ব্রেক অয়েল লিক হয়ে গেছে। সেটা শুনে ওর সিনিয়র বেরিয়ে এল একটা প্লাস্টিক মাথায় দিয়ে। সে বছর ষোল-সতেরর বেশি কোনমতেই ছিল না। সেও চেক করে একই রায় দিল। আমি সারানোর উপায় জিজ্ঞেস করাতে কুণ্ঠাহীণভাবে জানিয়ে দিল কোনো উপায় নেই কিছু করার। এই বৃষ্টিতে সব বাড়ী চলে গেছে। পরের দিন থেকে বন্ধের জন্য এই ঝুপড়িগুলোও যে খুলবে না সেটা জানাতেও ভুলল না। এইসব বলেটলে দুজনে একদৌড়ে গিয়ে ঝুপড়ির মধ‍্যে ঢুকে পড়ল।

 

এই সবের মধ্যে দেড়টা বেজে গেছে। সেই আবছাকালো আলোআঁধারির মধ্যে একটানা মুষলধারা বৃষ্টি ক্ষমাহীন, পাষণ্ডিক, পাশবিক। আমি আর আমার সংজ্ঞাহীন অ্যমবাসেডর চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। পরবর্তী পদক্ষেপ সম্বন্ধে সম্পুর্ণ ধারণাহীন। হঠাৎ সেই বছর দশ-বারোর ছেলেটা চেঁচিয়ে আমাকে একটা ঝুপড়ির মধ্যে ডাকল। গিয়ে দেখি ভেতরে একটা দড়ির খাটিয়ায় একজন মোটামুটি বেশ বয়স্ক লোক বসে আছে। খাটিয়ার আবার তিনটে পায়া; চতুর্থটার জায়গায় দুটো ফাটা টায়ার গোঁজা আছে। বৃদ্ধের একদমই মত নয় যে গাড়ীর এই অবস্থায় আমি রাঁচি যাওয়ার কথা ভাবি। কিন্তু আমার পরিস্থিতি বিচার করে সে বলল আমাকে গাড়ী চালিয়ে যাওয়ার একটা টোটকা সে দিতে পারে, কিন্তু একটা শর্তসাপেক্ষে। সেটা হচ্ছে আমাকে কথা দিতে হবে যে পুরো রাস্তা আমি কোনমতে তিরিশ থেকে পঁয়তিরিশ কিলোমিটারের বেশি জোরে গাড়ী চালাব না।

 

নিরুপায় আমি কথা দিয়েছিলাম। বৃদ্ধ আমার কথায় ভরসা রেখে টোটকা দিয়েছিল। বৃদ্ধ বলেছিল পারতপক্ষে ব্রেকে পা না দিতে আর কিছুক্ষণ পরে পরে ব্রেক ফ্লুইড রাখার জায়গায় জল ভরে দিতে।

আমার দেওয়া কথা আর বৃদ্ধের দেওয়া টোটকার ভরসায় আমি রওনা দিয়েছিলাম রাঁচির দিকে, ‘যা আছে কপালে হবে’ মানসিকতা নিয়ে। রাস্তায় পরে তামাণ্ড, দ্বিতীয় মাইলষ্টোন। গাড়ী দাঁড় করিয়ে চা আর কচুরী খেয়েছিলাম, তারপর আট-নয় কিলোমিটার মোটামুটি খাড়াই ঘাট সেকশন্ পার হয়ে রাঁচি পৌঁছেছিলাম সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ।

 

আশ্চর্যের ব্যপার ছিল পুরো রাস্তায় ব্রেক ঠিকঠাক কাজ করেছিল, এমনকি ঘাটিতে চালানোর সময়েও।

 

দিন কুড়ি পরে, এক ঝকঝকে দিনে জামশেদপুর যাওয়ার সময়, সেই তিন-পায়া খাটিয়াঅলা ঝুপড়িতে বসে বছর বারো, বছর ষোল, বৃদ্ধ, আমি আর জনা কয়েক মিলে একসঙ্গে বসে, দাঁড়িয়ে, বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে রাঁচির অনেক মিষ্টি খেয়েছিলাম।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *