ডায়াবেটিস রোগ কি?
আমাদের শরীরের ইনসুলিন নামের হরমোনের সম্পূর্ণ বা আপেক্ষিক ঘাটতির কারণে বিপাকজনিত গোলযোগ সৃষ্টি হয়ে রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং একসময় তা প্রশ্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে আসে । এই সামগ্রিক অবস্থাকে ডায়াবেটিস বলে । ডায়াবেটিস এক প্রকার বিপাক জনিত রোগ । এই রোগে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ দীর্ঘস্থায়ীভাবে বেড়া যায় । সুস্থ লোকের রক্তের প্লাজমায় (রক্ত রস) গ্লুকোজের পরিমাণ অভূক্ত অবস্থায় ৬.৪০ মিলি মোলের কম এবং খাবার দুই ঘন্টা পরে ৭.৮ মিলি মোলের কম থাকে । অভূক্ত অবস্থায় রক্তের প্লাজমায় (রক্ত রাস) গ্লুকোজের পরিমাণ ৭.৮ মিলি মোল বা তার বেশী অথবা ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার দুই ঘন্টা পরে রক্তের প্লাজমার (রক্ত রস) গ্লুকোজের পরিমাণ ১১.১ মিলি মোল বা তার বেশী হলে ডায়াবেটিস সনাক্ত করা যায় ।
রক্তে গ্লুকোজ কেন বাড়ে?
অগ্ন্যাশয় নামক একটি গ্রন্থি থেকে ইনসুলিন নামে একটি হরমোন নিঃসৃত হয় । এই ইনসুলিন গ্লুকোজকে ভেঙ্গে শরীরের বিভিন্ন কাজে লাগাতে সাহায্য করে । কোন কারণে এই ইনসুলিনের অভাব হলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং অতিরিক্ত গ্লুকোজ প্রস্রাবের সাথে বেরিয়ে আসে । একজন স্বাভাবিক মানুষ ও ডায়াবেটিস রোগীকে নিচের ছক দিয়ে অতি সংক্ষেপে এইভাবে বোঝানো যেতে পারেঃ
সাভাবিক মানুষ | ডায়াবেটিস রোগী |
অগ্ন্যাশয় | অগ্ন্যাশয় |
ইনসুলিন আছে | ইনসুলিন নেই বা কার্যকারিতা হ্রাস পেয়েছে |
গ্লুকোজ কাজে লাগছে | গ্লুকোজ কাজে লাগছে না |
শক্তি উৎপাদন হচ্ছে | রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যাচ্ছে ও যতেষ্ঠ শক্তি উৎপাদন হচ্ছে না |
সুস্থ | ডায়াবেটিস রোগী |
সাধারণত ডায়াবেটিস রোগে বংশগত ও পরিবেশের প্রভাব দুটোই দায়ী । কদাচিৎ কোন কোন বিশেষ অসুখ থেকেও ডায়াবেটিস হতে পারে ।
শক্তির জন্য দেহে শর্করা, আমিষ ও চর্বি জাতীয় খাবার প্রয়োজন । ডায়াবেটিস হলে শর্করা ও অন্যান্য খাবার সঠিকভাবে শরীরের কাজে আসে না । ডায়াবেটিস রোগী প্রয়োজন মতো কার্যকারী ইনসুলিন নামের এই রস পায় না বলে দেহে শর্করা, আমিষ ও চর্বি জাতীয় খাদ্যের বিপাকও সঠিক হয় না ।
ডায়াবেটিস রোগের লক্ষণ
- ঘন ঘন প্রসাব হওয়া ।
- খুব বেশী পিপাসা লাগা ।
- বেশী ক্ষুধা পাওয়া ।
- যতেষ্ট খাওয়া সত্ত্বেও ওজন কমে যাওয়া ।
- ক্লান্তি ও দুর্বলতা বোধ করা ।
- ক্ষত শুকাতে বিলম্ব হওয়া ।
- খোশ-পাঁচড়া, ফোঁড়া প্রভৃতি চর্মরোগ দেখা দেওয়া ।
- চোখে কম দেখা ।
বয়স্ক রোগীদের অনেক ক্ষেত্রে এসব লক্ষণ প্রকাশ প্রায় না এবং
সাধারণত স্বাস্থ্য পরীক্ষাতেই ডায়াবেটিস ধরা পড়ে ।
|
কাদের ডায়াবেটিস হতে পারে?
যে কেউ যে কোন বয়সে যে কোন সময়ে ডায়াবেটিস আক্রান্ত হতে পারেন । তবে তিন শ্রেণীর লোকের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকেঃ
১. যাদের বংশে, যেমন – বাবা-মা, বা রক্ত সম্পর্কিত নিকট আত্মীয়ের ডায়াবেটিস আছে ।
২. যাদের ওজন অনেক বেশী ।
৩. যারা ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রমের কোন কাজ করেন না ।
৪. বহুদিন ধরে কর্টিসোল জাতীয় ঔষধ ব্যবহার করলে ।
যে সব অবস্থায় ডায়াবেটিস প্রকাশ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকেঃ
১. শারীরিক স্থুলতা
২. গর্ভাবস্থা
৩. ক্ষত
৪. আঘাত
৫. অস্ত্রোপচার
৬. মানসিক বিপর্যয়
৭. রক্তনালীর অসুস্থার কারণে হঠাৎ করে মস্তিস্কের রোগ হলে ।
ডায়াবেটিস কি সারানো যায়?
ডায়াবেটিস রোগ সারে না । ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ । তবে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এ রোগকে খুব ভালভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় । ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকলে প্রায় স্বাভাবিক কর্মঠ জীবন যাপন করা সম্ভব ।
ডায়াবেটিসকে মূলত চার শ্রেণীতে বা ধরণে বিন্যাস করা হয়েছে
ক) ধরণ ১ (Type 1) :
পূর্বে এই শ্রেণীকে ইনসুলিন নির্ভরশীল রোগ বলা হতো । এই ধরণের রোগীদের শরীরে ইনসুলিন একেবারেই তৈরী হয় না । সাধারণত ৩০ বৎসরের কম বয়সে (গড় বয়স ১০-২০ বৎসর) এধরণের ডায়াবেটিস দেখা যায । বেঁচে থাকার জন্য এসকল রোগীকে ইনসুলিন ইনজেকশন নিতেই হয় । অন্যথায় রক্তের শর্করা অতি দ্র্রত বেড়ে গিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই রক্তে অম্লজাতীয় বিষক্রিয়ায় অজ্ঞান হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয় । অজ্ঞান হয়ে যাওয়া অবস্থায় প্রস্রাবে এসিটোন পাওয়া যায় । এ ধরণের রোগীরা সাধারণত কৃষকায় হয়ে থাকেন । সৌভাগ্যবশত আমাদের দেশে ইনসুলিন নির্ভরশীল ধরণ ১ রোগীর সংখ্যা খুবই কম ।
খ) ধরণ ২ (Type 2) :
এই শ্রেণীর রোগীর বয়স অধিকাংশ ক্ষেত্রে ত্রিশ বৎসরের উপরে হয়ে থাকে । তবে আজকাল ত্রিশ বছরের নিচে এই ধরণের রোগীর সংখ্যা দেখা দিচ্ছে এবং দিনে দিনে বেড়ে চলছে । এদের শরীরে ইনসুলিন তৈরী হয় তবে প্রয়োজনের তুলনায় যতেষ্ঠ নয় অথবা শরীরে ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা কমে যায় । অনেক সময় এই ধরণের কারণ একই সাথে দেখা দিতে পারে । ইনসুলিন কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ার সাথে সাথে এই ধরণের রোগীর বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে স্থুলকায় হয়ে থাকেন । ইনসুলিন ইনজেকশন না দিলে প্রথম শ্রেণীর রোগীর মত এদের বিশক্রিয়া হবে না । অর্থাৎ এরা এনসুলিন নির্ভরশীল নয় । অনেকে কোন শারীরিক অসুবিধা অনুভব করেন না বলে এরা চিকিৎসকের কাছে আসেন না । ফলে বিনা চিকিৎসায় অনেক দিন কাটানোর কারণে বিভিন্ন প্রকার জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে আসেন । অনেক ক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন এবং নিয়মিত ব্যায়মের সাহায্যে এদের চিকিৎসা করা সম্ভব । এই পদ্ধতিতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ না হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষুধ খেতে হয় । কোন কোন বিশেষ ক্ষেত্রে সাময়িক ইনসুলিন প্রয়োজন হতে পারে । ১৫-২০ বসৎরের পর অনেককে ইনসুলিন নির্ভরশীলদের মতো স্থায়ীভাবে ইনসুলিন দেয়া লাগতে পারে, ডায়াবেটিস সুনিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য নয় ।
গ) অন্যান্য নির্দিষ্ট কারণ ভিত্তিক শ্রেণীঃ
- জেনেটিক কারণে ইনসুলিন তৈরী কম হওয়া
- জেনেটিক কারণে ইনসুলিন কার্যকারিতা কমে যাওয়া
- অগ্ন্যাশয়ের বিভিন্ন রোগ
- অন্যান্য হরমোন আধিক্য
- ঔষধ ও রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শ
- সংক্রমণ ব্যাধি
- অন্যান্য কোন প্রতিরোধ ক্ষমতার জটিলতা
পূর্বে প্রচলিত অপুষ্টিজনিত ডায়াবেটিস বর্তমনে শ্রেণীবিভাগ থেকে বাদ দেয়া হয়েছে । আমাদের দেশে ও অন্যান্য অনুন্নত দেশে বিশেষ করে উষ্ণমন্ডলীয় দেশগুলোতে অপুষ্টির সাথে ডায়াবেটিস দেখা যায় । কিন্তু নির্দিষ্ট প্রমাণ না পাওয়াতে বৈজ্ঞানিকগণ অপুষ্টিকে ডায়াবেটিসের কারণ হিসাবে চিহ্নিত করতে রাজী নন । এই ধরনের রোগী ক্ষীণকায় ও অপুষ্টির শিকার হয়ে থাকেন এবং ইনসুলিন ছাড়া অনেক দিন বেঁচে থাকতে পারে । এদের বয়স ৩০ বৎসরের নিচে হয়ে থাকে । অগ্ন্যাশয়ে পাথর পাওয়া অপুষ্টিজনিত ডায়াবেটিসকে অন্যান্য কারণ হিসাবে বিশেষ শ্রেণীভুক্ত রাখা হয়েছে । বিশেষজ্ঞদের ধারণা অপুষ্টি প্রধান দুই শ্রেণীর ডায়াবেটিসের লক্ষণাদের বৈশিষ্টকে পরিবর্তন করে বিশেষভাবে অনুন্নত দেশে পরিলক্ষিত হচ্ছে ।
ঘ) গর্ভকালীন ডায়াবেটিস
অনেক সময় গর্ভবতী অবস্থায় মায়েদের ডায়াবেটিস ধরা পড়ে । আবার সন্তান প্রসবের পর ডায়াবেটিস থাকে না । এই সব ডায়াবেটিসকে গর্ভকালীন বলা হয় । গর্ভবতী মায়েদের ডায়াবেটিস মা, ভ্রণ এবং শিশু সবার জন্যই বিপদজনক হতে পারে । বিপদ এড়াবার জন্য গর্ভবতী মায়েদের ডায়াবেটিস বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন । এদের ডেলিভারী হাসপাতালে করানো বাঞ্ছনীয় ।
ডায়াবেটিস মহিলাদের জন্য জ্ঞাতব্য
ডায়াবেটিস মহিলা যদি সন্তান ধারণ করতে চান, তবে গর্ভবতী হওয়ার পূর্বে অবশ্যই তাকে চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হতে হবে । চিকিৎসাকের সুনির্দিষ্ট পরামর্শ ছাড়া ডায়াবেটিস মহিলাদের কোনমতেই গর্ভবতী হওয়া উচিত হবে না । ৩-৫ মাস আগে থেকেই খাওয়ার বড়ি বাদ দিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ইনসুলিন নিতে হবে । HbA1c ৫.৬% এর কাছাকাছি হলে চিকিৎসকের অনুমতি সাপেক্ষে গর্ভধারণে আসতে পারেন । গর্ভকালীন অবস্থায় তাকে অবশ্যই ইনসুলিনের সাহায্যে তার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, গর্ভকালীন সময়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে বড়ি খাওয়া উচিত হবে না । ডায়াবেটিস মহিলারা নির্দ্বিধায় জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খেতে পারেন, এতে ডায়াবেটিসের কোন হ্রাসবৃদ্ধি হবে না ।
পূর্বের শ্রেণীবিভাগকে বর্তমানে বৈজ্ঞানিকগণ ডায়াবেটিসের বিভিন্ন ধাপ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন ।
ধাপ =১: স্বাভাবিক অবস্থা
ধাপ=২: অভূক্ত অবস্থায় শর্করা আধিক্য (ইম্পোয়ার্ড ফাস্টিং গ্লুকোজ-আই এফজি)
ধাপ=৩: শর্করা অসহিষ্ণুতা (ইম্পোয়ার্ড গ্লুকোজ টলারেন্স-আইজিটি)
উপ-ধাপ-১: ইনসুলিন ছাড়াই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব (খাদ্য, ব্যায়াম ও খাবার ঔষধসহ)
উপ-ধাপ-২: সুনিয়ন্ত্রণের জন্য ইনসুলিন প্রয়োজন (খাদ্য, ব্যায়ম ও খাবার ঔষধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ না হলে)
উপ-ধাপ-৩: জীবন ধারনের জন্য ইনসুলিন নির্ভরশীলতা
(ডায়াবেটিসের উপ-ধাপ-১ ও ২ কে ইনসুলিন অনির্ভরশীল ডায়াবেটিস পর্যায় বলা যায়)
অভুক্ত অবস্থায় শর্করা আধিক্য:
শুধু অভুক্ত অবস্থায় শর্করার আধিক্য যাদের থাকে পরর্বতী সময়ে তদের ডায়াবেটিস ও তার জটিলতা হতে দেখা যায় । তাই বিশেষজ্ঞগণ এই অবস্থাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেন । অভুক্ত অবস্থায রক্তে শর্করার পরিমাণ ৬.০ মিলি মোল/লিটার বা এর অধিক এবং ৭.০ মিলিমোল/লিটার এর নিচে-এই ধাপ বোঝায় । এই অবস্থা নিয়ন্ত্রণ না রাখলে পরবর্তী বয়সে ডায়াবেটিস ও অন্যান্য ধমনী-শিরা ও হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে ।
শর্করা অসহিষ্ণুতা
কোন কোন রোগীর রক্তে শর্করার (গ্লুকোজ) পরিমাণ সুস্থ মানুষের রক্তের শর্করার পরিমাণ থেকে বেশী, অথচ তা ডায়াবেটিস রোগীর রক্তের গ্লুকোজের তুলনায় কম হতে পারে । এই ধরনের রোগীকে আইজিটি বলা যেতে পারে । অভুক্ত অবস্থায় এদের রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ ৭.৮ মিলি মোলের কম থাকবে এবং ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার পর রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ ১১.১ মিলি মোলের কম অথচ ৭.৮ মিলি মোলের বেশী থাকবে । আইজিটি রোগীদের ডায়াবেটিস রোগীদের মতোই নিয়ম-শৃংখলা মেনে চলতে হয়, কারণ আইজিটি হলে রোগীদের ডায়াবেটিস রোগীদের মতোই বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে । এক-তৃতীয়াংশ আইজিটি রোগী কিছুকাল পর ডায়াবেটিস রোগীতে পরিণত হয় ।
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থেকে বিপদ
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখলে অনেক বিপদ হয় । ডায়াবেটিস ভালভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখাই চিকিৎসার লক্ষ্য । ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখলে যে সব মারাত্মক উপসর্গ অথবা জটিলতা দেখা দিতে পারে তা জেনে রাখা ভাল ।
পক্ষাঘাত, হৃদরোগ, পায়ে পচনশীল ক্ষত, চক্ষুরোগ, মূত্রাশয়ের রোগ, প্রস্রাবে আমিষ বের হওয়া, পাতলা পায়খানা, যক্ষা, মাড়ির প্রদাহ, চুলকানি, ফোঁড়া, পাঁচড়া ইত্যাদি । তাছাড়া, রোগের কারণে যৌন ক্ষমতা কমে যেতে পারে এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে বেশী ওজনের শিশুর জন্ম, মৃত শিশুর জন্ম, অকালে সন্তান প্রসব, জন্মের পরই শিশুর মৃত্যু এবং নানা ধরনের জন্ম ক্রটি দেখা দিতে পারে । রোগীদের ডায়াবেটিস সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা ছাড়াও শরীরের ওজন বাঞ্ছিত ওজনের কাছাকাছি রাখা উচিত । ডায়াবেটিস রোগীদের উচ্চ রক্তচাপের রোগ হলে তাদের রক্তচাপ স্বাভিবক রাখা প্রয়োজন । ভিন্ন ভিন্ন ভাবে এই দুটি রোগ থেকে যে সব জটিলতা দেখা দেয় এই দুটি রোগ একত্র হলে তার চেয়ে জটিলতা আরও বেশী হয় । ডায়াবেটিস রোগীদের কিছুতেই ধুমপান করা উচিত নয় । ডায়াবেটিসের সঙ্গে ধুমপান যুক্ত হলে রোগের জটিলতা অনেক গুণ বেড়ে যায় ।
ডায়াবেটিস রোগের জরুরী অবস্থা
হাইপোপ্লাইসোমিয়া (রক্তে শর্করা স্বল্পতা)
রক্তে শর্করার পরিমাণ কমানোর জন্য ট্যাবলেট বা ইনসুলিন দেওয়া হয় । ট্যাবলেট খাওয়ার বা ইনসুলিন নেওয়ার ফলে যদি শর্করার পরিমাণ খুব কমে যায় অর্থাৎ ২.৫ মিলি মোলের কম হয় তাহলে শরীরে প্রতিক্রিয়া হতে পারে ।
প্রতিক্রিয়ার লক্ষণগুলি নিম্নরূপ
- অসুস্থ বোধ করা
- খুব বেশী খিদে পাওয়া
- বুক ধড়ফড় করা
- বেশী ঘাম হওয়া
- শরীর কাঁপতে থাকা
- শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা
- অস্বাভাবিক আচরণ করা
- অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
কেন এবং কখন এই সব লক্ষণ দেখা দেয়?
- ঔষধের (ট্যাবলেট বা ইনসুলিন) পরিমাণ বেশী হলে
- খাবার খুব কম হলে বা খেতে ভুলে গেলে
- ইনসুলিন নেওয়ার পর খুব দেরী করে খাবার খেলে
- হঠাৎ বেশী ব্যায়াম বা দৈহিক পরিশ্রম করলে ।
হাইপোপ্লাইসেমিয়া হলে কি করা উচিৎ?
প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়া মাত্রই চা-চামচের ৪ থেকে ৮ চামচ গ্লুকোজ বা চিনি এক গ্লাস পানিতে গুলে খেয়ে নেবেন কিংবা তাকে খাইয়ে দিতে হবে । রোগী অজ্ঞান হয়ে গেলে মুখে কিছু খাওয়াবার চেষ্টা না করে গ্লুকোজ ইনজেকশন দিতে হবে বা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে ।
ডায়াবেটিক কোমা
ইনসুলিন নির্ভরশীল রোগীদেরই সাধারনত ডায়াবেটিস কোমা হয়ে থাকে । অপর্যাপ্ত ইনসুলিন দিলে বা ইনসুলিন নির্ভরশীল রোগী ইনসুলিন একেবারে না দিলে রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে বিপর্যয় দেখা দেয় । ইনসুলিনের অভাবে রক্তের শর্করা শরীরের কাজে লাগাতে পারে না, তখন তাপ ও শক্তির জন্য দেহের সঞ্চিত চর্বি ব্যবহার হতে থাকে । কিন্তু পর্যাপ্ত ইনসুলিনের অভাবে এই চর্বি অতিরিক্ত ভাঙ্গার ফলে কিছু ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ (কিটোন বডিস) রক্তে বেড়ে যায়, ফলে এসিটোন নামক একটি কিটোন বডি প্রস্রাবের সাথে বের হতে থাকে । রক্তে কিটোন বডির পরিমাণ বেশী মাত্রায় বেড়ে গেলে মস্তিস্ক ক্ষতিগ্রস্থ এবং রোগী অজ্ঞান হয়ে যায় । এই অবস্থাকে ডায়াবেটিক কোমা বলে ।
ডায়াবেটিক কোমার লক্ষণ
- প্রস্রাবের শর্করার পরিমাণ খুব বেশী বেড়ে যাওয়া
- খুব বেশী পিপাসা লাগা
- ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া
- অত্যন্ত বেশী ক্ষুধা লাগা
- খুব বেশী অসুস্থ বোধ হওয়া
- বমি ভাব
- দুর্বলতা বোধ হওয়া
- ঝিমানো
- শ্বাস কষ্ট হওয়া
- দ্রুত শ্বাস নেওয়া
- মাথা ধরা
- চোখে ঝাপসা দেখা
- নিস্তেজ বোধ হওয়া
- শ্বাসের এসিটোনের গন্ধ বের হওয়া
এই লক্ষণগুলি দেখা দিলে
শরীরে পানি স্বল্পতা কমার জন্য অতিরিক্ত লবন মিশ্রিত পানি খেতে পারেন ।
- ইনসুলিন পরিমাণ বাড়তে হবে
- প্রস্রাবে কিটোন বডি আছে কি না তা পরীক্ষা করতে হবে
- অবিলম্বে চিকিৎসকের সহায়তা নিতে হবে ।
রক্তে শর্করার পরিমাণ কেন বাড়ে?
- বেশী খাবার খেলে
- ব্যায়াম বা দৈহিক পরিশ্রম না করলে
- পরিমাণের চেয়ে কম ইনসুলিন নিলে
- ডায়াবেটিসের ট্যাবলেট খেতে তুলে গেলে বা না খেলে
- কোন সংক্রামণ বা প্রদাহজনিত রোগ হলে বা মানসিক বিপর্যয় দেখা দিলে
- অর্ন কোন রোগের চিকিৎসার সময় ডায়াবেটিসের চিকিৎসা বন্ধ রাখলে ।
ডায়াবেটিসের চিকিৎসা
ডায়াবেটিস সম্পূর্ণ সারানো বা নিরাময় করা যায় না । তবে এ রোগ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব এবং এই বিষয়ে চিকিৎসক রোগীকে সাহায্য করতে পারেন ।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে পাঁচটি নিয়ম মানতে হয়
- খাদ্য ব্যবস্থা
- ঔষধ
- ব্যায়াম
- শৃংখলা
- শিক্ষা
প্রতিটি পদক্ষেপে শৃংখলা মেনে চলা প্রয়োজন ।
খাদ্য ব্যবস্থা
ডায়াবেটিস হলে খাদ্যের একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে হয । খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা ডায়াবেটিস হওয়ার আগে যে রকম থাকে পরেও একই থাকে পুষ্টির চাহিদা কোন তারতম্য হয় না । প্রধান দুইটি উদ্দেশ্য থাকে খাদ্যের নিয়ম মেনে চলা, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা, স্বাস্থ্য ভাল রাখা ।
খাদ্য গ্রহণের নীতি
- শরীরের ওজন বেশি থাকলে বা কমিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা, কম থাকলে বাড়িয়ে স্বাভাবিক করা এবং ওজন স্বাভাবিক মাত্রায় থাকলে সেটা বজায় রাখা একান্ত আবশ্যক ।
- চিনি-মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়া বাদ দিতে হবে ।
- শর্করাবহুল খাবারগুলো (চাল, আটা দিয়ে তৈরী খাবার, মিষ্টি ফল ইত্যাদি) কিছুটা হিসাব করে খেতে হবে ।
- আঁশবহুল খাবার (ডাল, শাক, সবজি, টক ফল ইত্যাদি) বেশী খেতে হবে ।
- সম্পৃক্ত ফ্যাট (স্যাচুরেটেড ফ্যাট), যেমন- ঘি, মাখন, চর্বি, ডালডা, মাংস ইত্যাদি কম খাওয়া, পরিবর্তে অসম্পৃক্ত ফ্যাট (আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট), যেমন, উদ্ভিজ তেল, অর্থাৎ সয়াবিন তেল, সরিষার তেল, ইত্যাদি এবং সব ধরণের মাছ খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে ।
- নির্দেশিত খাদ্য তালিকা শিখে নিতে হবে ।
- গাইড বইয়ে উল্লেখিত খাদ্য-বিনিময় তালিকা (ছবি দ্রষ্টব্য) শিখে নিতে হবে ।
- ক্যালরীবহুল খাবার নির্দেশিত পরিমাণে খেতে হবে ।
- নির্দিষ্ট সময়ে খাবার খেতে হবে ।
- কোন বেলার খাবার খাওয়া বাদ দেওয়া ঠিক নয় ।
- আজ কম, কাল বেশী-এভাবে খাবার খাওয়া ঠিক নয় ।
- অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হলে অর্থাৎ অসুস্থ অবস্থায় বিশেষ্য খাদ্য ব্যবস্থা জেনে নিতে হবে ।
ব্যায়াম
কোন নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে ব্যায়াম বা শরীর চর্চার ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ । ব্যায়াম বা দৈহিক পরিশ্রম মাংসপেশীর জড়তা দূর করে এবং রক্ত চলাচলে সাহায্য করে । ব্যায়াম করলে শরীর সুস্থ থাকে, ইনসুলিনের কার্যকারিতা ও নিঃসরণের পরিমাণ বেড়ে যায় । প্রতিদিন অন্তত ৪৫ মিনিট হাঁটলে শরীর যথেষ্ট সুস্থ থাকবে ।
ঔষধ
সকল ডায়াবেটিস রোগীকেই খাদ্য ব্যবস্থা ও শৃংখলা মেনে চলতে হয় । অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে, এই দুইটি যথাযথভাবে পালন করতে পারলে রোগ নিয়ন্ত্রণে এসে যায় । কিন্তু ইনসুলিন-নির্ভলশীল রোগীদের ক্ষেত্রে ইনসুলিন ইনজেকশনের দরকার হয় । ইনসুলিন-অনির্ভরশীল কোন কোন রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসক শর্করা কমাবার জন্য ট্যাবলেট দিতে পারেন ।
শিক্ষা
ডায়াবেটিস আজীবনের রোগ সঠিক ব্যবস্থা নিলে এই রোগকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় । ব্যবস্থাগুলি রোগীকেই নিজ দায়িত্বে মেনে চলতে এবং রোগীর পরিবারের নিকট সদস্যদের সহযোগিতা এ ব্যাপারে অনেক সাহায্য করতে পারে । তাই এ রোগের সুচিকিৎসার জন্য ডায়াবেটিস সর্ম্পকে রোগীর যেমন শিক্ষা প্রয়োজন, তেমনি রোগীর নিকট আত্মীয়দেরও এই রোগ সর্ম্পকে কিছু জ্ঞান থাকা দরকার । কারণ শিক্ষার কোন বিকল্প নেই ।
শৃংখলা
শৃংখলা ডায়াবেটিস রোগীল জীবনকাঠি । রোগীকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে শৃংখলা মেনে চলতে হবে । তবে কয়েকটি বিষয়ের উপর বিশেষভাবে লক্ষ রাখতে হবে, যেমন –
- নিয়মিত ও পরিমাণ মতো সুষম খাবার খেতে হবে ।
- নিয়মিত ও পরিমাণ মতো ব্যায়াম বা দৈহিক পরিশ্রম করতে হবে ।
- চিকিৎসকের পরামর্শ ও ব্যবস্থাপত্র সুষ্ঠূভাবে মেনে চলতে হবে ।
- শরীর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাকতে হবে ।
- পায়ের বিশেষ যত্ন নিতে হবে ।
- নিয়মিত প্রস্রাব পরীক্ষা করতে হবে এবং ফলাফল প্রস্রাব পরীক্ষার বইতে লিখে রাখতে হবে ।
- চিনি, মিষ্টি, গুড়, মধুযুক্ত খাবার সম্পূর্ণ ছাড়তে হবে ।
- শারীরিক কোন অসুবিধা দেখা দিলে দেরী না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে ।
- চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন কারণেই ডায়াবেটিস রোগীর চিকিৎসা বন্ধ রাখা যাবে না ।
- তাৎক্ষণিক রক্তে শর্করা পরিমাপক যন্ত্র দিয়ে নিজেই রক্তের শর্করা পরিমাপ করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে সবচেয়ে ভাল ।
- রক্তে শর্করা পরিমাপক বিশেষ স্ট্রিপ দিয়েও তাৎক্ষণিকভাবে রক্তের শর্করা পরিমাপ করা যায় । রক্তে তাৎক্ষণিক শর্করা পরিমাপক যন্ত্র এখন দেশেই পাওয়া যাচ্ছে ।
ভালোভাবে শিক্ষা পেলে রোগী
- নিজেই নিজের রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার দক্ষতা অর্জন করবেন ।
- পরিবর্তিত জীবন প্রণালী সহজভাবে গ্রহণ করতে পারবেন ।
- জরুরী অবস্থা মোকাবিলা করার ক্ষমতা অর্জন করবেন । শিক্ষার গুরুত্বর্পূণ ভূমিকার জন্য বর্তমানে শিক্ষাকেও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের অন্যতম ব্যবস্থা বলে গণ্য করা হয় ।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে কি না কিভাবে বুঝবেন? ডায়াবেটিসের চিকিৎসা টার্গেট
পরীক্ষা | টাগের্ট |
রক্তে শর্করা | |
অভূক্ত অবস্থায় | ৪.৪-৬.১ মিলিমোল/লিটার |
খাবারের ২ ঘন্টা পর | ৪.৪-৮.০ মিলিমোল/লিটার |
HbA1c (হিমোগ্লোবিন এ১সি) | <৭.০% |
ওজন | |
বিএম. আই (BMI) | <২৫ কেজি/মিটার২ |
রক্ত চাপ | <১৩০/৮০ মিমি মারকারী |
রক্তের চর্বি | |
কোলেস্টরল (Colestrol) | < ২০০ মি গ্রা/ডেসি লিটার |
এল ডি এল (LDL) | <১০০ মি গ্রা/ডেসি লিটার |
এইচ ডি এল (HDL) | <৪০ মি গ্রা/ডেসি লিটার |
ট্রাইগ্লিসাবাইড (TG) | <১৫০ মি গ্রা/ডেসি লিটার |
হিমোগ্লোবিন এ১সি (HbA1c)
রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নির্ধারণ ছাড়াও অন্য একটি পরীক্ষার মাধ্যমে ডায়াবেটিসের অবস্থা সর্ম্পকে জানা যায় । আমাদের রক্তের লোহিত কণিকায় রয়েছে হিমোগ্লোবিন নামক একটি রাসায়নিক উপাদান । এই হিমোগ্লোবিনের গ্লোবিন নামক প্রোটিনের সাথে রক্তের কিছু গ্লুকোজ ধীরে ধীরে সংযুক্ত হয় ।