তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(শেষ) হুমায়ূন আহমেদ

আমি তাকে কথা শেষ করতে দিলাম না, তার আগেই বললাম – বাবা 

কটা বড় ঘর দাও | এই ঘরটা আসলেই ছােট। তার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি বললেন, নতুন ঘরে যখন যাচ্ছ তখন এক কাজ করা যাক। নতুন ঘরের জন্যে আলাদা করে ফার্নিচার কেনা যাক। 

তন্দ্রাবিলাসআমি বলাম, আচ্ছা। 

বাবা বললেন, আমার পাশের ঘরটা তুমি নিয়ে নাও | বাবা-মেয়ে পাশাপাশি থাকব, কি বল ? ভাল হবে না? 

খুব ভাল হবে বাবা । আমার ঘর বদল হল। নতুন ফার্নিচার এল। যা ভেবেছিলাম তাই হল, পুরানাে খাট বদলে কেনা হল আধুনিক বক্স খাট। যার নীচে বসার উপায় নেই। সাইকিয়াট্রিস্ট নিশ্চয়ই বাবাকে এই বুদ্ধি দিয়ে দিয়েছিলেন। একদিন কলেজ থেকে ফিরে দেখি— 

আমার আগের শােবার ঘরের কোনও ফার্নিচার নেই। সব ফার্নিচার কোথায় যেন পাচার করা হয়ে গেছে। বাবার পাশের ঘরটা সুন্দর করে সাজানাে নতুন ফার্নিচার। একটা টেবিলে ঝকঝকে কম্পিউটার। 

কম্পিউটার কিনে দেবার কথাও হয়ত সাইকিয়াট্রিস্ট বাবাকে বলে দিয়েছিলেন। কম্পিউটারে নানা ধরনের খেলা নিয়ে আমি ব্যস্ত থাকব। খাটের নীচে 

কে বসে আছে তা নিয়ে মাথা ঘামাব না। 

নতুন ঘরে থাকতে এলাম। বাবা আবার ঘরের দরজায় লাল ফিতা দিয়ে রেখেছেন। ফিতা কেটে ঢুকতে হবে। গৃহপ্রবেশের মত ঘর-প্রবেশ অনুষ্ঠান। 

বাবা বললেন, এস. এস. সি তে তুমি খুব ভাল রেজাল্ট করেছ বলে এই কম্পিউটার। 

আমি বললাম, থ্যাংক য়ু। 

নতুন যুগের কম্পিউটার খুব পাওয়ারফুল। টু গিগা বাইট মেমােরী। এই কম্পিউটার দিয়ে তুমি অনেক কিছু করতে পারবে। 

অনেক কিছু মানে কি? 

কম্পিউটার গ্রাফিকস করা যাবে। এনিমেশন করা যাবে। ইচ্ছে করলে ডিজনীর মত – “লিটল মারমেইড” জাতীয় কার্টুন ছবিও বানিয়ে ফেলতে পার। তােমার যা বুদ্ধি, ভাল কম্পিউটার পেলে তুমি অনেক কিছু করতে পারবে। 

আমার যে খুব বুদ্ধি তা তুমি বুঝলে কি করে ? 

তােমার রেজাল্ট দেখে বুঝেছি । আমি তাে কল্পনাও করি নি তুমি এত ভাল রেজাল্ট করবে। 

মিসির আলি সাহেব, প্রচন্ড মানসিক যন্ত্রণা নিয়েও আমি খুব ভাল রেজাল্ট করি । কেমন ভাল জানেন ? সব পত্রিকায় আমার ছবি ছাপা হয়। আমার প্রিয় লেখক কে, প্রিয় গায়ক কে, প্রিয় খেলােয়াড় কে এইসবও ছাপা হয়। | ঐ প্রসঙ্গ থাক। কম্পিউটার প্রসঙ্গে চলে আসি। বাবা শুধু যে আমাকে কম্পিউটার কিনে দিলেন তাই না আমাকে সব কিছু শেখানাের জন্যে একজন ইন্সট্রাকটার রেখে দিলেন। ইন্ট্রাকটারের নাম হাসিবুর রহমান। লােকটা লম্বা, রােগা। ইটে চাপা পড়ে থাকা ঘাসের মত চেহারা। বয়স এই ধরুন পঁচিশ-ছাব্বিশ। দেখতে ভাল। মেয়েদের মত টানা টানা চোখ। একটা ভুল কথা বলে ফেললাম। সব মেয়েদের তাে আর টানা টানা চোখ থাকে না। 

কম্পিউটারের সব বিষয়ে হাসিবুর রহমানের জ্ঞান অসাধারণ। কিন্তু লােকটি হত দরিদ্র। তার থাকার জায়গা পর্যন্ত নেই। রাতে সে ঘুমায় একটা কম্পিউটারের দোকানে। তাকে অতি সামান্য কিছু টাকা সেই দোকান থেকে দেয়া হয়—এতে তার দু’বেলা খাওয়াও বােধ হয় না, তবে এতেই সে খুশি। এত অল্পতে কাউকে খুশি হতেও আমি দেখি নি । 

বাবা আমাদের বাড়িতে তাকে থাকতে দিলেন। আমাদের গ্যারেজে তিনটা কামরা আছে। একটা দারােয়ানের, একটা ড্রাইভারের। একটা কামরা খালি। সেই খালি কামরাটায় তাকে থাকতে দেয়া হল। সে মহা খুশি। সারাদিন ঘষামাজা করে ঘর সাজাল। আমার কাছে এসে ক্যালেন্ডার চাইল—দেয়ালে সাজাবে।। 

তার পড়াশােনা সামান্য। এস. এস. সি সেকেন্ড ডিভিশন। টাকা পয়সার অভাবে এস, এস, সি-র বেশি সে পড়তে পারে নি। কম্পিউটারের দোকানে কাজ নিয়েছে। নিজের আগ্রহে কম্পিউটার শিখেছে। 

ভদ্রলােককে আমার কয়েকটি কারণে পছন্দ হল। প্রথম কারণ তিনি আমাকে অত্যন্ত সম্মান করেন। আমাকে দেখা মাত্র লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ান। দ্বিতীয় কারণ আমার প্রতিটি কথা তিনি বিশ্বাস করেন। 

যেহেতু তিনি আমাকে কম্পিউটার শেখাতে এসেছেন প্রথম দিনই আমি তাকে স্যার ডাকলাম। তিনি খুবই লজ্জা পেয়ে বললেন, ম্যাডাম আপনি আমাকে স্যার ডাকবেন না। আমার খুবই লজ্জা লাগছে। 

আপনাকে তাহলে কি ডাকব? নাম ধরে ডাকবেন। আমার নাম হাসিব। 

আপনাকে হাসিব ডাকব ? জি। আচ্ছা বেশ তাই ডাকব।। 

আমি সহজ ভাবেই তাকে হাসিব ডাকা শুরু করলাম। ভদ্রলােক আমার কম্পিউটারের টিচার হলেও তার সঙ্গে আমার কথা বার্তার ধরন ছিল মুনিব-কন্যা এবং কর্মচারীর মত। আমার তাতে কোনও অসুবিধা হচ্ছিল না। ওনারও হচ্ছিল

স্যার ডাকলেই হয়ত অনেক বেশি অসুবিধা হত। 

কম্পিউটারের নানান বিষয় আমি খুব আগ্রহ নিয়ে শিখতে লাগলাম। উনিও খুব আগ্রহ নিয়ে শেখাতে লাগলেন। বুদ্ধিমতি আগ্রহী ছাত্রীকে শেখানাের মধ্যেও আনন্দ আছে। সেই আনন্দ তার চোখে মুখে ফুটে উঠত। রাত জেগে জেগে তার সঙ্গে আমি 3D STUDIO এবং MICRO MEDIA DIRECTOR এই দুটি প্রােগ্রাম শিখছি। একটা সফটওয়ার তৈরি করছি। যে সফটওয়ারে কম্পিউটারের পর্দায় শরিফা এসে উপস্থিত হবে। তাকে প্রশ্ন করলে সে প্রশ্নের জবাব দেবে। সহজ প্রশ্ন কিন্তু অদ্ভুত জবাব। যেমন, 

প্রশ্ন : আপনার নাম? উত্তর : আমার কোনও নাম নেই, আমি হচ্ছি ছায়াময়ী। ছায়াদের কি নাম 

থাকে ? 

প্রশ্ন : আপনার পরিচয় কি? 

উত্তর : আমার কোনও পরিচয়ও নেই। পরিচয় মানেই তাে ব্যাখ্যা ও বর্ণনা। আমাকে ব্যাখ্যা ও বর্ণনায় ধরা যাবে না। 

পর্দায় প্রশ্নের উত্তরগুলি লেখা হবে না। পর্দায় ভাসবে শরিফার বিচিত্র সব ছবি এবং উত্তরগুলি ধাতবকণ্ঠে শােনা যাবে। 

হাসিব একদিন জিজ্ঞেস করলেন (খুব ভয়ে ভয়ে। আমাকে যে কোনও প্রশ্নই খুব ভয়ে ভয়ে করেন। ভাবটা এ রকম যেন প্রশ্ন শুনলেই আমি রেগে যাব)

শরিফা কে ? আমি বললাম শরিফা একটি মৃতা মেয়ে। ও আচ্ছা। আপনি কি ভূত বিশ্বাস করেন? জ্বি করি। করব না কেন? ভূত দেখেছেন কখনও? জি না। 

আপনি যদি শরিফাকে দেখতে চান আমি তাকে দেখাতে পারি। ওর সঙ্গে আমার ভাল পরিচয় আছে। আমি বললেই সে আসবে। 

জ্বি না দেখতে চাই না। আমি খুব ভীতু। আমি ডাকলেই শরিফা চলে আসবে আপনি এটা বিশ্বাস করলেন ? 

বিশ্বাস করব না কেন? আপনি তাে আর শুধু শুধু মিথ্যা কথা বলবেন না। আপনি সেই ধরনের মেয়ে না । 

আমি কোন ধরনের মেয়ে ? খুব ভাল মেয়ে।। 

আপনি কম্পিউটারের মত আধুনিক জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, আবার ভূতও বিশ্বাস করেন ? 

জ্বি ভূত বিশ্বাস করি, জ্বীনও বিশ্বাস করি। কোরান শরীফে জ্বীনের কথা আছে। একটা সূরা আছে— সূরার নাম হল – সুরায়ে জ্বীন। 

তাই বুঝি ? 

আপনি আমাকে একটা ভুতের গল্প বলুন তাে। ম্যাডাম আমি ভুতের গল্প জানি না। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *