তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(১১) হুমায়ূন আহমেদ

আমার বাবাকে নিশ্চয়ই এইসব ঝামেলার মুখােমুখি হতে হয়েছে। কিছুদিন তাঁকে খুব চিন্তিত দেখেছি। তারপর এক সময় তিনি চিন্তামুক্ত হয়েছেন। বিত্তবানরা খুব সহজেই চিন্তামুক্ত হতে পারেন। তাদের সামান্য অর্থ ব্যয় হয়– এই যা।

তন্দ্রাবিলাসশরিফার বাবাকে কিছু টাকা দেয়া হল— কত আমি জানি না। নিশ্চয়ই সে যত আশা করেছিল তারচে বেশি। কারণ সেই বেচারা টাকা হাতে নিয়ে আমাদের সবার মঙ্গল কামনা করে দীর্ঘ মােনাজাত শুরু করল। মােনাজাতের বিষয় বস্তু হচ্ছে -আমাদের মত ভালমানুষ সে তার জীবনে দেখেনি। আমাদের কাছে তার মেয়ে খুব সুখে ছিল। কপালে সুখ সইল না। 

শরিফার স্বামীও বেশ কিছুদিন ঘােরাঘুরি করল। বেচারার দাবী সামান্য। যে সাইকেলটা তার জন্যে কেনা হয়েছিল সেই সাইকেল যেন তাকে দিয়ে দেয়া হয়। সম্ভব হলে পাঁচ হাজার এক টাকা। এই টাকাটা তাে আইনত তারই প্রাপ্য— ইত্যাদি। 

আন্টি তাকে ভাগিয়ে দিলেন এবং বলে দিলেন— কখনও যেন তাকে গেটের ভেতর ঢুকতে না দেয়া হয়। 

তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(১১) হুমায়ূন আহমেদ

সব ঝামেলা মিটে যাবার পর বাবা এক সন্ধ্যায় আমাকে ডাকলেন। বাবার পরিচয় আপনাকে দেয়া হয়নি এখন দিচ্ছি। তিনি মােটামুটি কঠিন ধরনের মানুষ। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। শান্ত ধীর, স্থির। তিনি খুব রেগে গেলেও সহজ ভঙ্গিতে কথা বলতে পারেন। পেশায় তিনি পাইলট। সিঙ্গাপুর এয়ার লাইন্সের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে আছেন। আমার সব সময় মনে হয়েছে পাইলট না হয়ে বাবা যদি ইউনিভার্সিটির অংকের 

টিচার হতেন তাঁকে খুব মানাত। বই পড়া তাঁর প্রধান শখ। বেশির ভাগ সময় আমি 

তাঁর হাতে বই দেখেছি। হাল্কা ধরনের বই না—বেশ সিরিয়াস ধরনের বই। 

বাবা তাঁর স্টাডিতে একা বসেছিলেন। তাঁর সামনে একটা বাটিতে খেজুর গুড় টুকরাে করা। শীতকালে খেজুর গুড় তাঁর প্রিয় একটা খাবার। প্রায়ই দেখেছি গল্পের বই পড়তে পড়তে তিনি খেজুর গুড়ের টুকরাে মুখে দিচ্ছেন। আমি ঘরে ঢুকতেই বাবা বললেন— মা বস। 

আমি তার সামনে বসলাম। কেমন আছ মা? আমি বললাম, ভাল । শরিফা মেয়েটি এইভাবে মারা গেল নিশ্চয়ই তােমার মন খুব খারাপ? আমি বললাম, হ্যা মন খারাপ। 

বাবা ইতস্তত করে বললেন, তােমাকে কিন্তু কান্নাকাটি করতে দেখিনি। আমার কাছে তােমাকে বেশ স্বাভাবিকই মনে হয়েছে। 

আমি বুঝতে পারলাম না বাবা ঠিক কি বলতে চাচ্ছেন। তাঁর কথা বলার মধ্যে জেরা করার ভাবটা প্রবল। যেন আমি কিছু গােপন করার চেষ্টা করছি বাবা তা বের করে ফেলতে চাচ্ছেন। 

শরিফা যে সন্ধ্যায় মারা গেল—সেই সন্ধ্যায় তুমি কি ছাদে গিয়েছিলে ? 

সেদিন ছাদে যাওনি ? না। 

আমি যতদূর জানি—ছাদ তােমার খুব প্রিয় জায়গা। বেছে বেছে ঐ দিনই ছাদে যাও নি কেন? 

ঐ দিন যেতে ইচ্ছে করেনি। 

তুমি ঘরের দরজা বন্ধ করে চিৎকার করে কাঁদছিলে। দরজা ভেঙে তােমাকে বের করা হয়। তুমি প্রথম যে কথাটি তখন বল তা হচ্ছে শরিফা মারা গেছে। তাই 

হ্যা! 

সে যে মারা গেছে তােমার তাে জানার কথা না। কারণ কেউই জানে না । তুমি জানলে কিভাবে ? | আমি চুপ করে রইলাম। বাবা বাটিটা আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন- নাও গুড় খাও। আমি এক টুকরাে গুড় নিয়ে মুখে দিলাম। বাবা শান্ত 

গলায় বললেন, তুমি রাগ করে, কিংবা নিজের অজান্তে ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দাও নি তাে? 

অনেক সময় খেলতে গিয়েও এরকম হয়। হয়ত হাসতে হাসতে ধাক্কা দিয়েছ—সে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেছে। তােমার কোনও দোষ ছিল না।

তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(১১) হুমায়ূন আহমেদ

 আচ্ছা ঠিক আছে। তােমার পড়াশােনা কেমন হচ্ছে? ভাল। গান কেমন হচ্ছে? ভাল।। এবারের গানের টিচার কেমন ? ভাল। গান কি তুলেছ না এখনও সারে গামা করে যাচ্ছ ? একটা গান তুলেছি। কি গান? নজরুল গীতি। গানের লাইনগুলি কি? পথ চলিতে যদি চকিতে—গাইব? 

থাক। আরেকদিন শুনব। আমি কি এখন চলে যাব ? আচ্ছা যাও |আমি উঠে চলে এলাম। বাবা ভুরু কুঁচকে বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগলেন। তিনি আমাকে বিশ্বাস করেন নি এটা বােঝা যাচ্ছে। তিনি যে আমাকে নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন তাও বুঝতে পারছি। খুব অল্প বয়েসেই আমি আসলে বেশি বেশি বুঝতে শিখেছিলাম। বেশি বুঝতে পারাটা এক ধরনের দুভার্গ্য। যারা কম বুঝতে পারে—এই পৃথিবীতে তারাই সবচে সুখি। বােকা মানুষরা কখনও আত্মহত্যা করে। 

বাবা আমার কথা বিশ্বাস না করলেও আন্টি করলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে। নিজ থেকে তাঁকে আমার কিছু বলতে হল না। তিনি আপনাতেই সব বুঝতে পারলেন। ঘটনাটা এরকম— রাতে তিনি আমার সঙ্গে ঘুমুতে এসেছেন (শরিফার মৃত্যুর পর তিনি প্রতি রাতেই আমার সঙ্গে ঘুমুতেন।) বাতি নিভিয়ে আমাকে জড়িয়ে 

ধরে মৃদু গলায় গল্প শুরু করলেন তাদের গ্রামের বাড়ির গল্প। বাড়ির পেছনে একটা পেয়ারা গাছ ছিল। তিনি পাকা পেয়ারার খোঁজে গাছে উঠেছেন। হঠাৎ দেখলেন গাছের ডাল পেঁচিয়ে একটা সাপ। সাপটার গায়ের রঙ অবিকল পেয়ারা গাছের ডালের মত। সাপটা তাঁকে দেখে পালিয়ে গেল না—উল্টো তাঁর দিকে আসতে শুরু করল 

এই পর্যায়ে আন্টি গল্প থামিয়ে দিলেন। আমি বললাম, কি হয়েছে? আন্টি বললেন, ফোপাচ্ছে কে? আমি ফেঁপানির শব্দ শুনছি। তুমি কি শুনছ? 

তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(১১) হুমায়ূন আহমেদ

শব্দ আমিও শুনছিলাম। ফোঁপাচ্ছে শরিফা। খাটের নীচে বসে মাঝে মধ্যেই সে ফেঁাপানির মত শব্দ করে। আমি আন্টির প্রশ্নের জবাব দিলাম না। চুপ করে রইলাম ।আন্টি বললেন, মনে হচ্ছে খাটের নীচে কেউ বসে আছে। ফেঁাপাচ্ছে। তুমি শুনতে পাচ্ছ না? 

আমি পরিষ্কার শুনছি পচা গন্ধও পাচ্ছি? তুমি গন্ধ পাচ্ছ না? 

আন্টি উঠে বসলেন। টেবিল ল্যাম্প জ্বালালেন। বিছানা থেকে নেমে তাকালেন খাটের নীচে। আমি তাকিয়ে রইলাম আন্টির মুখের দিকে। আমি দেখলাম ভয়ে এবং আতঙ্কে হঠাৎ আন্টির মুখ ছােট হয়ে গেল। তিনি বিড় বিড় করে কি যেন বললেন। কি বললেন, আমি বুঝতে পারলাম না। আন্টি ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছিলেন। তার ফর্সা গাল হয়েছে টক টকে লাল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আন্টিকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। আন্টি চাপা গলায় বললেন— কে কে ? 

আম্মা আমি শরিফা। শরিফা ! জে আম্মা। আমি এইখানে থাকি। শরিফা! 

জে আম্মা। আমি হাঁটা চলা করতে পারি না – এইখানে থাকি। আমারে বিদায় দিয়েন না আম্মা। আমার যাওনের জায়গা নাই । 

আন্টি উঠে দাঁড়ালেন। টলতে টলতে খাটের কাছে এসে খাটে উঠলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে তৎক্ষণাৎ শুয়ে পড়লেন। আমি বললাম, কি হয়েছে ? 

আন্টি জড়ান গলায় বললেন, কিছু না। তুমি ঘুমাও। আমি বললাম, খাটের নীচে কিছু দেখেছেন আন্টি ? তিনি বললেন, না। তুমি ঘুমাও। আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম। আন্টি 

সম্ভবত সারা রাতই জেগে রইলেন। পরদিন ভােরে জেগে উঠে দেখি আন্টি হাটু মুড়ে বসে আছেন। ঘরে তখনও টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। আন্টির চোখ জ্বল জ্বল করছে। এক রাতেই তার চোখের নীচে গাঢ় হয়ে কালি পড়েছে। আন্টি ক্লান্ত গলায় বললেন, ফারজানা তুমি কি রান্নাঘরে গিয়ে বলে আসবে আমাকে এক কাপ চা দিতে ? 

আমি বললাম, আন্টি আপনার কি শরীর খারাপ করেছে? তিনি বললেন, । শরীর ভাল আছে।আন্টি বিছানায় বসে চা খেলেন। তাঁকে খুব চিন্তিত মনে হল। আমাকেঅবশ্যি তিনি কিছুই বললেন না। আমি সহজ স্বাভাবিক ভাবেই হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা করলাম। স্কুলে চলে গেলাম। আন্টি সারাদিন আমার ঘরেই থাকলেন। ঘর থেকে বেরুলেন 

না।

তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(১১) হুমায়ূন আহমেদ

বাবা সে সময় দেশে ছিলেন না। বছরে একবার পাইলটদের নতুন করে কি সব শেখায়। রিভিয়ু হয়। বাবা সেই ট্রেনিং -এ তখন আমস্টারডামে। বাড়িতে আমি আর আন্টি। আন্টি আমার ঘরেই থাকেন। তিনি রাতে একেবারেই ঘুমান না। আমার কিন্তু ঘুম পায়। আগের অনিদ্রা রােগ তখন সেরে গেছে। বিছানায় যাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ি। মাঝে মাঝে বাথরুম পেলে কিংবা পানির পিপাসা পেলে ঘুম ভাঙ্গে। আমি দেখি আন্টি মেঝেতে বসে আছেন। তার বসার ভঙ্গি শরিফার বসার ভঙ্গির মতই। তিনি মৃদু স্বরে শরিফার সঙ্গে কথা বলেন। 

শরিফা! জি আম্মা? কি করছ ? কিছু করনের নাই আম্মা। বইসা আছি। এখান থেকে চলে যাও। কই যামু? যাওনের জায়গা নাই। পথঘাটও চিনি না। চাও কি তুমি ? কিছু চাই না। কি চামু? দিনের বেলা তােমাকে দেখি না কেন ? দিনে তুমি কোথায় যাও? জানি না আম্মা। কি হইতেছে আমি কিছুই বুঝি না। দিশা পাই না। তােমার ক্ষিধা হয় ? 

জে হয়। জবর ভূখ লাগে কিন্তু আম্মা খাওন নাই। আমারে কে খাওন দিব? 

এখন ক্ষিধে হয়েছে ? 

জ্বে হয়েছে। বিস্কুট আছে খাবে ? বিস্কুট দেব? 

জ্বে না। আফনাগাে খাওন আমি খাইতে পারি না। তুমি কি খুব কষ্টে আছ ? বুঝি না আম্মা। কিচ্ছু বুঝি না। দিশা পাই না। তুমি যে মারা গেছ তা কি জান? জ্বে জানি। কেউ কি তােমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে ? 

কে ফেলেছে ? 

ছােট আফা ফেলছে। ছােট মানুষ বুঝে নাই। তার ওপরে রাগ হইয়েন না আম্মা।

ফারজানা তােমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে? 

তুমি কি তাকে দেখেছ ধাক্কা দিয়ে ফেলতে? জ্বে না। পিছন থাইক্যা ধাক্কা দিছে। অন্য কেউও হইতে পারে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *