তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(১৫) হুমায়ূন আহমেদ

আমি Yes লেখা কাগজটা তুললাম। এবং এমন ভাব করলাম যে লজ্জায় দুঃখে আমায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে। আমার চোখে পানি চলে এল। আমি এমন ভাব করছি যেন চোখের জল সামলাতে আমার কষ্ট হচ্ছে। এক সময় হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললাম।

তন্দ্রাবিলাসবিদেশীরা চোখের পানি কম দেখে বলে চোখের পানিকে তারা খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখে | বাঙালী মেয়েরা যে অতি সহজে চোখের পানি নিয়ে আসতে পারে এই তথ্য তারা জানে না। তা ছাড়া আমি যে কত বড় অভিনেত্রী তাও তিনি জানেন না। তিনি ছুটে গিয়ে টিস্যু পেপার নিয়ে এলেন। নিজেই চোখ মুছিয়ে দিলেন। করুণা বিগলিত গলায় বললেন, শােন মেয়ে তােমার লজ্জিত বা দুঃখিত হবার কিছু নেই। আমেরিকান স্ট্যাটিসটিকস বলছে শতকরা ২৮ ৬০ ভাগ আমেরিকান পুত্র কন্যারা তাদের বাবাকে ঘৃণা করে। তুমি আমাকে যা বলেছ তােমার বাবা তা কোনও দিন জানবেন না। এই বিষয়ে তােমাকে আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি। এখন একটু শান্ত হও | কফি খাবে ? 

আমি ফেঁপাতে ফেঁপাতে বললাম, খাব। 

আমরা কফি খেলাম। ভদ্রমহিলা আনন্দিত গলায় বললেন— আমার ধারণা তােমার সমস্যা আমি ধরতে পারছি। সেই সমস্যার সমাধান করা এখন আর কঠিন হবে না। অবশ্যি তুমি যদি আমাকে সাহায্য কর। তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে ? 

ভেরী গুড। আমরা দুজনে মিলে তােমার সমস্যা সমাধান করব । কেমন ? আচ্ছা।। তােমার বাবাকে তুমি কেন ঘৃণা কর ? বাবা মদ খায়। 

শুধু মদ্যপান করে বলেই ঘৃণা কর ? 

মাতাল হয়ে তিনি একদিন গাড়ি চালাচ্ছিলেন তখন অ্যাকসিডেন্ট হয়। সেই অ্যাকসিডেন্টে আমার মা মারা যান। 

তােমার বাবা আমাকে তােমার মা’র মৃত্যুর কথা বলেছেন। কিন্তু কি ভাবে মারা গেছেন তা বলেন নি। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। 

জেন ওয়ারেন সিগারেট ধরালেন। তিনি বেশ কায়দা করে সিগারেট টানছেন। নিশি, সিগারেটের ধোয়ায় তােমার অসুবিধা হচ্ছে না তাে? জ্বি না। 

আমি সিগরেট ছাড়ার চেষ্টা করছি পারছি না। যে কোনও ভাল অভ্যাস সামান্য চেষ্টাতেই ছেড়ে দেয়া যায় – খারাপ অভ্যাস হাজার চেষ্টাতেও ছাড়া যায়

ঠিক না ? 

ঠিক। এখন বল তুমি না কি তােমার মাকে দেখতে পাও এটা কি সত্যি? 

সত্যি না। তাহলে বল এই মিথ্যা কথাটা কেন বলতে? বাবাকে ভয় দেখাবার জন্যে বলতাম। 

বাবাকে ভয় দেখানাের জন্যে তুমি তাহলে বানিয়ে বানিয়ে অনেক কথাই বলেছ ? 

যা বলেছ তােমার বাবা তাই বিশ্বাস করেছেন ? জ্বি। 

আচ্ছা আজকের মত তােমার সঙ্গে আমার কথা শেষ। কাল আবারও আমরা বসব। কেমন ? 

জি আচ্ছা। মেরীল্যান্ডে দেখার মত সুন্দর সুন্দর জিনিস অনেক আছে। তুমি কি দেখেছ? জ্বি না। কাল আমি তােমাকে লিস্ট করে দেব। দেশে যাবার আগে তুমি দেখে যাবে। আচ্ছা। তুমি কি জান যে তুমি খুব ভাল মেয়ে? জানি। ভদ্রমহিলা আমার সঙ্গে আরও তিন দিন সিটিং দিলেন। আমি তাকে १ 

পুরােপুরি বিভ্রান্ত করলাম। তাকে যা বিশ্বাস করাতে চাইলাম তিনি তাই বিশ্বাস করলেন এবং খুব আনন্দিত হলেন এই ভেবে যে তিনি বিদেশীনি এক কিশােরী মেয়ের জীবনের সমস্ত জটিলতা দূর করে ফেলেছেন। তাঁর অন্ধকার ঘরে এক হাজার ওয়াটের বাতি জ্বেলে দিয়েছেন। 

আমার সম্পর্কে তিনি যা ধারণা করলেন তা হচ্ছে 

১) আমি খুব ভাল একটা মেয়ে, সরল, বুদ্ধি কম, জগতের জটিলতা কিছু জানি না।। 

(খুব ভুল ধারণা।) | ২) আমি নিঃসঙ্গ একটি মেয়ে। আমার সবচে বড় শত্রু আমার নিঃসঙ্গতা। (ভুল ধারণা। আমি নিঃসঙ্গ নই। আমি কখনও একা থাকি না। নিজের বন্ধু বান্ধব নিজে কল্পনা করে নেই। কল্পনাশক্তি সম্পন্ন মানুষ কখনও নিঃসঙ্গ হতে 

পারে না)। 

৩) আমি খুব ভীতু ধরনের মেয়ে। 

(আবারও ভুল। আমার মধ্যে আর যাই থাকুক ভয় নেই। যখন আমার সাত আট বৎসর বয়স তখনও রাতে ঘুম না এলে আমি একা একা ছাদে চলে যেতাম। 

৪) বাবাকে আমি অসম্ভব ঘৃণা করি। 

(খুব ভুল কথা। বাবা চমৎকার মানুষ। আমার ক্ষুদ্র জীবনে যে ক’জন ভাল মানুষ দেখেছি তিনি তাদের একজন।) 

আমি ভদ্রমহিলার মাথায় এইসব ভুল ঢুকিয়ে দিয়েছি। তিনি খুশি মনে ভুল গুলি গ্রহণ করেছেন। 

মানুষ কি অদ্ভুত দেখেছেন? মানুষ কত সহজেই না ‘ভুল’ – সত্যি ভেবে গ্রহণ করে। 

আমেরিকান মহিলা মনস্তত্ববিদ বাবাকে কি বলেছিলেন আমি জানি না। বাবাকে আমি জিজ্ঞেস করি নি। তবে অনুমান করতে পারি যে তিনি বাবাকে কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন। বাবা দেশে ফিরেই সেই উপদেশ মত চলতে শুরু করলেন। প্রথমেই আমার শােবার ঘর বদলে দিলেন। তিনি হয়ত ভেবেছিলেন শােবার ঘর বদলানাের ব্যাপারে আমি খুব আপত্তি করব। নানান ভণিতা করে তিনি বললেন – – মা তােমার এই ঘরটা খুব ছােট। তুমি বড় হয়েছ তােমার আরও বড় ঘর দরকার। তা ছাড়া আমি ভাবছি তােমাকে একটা কম্পিউটার কিনে দেব কম্পিউটার টেবিল সেট করার জন্যেও জায়গা লাগবে

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *