তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(২) হুমায়ূন আহমেদ

জি রােজ আমার সঙ্গে কথা বলবে ? 

সে কি, কেন? 

সায়রা বানু খুব সহজ ভঙ্গিতে হাই তুলতে তুলতে বলল, এক বাড়িতে থাকতে হলে কথা বলতে হবে না ? 

এক বাড়িতে থাকবে মানে? আমি বুঝতে পারছি না। 

আমি আপনার সঙ্গে কয়েকটা দিন থাকব। ক’দিন এখনও বলতে পারছি । দুদিনও হতে পারে আবার দুমাসও হতে পারে। আবার দু’বছরও হতে পারে। সম্পূর্ণ নির্ভর করছে আপনার উপর।তন্দ্রাবিলাসমিসির আলি চেয়ার থেকে পা নামিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকালেন। হচ্ছেটা কি? এই যুগের টিনএজার মেয়েদের ভাব ভঙ্গি, কান্ড কারখানা বােঝা মুশকিল। তারা যে কোন উদ্ভট কিছু হাসি মুখে করে ফেলতে পারে। মেয়েটি হয়ত অতি তুচ্ছ কারণে রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছে। কিংবা তাকে ভড়কে দেবার জন্যে গল্প ফেঁদেছে। পরে কলেজে বন্ধুদের কাছে এই গল্প করবে । বন্ধুরা মজা পেয়ে একে অন্যের গায়ে হেসে গড়িয়ে পড়বে। – ও মাগাে বুড়ােটাকে 

কি বােকা বানিয়েছি ! সে বিশ্বাস করে ফেলেছিল যে আমি থাকতে এসেছে। 

 মিসির আলি নিজের বিস্ময় গােপন করে সহজ ভাবে বললেন, তুমি এ বাড়িতে থাকবে ? 

বিছানা বালিশ নিয়ে এসেছ? 

বিছানা বালিশ আনিনি। আজকাল তাে আর বিছানা বালিশ নিয়ে কেউ অন্যের বাড়িতে থাকতে যায় না। শুধু একটা স্যুটকেস আর হ্যান্ডব্যাগ এনেছি। আর একটা পানির বােতল। 

তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(২) হুমায়ূন আহমেদ

স্যুটকেস আর হ্যান্ডব্যাগ কোথায় ? 

বারান্দায় রেখে এসেছি। শুরুতেই আপনি আমার স্যুটকেস দেখে ফেললে ঢুকতে দিতেন না। যাই হােক আমি এখন আমার স্যুটকেস আর হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে আসছি। আচ্ছা আপনি এমন ভাব করছেন যেন আকাশ থেকে পড়েছেন। আকাশ থেকে পড়ার মত কিছু হয় নি। বিপদগ্রস্ত একজন তরুণীকে কয়েক দিনের জন্যে আশ্রয় দেয়া এমন কোনও বড় অন্যায় না। আমি নিশ্চিত এরচে অনেক বড় বড় অন্যায় আপনি করেছেন। 

তুমি সত্যি সত্যি আমার এখানে থাকার পরিকল্পনা নিয়ে এসেছ ? 

মিসির আলি তাকিয়ে রইলেন। এই মুহূর্তে তাঁর ঠিক কি করা উচিত তা মাথায় আসছে না। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে মেয়েটির কান্ডকারখানা দেখাই মনে হয় সবচে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। মেয়েটি বুদ্ধিমতি। এই পরিস্থিতিতে তিনি কি করবেন বা করতে পারেন সেই সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা সে নিশ্চয়ই করেছে। নিজেকে সম্ভাব্য সব রকম পরিস্থিতির জন্যে সে প্রস্তুত করে রেখেছে। মিসির আলির এমন কিছু করতে হবে যার সম্পর্কে মেয়েটির প্রস্তুতি নেই। সে কেন বাড়ি ছেড়ে এসেছে এই মুহুর্তে তা তাকে জিজ্ঞেস করা যাবে না। কারণ এই প্রশ্নটি স্বাভাবিক এবং সংগত প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর মেয়েটি তৈরি করে রেখেছে। তাঁর বিস্মিত হওয়াও ঠিক হবে

তাঁকে খুব সহজ এবং স্বাভাবিক থাকতে হবে। যেন এমন ঘটনা প্রতি সপ্তাহেই দুইটা একটা করে ঘটছে। | সায়রা বানু স্যুটকেস, হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে ঘরে ঢুকল। মিসির আলি বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলেন সে গুন গুন করে কি একটা গানের সুরও যেন ভাজছে। কত সহজ স্বাভাবিক তার আচরণ। 

তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(২) হুমায়ূন আহমেদ

কেক খাবেন? 

কেক? 

ঠু। আমার নিজের বেক করা, ডিমের পরিমাণ বেশি হয়েছে বলে একটু ডিম ডিম গন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে ডিমের গন্ধ একেবারে সহ্য করতে পারে না। আমার 

কাছে অবশ্যি খারাপ লাগে না। দেব আপনাকে এক পিস কেক ? 

আপনাকে একটু বাজারে যেতে হবে, কয়েকটা জিনিস কিনতে হবে। আমি অতি দ্রুত চলে এসেছি তাে কাজেই অনেক প্রয়ােজনীয় জিনিস আনা হয়নি। টুথপেস্ট এনেছি, টুথব্রাশ আনিনি। আমার অভ্যাস হচ্ছে রাতে শােবার সময় কুট কুট করে কয়েকটা লবঙ্গ খাওয়া । লবঙ্গ খেলে শরীরের রক্ত পরিস্কার থাকে, কখনও হার্টের অসুখ হয় না। সেই লবঙ্গ আনা হয়নি। আপনাকে লবঙ্গ আনতে হবে। পারবেন? আমি আপনাকে টাকা দিয়ে দেব। আমি সঙ্গে করে অনেক টাকা নিয়ে এসেছি। বলুন তাে কত এনেছি। 

বলতে পারছি না। 

অনুমান করুন। আপনি হচ্ছেন বিখ্যাত মিসির আলি। আপনার অনুমান হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অনুমান। বলুন আমার সঙ্গে কত টাকা আছে ? 

পাঁচ হাজার টাকা। 

হয়নি। আমার সঙ্গে আছে মােট একান্ন হাজার টাকা। পাঁচশ টাকার একটা বান্ডিল এনেছি আর এনেছি দশ টাকার একটা বান্ডিল। সেখান থেকে কিছু খরচ করেছি। বেবী টেক্সি ভাড়া দিয়েছি তিরিশ টাকা। ঠিক এই মুহূর্তে আমার কাছে আছে। পঞ্চাশ হাজার নয়শ সত্তর টাকা। আপনাকে টুকটাক বাজারের জন্যে পাঁচশ টাকা দিচ্ছি, যা লাগে খরচ করবেন বাকিটা ফেরত দেবেন। এই নিন। 

সায়রা বানু তার কাঁধে ঝুলান কালাে ব্যাগ খুলে টাকা বের করল। মিসির আলি টাকাটা নিলেন। মেয়েটি এক ধরনের খেলা শুরু করেছে। মিসির আলির মনে হল মেয়েটিকে সেই খেলা তার মতই খেলতে দেয়া উচিত। এই মুহূর্তে এমন কিছু করা ঠিক হবে না যাতে খেলা বাধাগ্রস্ত হয়। তিনি মেয়েটিকে আগ্রহ নিয়ে দেখতে শুরু করেছেন তার তাকানাের ভঙ্গি, হাঁটার ভঙ্গি, বসার ভঙ্গি। আপাত দৃষ্টিতে এইসব খুবই ছােট খাট ব্যাপার থেকে অনেক কিছু জানা যায়। 

তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(২) হুমায়ূন আহমেদ

সায়রা বানু চেয়ারে বসতে বসতে বলল, আমার খাওয়া নিয়ে আপনি মােটেই চিন্তা করবেন না। যা খাওয়াবেন আমি তাই খাব। শুধু মাছ ছাড়া। মাছ আমি খেতে পারি না—গন্ধ লাগে। অবশ্যি চিংড়ি মাছ খাই। চিংড়ি মাছ কেন খাই বলুন তাে? 

বলতে পারছি না। 

চিংড়ি মাছ খাই কারণ চিংড়ি মাছ হচ্ছে আসলে এক ধরনের পােকা। পােকা বলেই চিংড়ি মাছে আশটে গন্ধ নেই। ও আচ্ছা বলতে ভুলে গেছি। আরেকটা জিনিস খুব পছন্দ করে খাই। ইলিশ মাছের ডিম।। 

মাছের ডিমেরও তাে আশটে গন্ধ থাকে। ইলিশ মাছের ডিমে থাকে না। আপনি কেভিয়ার খেয়েছেন? না। 

কেভিয়ার হচ্ছে পৃথিবীর সবচে দামি খাবার। কালাে রঙের মাছের ডিম। স্বাদ কি রকম জানেন ? 

যেহেতু খাইনি স্বাদ কেমন তা তাে জানার কথা না। 

স্বাদ কেমন আপনি জানেন। অনেকটা আমাদের শিং মাছের ডিমের মত। তবে আশটে গন্ধ অনেক বেশি। নাক চেপে ধরে আমি একবার খানিকটা খেয়েছিলাম তারপর বমি টমি করে একাকার।। 

তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(২) হুমায়ূন আহমেদ

মিসির আলি পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেট বের করলেন। সঙ্গে দেয়াশলাই নেই। দেয়াশলাইয়ের খোজে রান্নাঘরে যেতে হবে। চেয়ার ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না। মেয়েটাকে কি বলবেন দেয়াশলাই এনে দিতে ? মিসির আলিকে কিছু বলতে হল না। তার আগেই সায়রা বানু বলল, আপনার লাইটার লাগবে ? 

আছে তােমার কাছে ? আছে। আপনি সিগারেট মুখে দিন আমি ধরিয়ে দিচ্ছি। 

মেয়েটা যে ভঙ্গিতে লাইটার ধরাল তাতে মনে হল সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে তার অভ্যাস আছে। সে নিজে সিগারেট খায় না তাে? না খায় না, সিগারেটের ধোয়ায় সে নাক কুঁচকাচ্ছে। 

এই লাইটারটা আপনি রেখে দিন | লাইটারটা আমি আপনার জন্যে এনেছি। থ্যাংক য়ু। 

আর এক প্যাকেট সিগারেটও এনেছি। আপনার একটা বইয়ে পড়েছিলাম একজন কে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসতাে। যেদিনই আসতাে আপনার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আসতাে। 

মিসির আলি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, একটু আগে বলেছিলে তুমি আমার একটা বইই পড়েছ। 

মিথ্যা কথা বলেছিলাম। অনেকগুলি বই পড়েছি। সুধাকান্ত বাবুর উপর লেখা বইটা সবচে ভাল লেগেছে। ঐটা আমি পড়েছি তিনবার। না তিনবার না। আড়াইবার পড়েছি। দুবার পড়েছি পুরােটা। শেষ বার পড়েছি শুধু শেষের কুড়ি পাতা।  

ভাল। মিথ্যা কথা বললে কি আপনি রেগে যান ? 

না।। 

আমাকে কেউ মিথ্যা কথা বললে আমি অবশ্যি খুব রেগে যাই। আর আমার এমনই কপাল যে সবাই শুধু আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলে। তবে আপনি বলবেন 

সেটা আমি জানি। আপনার চেহারা দেখেই বােঝা যায় আপনি মিথ্যা কথা বলতে পারেন না। আপনি কি জানেন যারা সবসময় মিথ্যা কথা বলে তাদের চেহারায় একটা মাই ডিয়ার ভাব থাকে। 

তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(২) হুমায়ূন আহমেদ

তাই না কি? 

যেসব মেয়েকে দেখবেন খুবমায়া মায়া চেহারা, আপনি ধরেই নিতে পারেন তারা প্রচুর মিথ্যা কথা বলে।। 

এই তথ্য জানতাম না। 

আপনি মিসির আলি আর আপনি ই সাধারণ তথ্য জানেন না ? অথচ বইয়ে কত আশ্চর্য আশ্চর্য কথা যে আপনার সম্পর্কে লেখা হয়। যেমন কাউকে এক পলক দেখেই আপনি তার সম্পর্কে হড়বড় অনেক কথা বলে দিতে পারেন। আসলেই কি পারেন ? 

না। পারি না। আচ্ছা চেষ্টা করে দেখুন না। আমার সম্পর্কে বলুন। কি বলব? 

আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে। এইসব । দেখি আপনার পাওয়ার অব অবজারবেশন। 

দেখ সায়রা বানু, আমি পরীক্ষা দেই না।। পরীক্ষা ভাবছেন কেন? ভাবেন একটা খেলা। বলুন আমার সম্পর্কে বলুন। 

মিসির আলি হাতের সিগারেট ফেলে দিলেন। আরেকটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা করছে। তিনি নিজের উপর একটু বিরক্ত হচ্ছেন কারণ তাঁর টেনশান হচ্ছে। টেনশান হলেই একটা সিগারেট শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা করে। তাঁর শরীর ভাল না। এখন কিছু দিন টেনশান ফি জীবন যাপন করতে চান। অজানা অচেনা একটা মেয়ে হুট করে উপস্থিত হয়ে তাতে বাধা দিচ্ছে। 

মেয়েটি আগ্রহ নিয়ে বলল, কি হল কিছু বলছেন না কেন? মিসির আলি খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বললেন, তােমার সম্পর্কে আমার প্রথম 

তন্দ্রাবিলাস- দুই 

অবজারভেশন হচ্ছে তােমার নাম সায়রা বানু নয়।। 

এরকম মনে হবার কারণ কি? 

মনে হবার কারণ হচ্ছে সায়রা বানু যদি তােমার নাম হত তাহলে সায়রা বানু ডাকলে তুমি সহজ ভাবে রেসপন্স করতে। একটু আগে আমি বললাম, দেখ সায়রা বানু পরীক্ষা আমি দেই না। বাক্যটা আমি একবারে বলিনি। দেখ সায়রা বানু, বলে কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করেছি। যখন দেখলাম তুমি হঠাৎ চমকে উঠলে তখনি আমি বাক্যটা শেষ করলাম। তােমার চমকে ওঠার কারণ হচ্ছে সায়রা বানু বলে যে তােমাকে সম্বােধন করা হচ্ছে তা তুমি শুরুতে বুঝতে পারনি। যখন বুঝতে পেরেছ তখনই চমকে উঠেছ। তােমার নাম কি ? 

তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(২) হুমায়ূন আহমেদ

আমার নাম চিত্রা। 

তােমার সম্পর্কে আমার দ্বিতীয় অবজারভেশন হচ্ছে তােমাকে দীর্ঘ দিন একটা ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল। সেই ঘরের জানালা পর্যন্ত বন্ধ ছিল। আলােহীন একটা ঘরে দীর্ঘদিন থাকলে গায়ের চামড়া ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তােমার তাই হয়েছে। তুমি আলাের দিকে ঠিক মত তাকাতেও পারছ না । যতবার তাকাচ্ছ ততবার চোখের মণি ছােট হয়ে আসছে। ভুরু কুঁচকে যাচ্ছে। আবার জানালা থেকে তুমি চোখ ফিরিয়েও নিতে পারছ না। বার বার বিস্মিত চোখে জানালা দিয়ে তাকাচ্ছ। কারণ 

অনেকদিন পরে তুমি জানালায় খােলা আকাশ দেখছ। 

আরও কিছু বলবেন? 

দীর্ঘদিন ধরে তুমি ক্রমাগত মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছ। যে কোনও কারণেই হােক তােমাকে মিথ্যা কথা বলতে হচ্ছে। স্টোরি তৈরি করতে হচ্ছে। মিথ্যা বলাটা তােমার অভ্যাস হয়ে দাড়িয়েছে। আমি কি ঠিক বলেছি? 

হ্যা। তােমার হাত বাঁধা ছিল। মণিবন্ধে কালাে দাগ পড়ে গেছে। 

তােমার ঘ্রাণ শক্তি অতি প্রবল। তুমি কিছুক্ষণ পরপরই নাক কুঁচকাচ্ছ। এবং তাকাচ্ছ ঘরের দক্ষিণ দিকে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *