দক্ষিণ দিক থেকে নদৰ্মার দুর্গন্ধ আসছে। সেটা এত প্রবল না যে এমন ভাবে নাক কুঁচকাতে হবে। এর থেকে মনে হয়—হয় তােমার ঘ্রাণ শক্তি অত্যন্ত প্রবল আর নয়ত তােমাকে অনেক উঁচু কোনও ঘরে আটকে রাখা হয়েছে, ছ’ তলা সাত তলায় যেখানে রাস্তার নর্দমার গন্ধ পেীছে না।
চিত্রা চুপ করে রইল। সে খুব একটা বিস্মিত হল বলে মনে হল না। মিসির আলি বললেন, এখন বল তােমার ব্যাপারটা কি ?
আপনি তাে কিছু না জেনেই অনেক কিছু বলতে পারেন। আপনি নিজেই বলুন।
না আমি বলতে পারছি না। অনুমান করুন। দেখি আপনার অনুমান শক্তি আমার ঘ্রাণ শক্তির মত কি।
আমার ধারণা তুমি অসুস্থ। অসুস্থতাটা এমন যে রােগীকে ঘরে আটকে রাখতে হয়। তুমি কোন ক্রমে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে এসেছ।
আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে আমি পাগল তাই আমাকে ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল ? না আমি পাগল না। সুস্থ। ছিটে ফোটা পাগলামী যা অন্যদের মধ্যে থাকে আমার তাও নেই। তবে আমাকে ঘরে আটকা রাখা হচ্ছিল তা ঠিক। ছাব্বিশ দিন হল ঘরে তালাবন্ধ। আমাকে সবাই মিলে ঘরে তালাবন্ধ করে রেখেছে। কারণটাও খুব সাধারণ এবং আপনার মত বুড়াের কাছে হয়ত বা হাস্যকর। কারণটা বলব ?
মিসির আলি হা না কিছুই বললেন না। মেয়েটির স্বভাব যা তাতে তিনি যদি বলেন – হ্যা বল – তাহলে সে নিশ্চিত ভাবেই বলবে—না বলব না। তারচে চুপ করে থাকাই ভাল।
তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(৩) হুমায়ূন আহমেদ
ব্যাপারটা প্রেম ঘটিত। আমি একটা ছেলেকে বিয়ে করতে চাই। দরিদ্র ফালতু টাইপ ছেলে। কিছুই করে না। তার প্রেমে পড়ার কারণ নেই। তারপরেও আমি পড়ে গেছি এবং এবং .
এবং কি ? গােপনে বিয়ে করার জন্যে তার সঙ্গে পালিয়েও গিয়েছিলাম। আমাকে ধরে আনা হয়। আমি তাে খুব জেদি মেয়ে, কাজেই আমি সবাইকে বলি— আমি আবারও পালিয়ে যাব। তােমাদের কোনও সাধ্য নেই আমাকে ধরে রাখার।
ছেলেটার নাম কি? ছেলেটার নাম দিয়ে আপনার দরকার কি? কোনও দরকার নেই। কৌতুহল বলতে পার। উনার নাম ফরহাদ। শুধুই ফরহাদ ? ফরহাদ খান। তারপর ? তারপর আবার কি ? তােমার কাছ থেকে এই কথা শােনার পর তারা তােমাকে তালাবন্ধ করে
রাখল ?
তাই তাে রাখবে। যে মেয়ে এ জাতীয় কথা বলে তাকে নিশ্চয়ই কেউ কোলে করে ঘুরে বেড়াবে না। ঘুম পাড়ানি গান গাইয়ে ঘুম পাড়াবে না।
আজ তুমি ছাড়া পেয়েছ, আমার কাছে না এসে ঐ ছেলেটির কাছে চলে যাচ্ছ কেন ?
যাব তাে বটেই। আপনার কি ধারণা আমি চিরকালের জন্যে আপনার সঙ্গে থাকব ? মিসির আলি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, চিত্রা তুমি আবারও মিথ্যা কথা বলছ।
বুঝলেন কি করে?
ছেলেটার নাম কি বল জিজ্ঞেস করার পর থতমত খেয়ে গেলে। চট করে বলতে পারলে না। একটা কোনও নাম ভাবার জন্যে সময় নিলে। তারপর বললে উনার নাম ফরহাদ। উনি বললে— যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছ তার প্রসঙ্গে উনি বলবে কেন? বলবে ওর নাম ফরহাদ।
তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(৩) হুমায়ূন আহমেদ
তাহলে কি সত্যি কথা শুনতে চান ?
আমি এখন সত্যি মিথ্যা কোনও কথাই শুনতে চাই না। তুমি আমার সাহায্য চাচ্ছ। যদি সত্যি চাও আমি তােমাকে সাহায্য করি, তাহলে তােমাকে সত্যি কথা বলতে হবে। তা তুমি পারবে না। মিথ্যা বলাটা তােমার রক্তের মধ্যে ঢুকে গেছে। কিছুক্ষণ সত্যি বলার পর আবার মিথ্যা শুরু করবে।
তাতে অসুবিধা কি? যেই মুহূর্তে আমি মিথ্যা বলব আপনি ধরে ফেলবেন। আপনার তাে সেই ক্ষমতা আছে।
মিসির আলি আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন- চিত্রা শােন আমার পক্ষে তােমাকে এ বাড়িতে রাখা সম্ভব না। তােমাকে চলে যেতে হবে। এবং কিছুক্ষণের মধ্যে চলে যেতে হবে।
আমার সমস্যা আপনি সমাধান করবেন না?
মানুষের বেশির ভাগ সমস্যাই এরকম যে তা তারা নিজেরাই সমাধান করতে পারে। আমার ধারণা তােমার সমস্যার সমাধান তুমিই করতে পারবে।
আমি আপনার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলেছি বলে কি আপনি রাগ করেছেন ?
রাগ করার প্রশ্ন আসছে না। মিথ্যা কথা বলাটাকে সবাই যতবড় অন্যায় মনে করে আমি তা করি না। আমার কাছে মনে হয় মানুষের অনেক অদ্ভুত ক্ষমতার একটি হচ্ছে মিথ্যা বলার ক্ষমতা। কল্পনা শক্তি আছে বলেই সে মিথ্যা বলতে পারে।
যে মানুষ মিথ্যা বলতে পারে না সে সৃষ্টিশীল মানুষ না—রােবট টাইপ মানুষ।
আপনি কি মিথ্যা বলেন?
বলি না। মানুষ হিসেবে আমি রােবট টাইপের। শােন চিত্রা, তুমি এখন চলে যাও।
চিত্রা বিস্মিত গলায় বলল, চলে যাব ?
হ্যা চলে যাবে। আপনি আমাকে খুব অপছন্দ করেছেন তাই না? আমি তােমাকে অপছন্দও করিনি আবার পছন্দও করিনি। আমার বিষয়ে আপনার কোনও কৌতূহলও হচ্ছে না?
লােকজনের ধারণা আমার কৌতূহল খুব বেশি, আসলে তা না। আমার কৌতূহল কম। অনেক কম।
তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(৩) হুমায়ূন আহমেদ
নীল রঙের মাছিটার দিকে আপনি যতটা কৌতূহল নিয়ে তাকিয়েছেন আমার দিকে তাও তাকান নি। আমি কি মাছির চেয়েও তুচ্ছ ?
মিসির আলি চুপ করে রইলেন।
চিত্রা ক্লান্ত গলায় বলল, আচ্ছা আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু আপনি দয়া করে গম্ভীর হয়ে থাকবেন না। যাবার আগে হাসি মুখে থাকুন। আপনার হাসি মুখ দেখে যাই।
মিসির আলি হাসলেন। চিত্রা বলল, বাহ আপনার হাসি তাে সুন্দর। যারা গম্ভীর ধরনের মানুষ তাদের হাসি খুব সুন্দর হয়। এরা হঠাৎ হঠাৎ হাসে তাে এই জন্যে। আর যারা সবসময় হাসি মুখে থাকে তাদের হাসি হয় খুব বিরক্তিকর। তাদের কান্না হয় সুন্দর। আচ্ছা আমি তাহলে এখন উঠি।
চিত্রা উঠে দাঁড়াল। মেয়েটা এত সহজে চলে যেতে রাজি হবে তা মিসির আলি ভাবেন নি। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
আচ্ছা শুনুন, আমি আমার ব্যাগগুলি রেখে যাই। ব্যাগ হাতে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আশ্রয় খোঁজার তাে কোনও মানে হয় না, তাই না?
বিছানা বালিশ নিয়ে যাওয়াই তাে ভাল, সবাই ভাববে এই মেয়ের আসলেই আশ্রয় প্রয়ােজন।
আপনি কিন্তু সেরকম ভাবেন নি। আপনি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন। যাই হােক আমি জিনিস পত্র রেখে যাচ্ছি। একসময় এসে নিয়ে যাব।
আচ্ছা। আপনি আসলেই রােবট টাইপ মানুষ। যাই কেমন?
তুমি কি তােমার বাড়ির টেলিফোন নাম্বারটি দিয়ে যাবে ?
কেন ? আচ্ছা দিচ্ছি। কাগজে লিখে দিচ্ছি। নিতান্ত প্রয়ােজন না হলে টেলিফোন করবেন না। আর যদি করেন আপনি ভয়াবহ বিপদে পড়ে যাবেন। এইবার কিন্তু আমি সত্যি কথা বলছি— কি বলছি না ?
তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(৩) হুমায়ূন আহমেদ
মনে হচ্ছে বলছ।
চিত্রা তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে কাগজ নিয়ে টেলিফোন নাম্বার লিখল। ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এই নিন নাম্বার। আবারও বলছি নিতান্ত প্রয়ােজন না হলে টেলিফোন করবেন না।
নিতান্ত প্রয়ােজন বলতে তুমি কি বুঝাচ্ছ?
ধরুন আমি আপনার ঘর থেকে বের হলাম। আর হঠাৎ একটা ট্রাক এসে আমার গায়ের উপর দিয়ে চলে গেল তখন আপনি বাসায় টেলিফোন করে বলবেন চিত্রা মারা গেছে।
আচ্ছা ঠিক আছে। | চিত্রা বেশ সহজ ভঙ্গিতেই বের হল। মিসির আলি উঠে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তিনি আজ আর ঘর থেকে বের হবেন না। তিনি জানেন ঘন্টা দু একের ভেতর চিত্রা ফিরে আসবে, তার জিনিসপত্র নিয়ে যাবে। মেয়েরা তাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র কোথাও রেখে স্বস্তি পায় না। কাজেই অপেক্ষা করাই ভাল।
খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার মেয়েটি চলে যাবার পর মিসির আলির একটু মন খারাপ হয়ে গেল। পাখি উড়ে যাবার পর পাখির পালক পড়ে থাকে। মেয়েটা চলে গেছে তার পরেও কিছু যেন রেখে গেছে। স্যুটকেস এবং হ্যান্ডব্যাগ নয়, অন্য কিছু।
তন্দ্রাবিলাস-পর্ব-(৩) হুমায়ূন আহমেদ
মেয়েটির রেখে যাওয়া ৫০০ টাকার নােটটা পকেটে। টাকাটা ফেরত দিতে ভুলে গেছেন। আশ্চর্য কাণ্ড- মেয়েটি তার কালাে ব্যাগও ফেলে গেছে। তার সব টাকা তাে ঐ ব্যাগে। বেবী টেক্সি নিয়ে যদি কোথাও যায় ভাড়া দিতে পারবে না।।
মিসির আলি অস্বস্তি বােধ করছেন। মেয়েটাকে মাথা থেকে তাড়াতে পারছেন । মাছিটা এখনও টেবিলে বসে আছে। মারা গেছে নাকি ? না মারা যায়নি। কীট এবং পতঙ্গ জগতের নিয়ম হল মৃত্যুর পর উল্টো হয়ে থাকা। পিঠ থাকবে মাটিতে পা থাকবে শুন্যে। মাছির বেলাতেও নিশ্চয়ই সেই নিয়ম। মিসির আলি তার লাইব্রেরির দিকে এগুলেন— মাছি সম্পর্কে জানার জন্যে কোনও বই কি আছে লাইব্রেরিতে ? থাকার তাে কথা।।
মাছি সম্পর্কে মিসির আলি তেমন কোনও তথ্য জোগাড় করতে পারলেন । শুধু জানলেন পৃথিবীতে মােট ৮৫,০০০ প্রজাতির মাছি আছে। মৌমাছি যেমন
মাছি, ড্রাগন ফ্লাইও মাছি। সবচে ছােট মাছি প্রায় অদৃশ্য আর সবচে বড় মাছি চড়ুই পাখি সাইজের। এদের সবারই দু’জোড়া পাখা থাকে। এক জোড়া তারা ওড়ার কাজে ব্যবহার করে অন্য জোড়া ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যবহার করে। বেশির ভাগ প্রজাতির মাছিই মানুষের পরম বন্ধু–শুধু হাউস ফ্লাই নয়। এদের প্রধান কাজ অসুখ ছড়ান।