তিথি অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, গরমের মধ্যে কোট গায়ে দিয়েছেন ঘামতাে ছুটবেই।
এখন গরম তবে সিলেট শীতের জায়গা। তখন দরকার লাগবে। তাছাড়া ট্রেন ছাড়লেও শীত লাগবে।‘
তিথির বলতে ইচ্ছা করছে – নুরুজ্জামান সাহেব তাকিয়ে দেখুন একমাত্র আপনিই কোট পরে আছেন।
মারুফ যে শেষ পর্যন্ত আসবে না এটা তিথি ভাবতে পারে নি। ট্রেন ছাড়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সে আশা করে রইল সে দেখবে মারুফ ছুটতে ছুটতে আসছে। পরনে সুন্দর একটা হাওয়াই সার্টি। মাথার চুল এলােমেলাে। সে বােধহয় কখনােই চুল আঁচড়ায় না। বিয়ের পর একটা কাজ তিথি অবশ্যই করবে। মারুফের চুল আঁচড়ে দেবে।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(শেষ) হুমায়ূন আহমেদ
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। জানালার কাছে তিথি একা বসে আছে। কামরার দরজাটা খােলা। দরজা বন্ধ করলেই সে একা হয়ে যাবে। তিথি এখনাে দরজা বন্ধ করছে না। এখনাে সে আশা করে আছে দেখা যাবে হুট করে দরজা দিয়ে মারুফ টুকছে। এরকমতাে হতেই পারে।
কামরার দরজা তিথি ইচ্ছা করেই খােলা রেখেছে। তার মন বলছে মারুফ ট্রেনে উঠেছে তাকে খুঁজে পাচ্ছে না। ফার্স্টক্লাস কামরাগুলিতে সে খুঁজবে। দরজা খােলা
রাখলে সে বুঝবে কি করে তিথি এই খানেই আছে। | ট্রেনের এটেনডেন্ট উকি দিল। হাতে কম্বল এবং বালিশ। দু‘টিই বেশ পরিষ্কার। সাধারণত ট্রেনের এটেনডেন্টদের চেহারা এবং আচার আচরণ রুক্ষ ধরনের হয়ে থাকে। এর তেমন না। এর বয়স অল্প। সুন্দর চেহারা। কথা বলছে ভদ্র ও বিনীত ভঙ্গিতে।।
‘আপা রাতের খাবার খাবেন?
‘চা দেই আপা? চা খান। রাত এগারােটার পর চা বন্ধ হয়ে যাবে। ‘দিন। চা দিন। ‘দরজাটা কি বন্ধ করে দেব আপা?”
‘না। কিছুক্ষণ খােলা থাক।
ট্রেনের গতি বাড়ছে। রাতের ট্রেনগুলি কি সব সময়ই দ্রুত চলে? জোছনা আছে। ট্রেনের জানালা থেকে জোছনা মাখা প্রকৃতি দেখার মত আনন্দ আর কিইবা। হতে পারে। রাতের ট্রেনে উঠলে তিথির সব সময় মনে হয় – ট্রেনে ট্রেনে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারলে মন্দ হত না। তবে একা না। একজন পাশে দরকার। এমন একজন যাকে দেখতে ভাল লাগে। যার পাশে বসতে ভাল লাগে। যার কথা শুনতে ভাল লাগে। এমন একজন যে কথা বলতে বলতে চোখ ফিরিয়ে নিলে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে, তুমি চোখ ফিরিয়ে নিলে কেন? খবদার আর কখনাে এরকম করবে না।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(শেষ) হুমায়ূন আহমেদ
মারুফ কি এমন একজন?
অবশ্যই।
মারুফ নিজে কিন্তু তা জানে না। তিথি তাকে তা জানতে দেয় নি। কাউকে প্রচণ্ডভাবে ভালবাসার মধ্যে এক ধরনের দুর্বলতা আছে। নিজেকে তখন তুচ্ছ এবং সামান্য মনে হয়। এই ব্যাপারটা নিজেকে ছোট করে দেয়। তিথির নিজেকে ছােট করতে ইচ্ছা হয় না।
মারুফের সঙ্গে তার পরিচয় পর্বটা বেশ অদ্ভুত। তিথি এক দুপুরবেলা সায়েন্স লাইব্রেরীর থেকে বের হয়েছে। মাথা না আঁচড়ানো এলােমেলো চুলের এক ছেলে এসে বলল, গত বছর ময়ূখের অনুষ্ঠানে আপনার গান আমার অদ্ভুত ভাল লেগেছে। আপনার সঙ্গে আজ এইভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবি নি। যদিও আপনাকে অনেক খুঁজেছি। যাদের প্রাণপণ খােজা হয় তাদের কখনাে পাওয়া হয় না। ভাগ্যিস আপনাকে পেলাম। আমার নাম মারুফ।
তিথি হকচকিয়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে কোনমতে বলল, আপনি মনে হয় ভুল করছেন। আমি গান গাইতে পারি না। কখনো গান গাইনি। ময়ূখের অনুষ্ঠান কি তাও জানি না।
‘আই এম সরি।‘ | ‘সরি হবার কিছু নেই। মানুষ ভুল করে। আপনিও করেছেন।
‘তা করেছি। তবে আমি সচরাচর ভুল করি না।
তিথির তখন চট করে মনে হল এই ছেলেটা তার সঙ্গে কথা বলার জন্যে গল্পটা বানিয়েছে। তার মন খারাপ হল। তিথি এমন কেউ না যে তার সঙ্গে কথা বলার জন্যে একটা মিথ্যা গল্প তৈরী করতে হবে।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(শেষ) হুমায়ূন আহমেদ
মারুফ তুখন দাড়িয়ে আছে। তিথি সহজ ভঙ্গিতে বলল, কিছু বলবেন? মারুফ বলল, একটা কথা বলতে চাচ্ছি। সাহসে কুলুচ্ছে না। আপনি যদি অন্য
কিছু মনে করেন।
“বলুন। আমি কিছু মনে করব না।
‘আপনি ভাবছেন আপনার সঙ্গে আলাপ করবার জন্যে আমি এই গল্পটা বানিয়েছি। এই জন্যেই আমার খারাপ লাগছে। গল্পটা আমি বানাইনি। আমি ঔপন্যাসিক না। গল্প বানাবার ক্ষমতা আমার নেই। বিশ্বাস করুন।
‘আমি বিশ্বাস করলাম।
তিথি লাইব্রেরী থেকে নেমে এল রাস্তায়। রিকশা নিল। রিকশায় উঠে আরেকবার তাকালো ছেলেটার দিকে। সে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। ধ্বক করে তিথির বুকে ধাক্কা লাগল। তিথি ভেবেই ছিল মারুফ নামের এই ছেলেটি তার দিকে তাকিয়ে থাকবে। কেন সে তা করল না? এটা এমন কোন বড় ঘটনা না। খুবই সামান্য ঘটনা। কিন্তু এই সামান্য ঘটনার কারণে তিথির সেই রাতে এক ফোটা ঘুম হল না।
শায়লা ফজরের নামাজ পড়বার জন্যে ভােররাতে উঠে দেখেন তিথি অন্ধকারে বসার ঘরের সোফায় চুপচাপ বসে আছে। তিনি বললেন, কি হয়েছে রে তিথি ? তিথি কাদো কাদো গলায় বলল, কিছু হয়নি।
পরের তিন মাস মারুফের সঙ্গে তিথির দেখা হয়নি। যত বার তিথি লাইব্রেরীতে গিয়েছে ততবারই তার মনে হয়েছে আজ লাইব্রেরী থেকে বের হলেই মারুফ নামের ঐ ছেলেটির সঙ্গে দেখা হবে। দেখা হয়নি। প্রতিদিনই চাপা এক ধরণের কষ্ট নিয়ে তিথিকে বাসায় ফিরতে হয়েছে। প্রতিদিনই শায়লা জিজ্ঞেস করেছেন – কি হয়েছে। তাের বলতাে?
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(শেষ) হুমায়ূন আহমেদ
তিথি বলেছে, কিছু হয়নি। “অবশ্যই হয়েছে। সব আমাকে খুলে বল। ‘খুলে বলার মত কিছু হয়নি মা।।
তারপর একদিন তিথি হাসিমুখে বাসায় ফিরল। দেখা হয়েছে মারুফের সঙ্গে। তিখি লাইেব্ররী থেকে বের হয়েই দেখল মারুফ লাইব্রেরীর বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাবার চেষ্টা করছে। বাতাসের জন্যে সিগারেট ধরাতে পারছে না। তিথি একবার ভাবল – কিছু না বলে এগিয়ে যাবে। পরমুহূর্তেই সব সংকোচ সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে এগিয়ে এসে বলল, কেমন আছেন?
মারুফ বলল, ভাল। তিথি বলল, আমাকে চিনতে পারছেনতাে?
‘পারছি। ময়ূখের অনুষ্ঠানে আপনি গান গিয়েছিলেন। যদিও আপনি তা স্বীকার করেন না। আপনি ত্রিশ সেকেণ্ড আমার জন্যে দাঁড়াবেন – আমার দেয়াশলাইয়ের