তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(শেষ) হুমায়ূন আহমেদ

তিথি অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, গরমের মধ্যে কোট গায়ে দিয়েছেন ঘামতাে ছুটবেই। 

তিথির নীল তোয়ালে

এখন গরম তবে সিলেট শীতের জায়গাতখন দরকার লাগবেতাছাড়া ট্রেন ছাড়লেও শীত লাগবে‘ 

তিথির বলতে ইচ্ছা করছে নুরুজ্জামান সাহেব তাকিয়ে দেখুন একমাত্র আপনিই কোট পরে আছেন। 

মারুফ যে শেষ পর্যন্ত আসবে না এটা তিথি ভাবতে পারে নিট্রেন ছাড়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সে আশা করে রইল সে দেখবে মারুফ ছুটতে ছুটতে আসছেপরনে সুন্দর একটা হাওয়াই সার্টিমাথার চুল এলােমেলােসে বােধহয় কখনােই চুল আঁচড়ায় নাবিয়ের পর একটা কাজ তিথি অবশ্যই করবেমারুফের চুল আঁচড়ে দেবে। 

তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(শেষ) হুমায়ূন আহমেদ

ট্রেন ছেড়ে দিয়েছেজানালার কাছে তিথি একা বসে আছেকামরার দরজাটা খােলাদরজা বন্ধ করলেই সে একা হয়ে যাবেতিথি এখনাে দরজা বন্ধ করছে নাএখনাে সে আশা করে আছে দেখা যাবে হুট করে দরজা দিয়ে মারুফ টুকছেএরকমতাে হতেই পারে। 

কামরার দরজা তিথি ইচ্ছা করেই খােলা রেখেছেতার মন বলছে মারুফ ট্রেনে উঠেছে তাকে খুঁজে পাচ্ছে নাফার্স্টক্লাস কামরাগুলিতে সে খুঁজবেদরজা খােলা 

রাখলে সে বুঝবে কি করে তিথি এই খানেই আছে| ট্রেনের এটেনডেন্ট উকি দিলহাতে কম্বল এবং বালিশদু‘টিই বেশ পরিষ্কারসাধারণত ট্রেনের এটেনডেন্টদের চেহারা এবং আচার আচরণ রুক্ষ ধরনের হয়ে থাকেএর তেমন নাএর বয়স অল্পসুন্দর চেহারাকথা বলছে ভদ্র বিনীত ভঙ্গিতে। 

আপা রাতের খাবার খাবেন

চা দেই আপা? চা খানরাত এগারােটার পর চা বন্ধ হয়ে যাবেদিনচা দিনদরজাটা কি বন্ধ করে দেব আপা?” 

নাকিছুক্ষণ খােলা থাক। 

ট্রেনের গতি বাড়ছেরাতের ট্রেনগুলি কি সব সময়ই দ্রুত চলে? জোছনা আছেট্রেনের জানালা থেকে জোছনা মাখা প্রকৃতি দেখার মত আনন্দ আর কিইবাহতে পারেরাতের ট্রেনে উঠলে তিথির সব সময় মনে হয় ট্রেনে ট্রেনে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারলে মন্দ হত নাতবে একা নাএকজন পাশে দরকারএমন একজন যাকে দেখতে ভাল লাগেযার পাশে বসতে ভাল লাগেযার কথা শুনতে ভাল লাগেএমন একজন যে কথা বলতে বলতে চোখ ফিরিয়ে নিলে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে, তুমি চোখ ফিরিয়ে নিলে কেন? খবদার আর কখনাে এরকম করবে না। 

তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(শেষ) হুমায়ূন আহমেদ

মারুফ কি এমন একজন

অবশ্যই। 

মারুফ নিজে কিন্তু তা জানে নাতিথি তাকে তা জানতে দেয় নিকাউকে প্রচণ্ডভাবে ভালবাসার মধ্যে এক ধরনের দুর্বলতা আছেনিজেকে তখন তুচ্ছ এবং সামান্য মনে হয়এই ব্যাপারটা নিজেকে ছোট করে দেয়তিথির নিজেকে ছােট করতে ইচ্ছা হয় না। 

মারুফের সঙ্গে তার পরিচয় পর্বটা বেশ অদ্ভুততিথি এক দুপুরবেলা সায়েন্স লাইব্রেরীর থেকে বের হয়েছেমাথা না আঁচড়ানো এলােমেলো চুলের এক ছেলে এসে বলল, গত বছর ময়ূখের অনুষ্ঠানে আপনার গান আমার অদ্ভুত ভাল লেগেছেআপনার সঙ্গে আজ এইভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবি নিযদিও আপনাকে অনেক খুঁজেছিযাদের প্রাণপণ খােজা হয় তাদের কখনাে পাওয়া হয় নাভাগ্যিস আপনাকে পেলামআমার নাম মারুফ। 

তিথি হকচকিয়ে গেলনিজেকে সামলে নিয়ে কোনমতে বলল, আপনি মনে হয় ভুল করছেনআমি গান গাইতে পারি নাকখনো গান গাইনিময়ূখের অনুষ্ঠান কি তাও জানি না। 

আই এম সরি| সরি হবার কিছু নেইমানুষ ভুল করেআপনিও করেছেন। 

তা করেছিতবে আমি সচরাচর ভুল করি না। 

তিথির তখন চট করে মনে হল এই ছেলেটা তার সঙ্গে কথা বলার জন্যে গল্পটা বানিয়েছেতার মন খারাপ হলতিথি এমন কেউ না যে তার সঙ্গে কথা বলার জন্যে একটা মিথ্যা গল্প তৈরী করতে হবে

তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(শেষ) হুমায়ূন আহমেদ

 মারুফ তুখন দাড়িয়ে আছেতিথি সহজ ভঙ্গিতে বলল, কিছু বলবেন? মারুফ বলল, একটা কথা বলতে চাচ্ছিসাহসে কুলুচ্ছে নাআপনি যদি অন্য 

কিছু মনে করেন। 

বলুনআমি কিছু মনে করব না। 

আপনি ভাবছেন আপনার সঙ্গে আলাপ করবার জন্যে আমি এই গল্পটা বানিয়েছিএই জন্যেই আমার খারাপ লাগছেগল্পটা আমি বানাইনিআমি ঔপন্যাসিক নাগল্প বানাবার ক্ষমতা আমার নেইবিশ্বাস করুন। 

আমি বিশ্বাস করলাম। 

তিথি লাইব্রেরী থেকে নেমে এল রাস্তায়রিকশা নিলরিকশায় উঠে আরেকবার তাকালো ছেলেটার দিকেসে অন্য দিকে তাকিয়ে আছেধ্বক করে তিথির বুকে ধাক্কা লাগলতিথি ভেবেই ছিল মারুফ নামের এই ছেলেটি তার দিকে তাকিয়ে থাকবেকেন সে তা করল না? এটা এমন কোন বড় ঘটনা নাখুবই সামান্য ঘটনাকিন্তু এই সামান্য ঘটনার কারণে তিথির সেই রাতে এক ফোটা ঘুম হল না। 

শায়লা ফজরের নামাজ পড়বার জন্যে ভােররাতে উঠে দেখেন তিথি অন্ধকারে বসার ঘরের সোফায় চুপচাপ বসে আছেতিনি বললেন, কি হয়েছে রে তিথি ? তিথি কাদো কাদো গলায় বলল, কিছু হয়নি। 

পরের তিন মাস মারুফের সঙ্গে তিথির দেখা হয়নিযত বার তিথি লাইব্রেরীতে গিয়েছে ততবারই তার মনে হয়েছে আজ লাইব্রেরী থেকে বের হলেই মারুফ নামের ছেলেটির সঙ্গে দেখা হবেদেখা হয়নি। প্রতিদিনই চাপা এক ধরণের কষ্ট নিয়ে তিথিকে বাসায় ফিরতে হয়েছেপ্রতিদিনই শায়লা জিজ্ঞেস করেছেন কি হয়েছেতাের বলতাে

তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(শেষ) হুমায়ূন আহমেদ

তিথি বলেছে, কিছু হয়নিঅবশ্যই হয়েছেসব আমাকে খুলে বলখুলে বলার মত কিছু হয়নি মা। 

তারপর একদিন তিথি হাসিমুখে বাসায় ফিরলদেখা হয়েছে মারুফের সঙ্গেতিখি লাইেব্ররী থেকে বের হয়েই দেখল মারুফ লাইব্রেরীর বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাবার চেষ্টা করছেবাতাসের জন্যে সিগারেট ধরাতে পারছে নাতিথি একবার ভাবল কিছু না বলে এগিয়ে যাবেপরমুহূর্তেই সব সংকোচ সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে এগিয়ে এসে বলল, কেমন আছেন

মারুফ বলল, ভালতিথি বলল, আমাকে চিনতে পারছেনতাে

পারছিময়ূখের অনুষ্ঠানে আপনি গান গিয়েছিলেনযদিও আপনি তা স্বীকার করেন নাআপনি ত্রিশ সেকেণ্ড আমার জন্যে দাঁড়াবেন আমার দেয়াশলাইয়ের

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *