পাঁচটা বেজে গেছে। জাফর সাহেবের আসার সময় হয়ে গেল। বিকেলে নাশতা দেয়ার মত কিছু নেই। ময়দা আছে, লুচি ভেজে দেয়া যায়। ঘরে ডিম আছে। ডিমের ওমলেট আর লুচি ভাজা।
তিথি অনেক খুঁজেও লুচি বেলার বেলুন পেল না। একটা টিন ভর্তি চিড়া আছে। তার মুখ খুলে দেখা গেল কাল কাল পােকা পড়ে গেছে। তিখির অস্থির লাগছে। বাবা ক্ষুধার্ত হয়ে অফিস থেকে ফেরেন। হাত–মুখ ধুয়েই কিছু খাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাকে দেয়ার মত কিছুই নেই।
তিথি চায়ের পানি চড়াল।
জাফর সাহেব এলেন সাড়ে পাঁচটার দিকে। নুরুজ্জামান তাঁর সঙ্গেই এসেছে। সে ঠিক পাঁচটায় অফিসে গিয়ে উপস্থিত। নুরুজ্জামান আরাে দুটা আনারস কিনেছে। দোকানদার বলে দিয়েছে — “মধুর মত মিষ্টি না হইলে আমার দুই গালে দুই চড় দিবেন।”
এদের কথা বিশ্বাস করা ঠিক না তবু সে দু‘টা কিনে ফেলেছে।
তিথি বলল, আমি আনারস খাই না। বাবাও খান না। আপনি শুধু শুধু এনেছেন।
নুরুজ্জামান বিব্রতমুখে বলল, আনারস একটা ভাল ফল।
তিথি বলল, মােটেই ভাল ফল না। এর সারা গা ভর্তি চোখ। আনারসের দিকে তাকালে মনে হয় সেও হাজার হাজার চোখ মেলে আমাকে দেখছে। এই আনারস আপনাকেই খেতে হবে।
‘জি আচ্ছা।
‘আনারস কি করে কাটতে হয় তাও জানি না। আপনাকেই কাটতে হবে। ‘একটা বটি দিন।
রান্নাঘরে চলে যান। খুঁজে বের করুন। এই বাড়ির কোথায় কি আছে আমি জানি না।
নুরুজ্জামান বটির খােজে রান্নাঘরে চলে গেল। তিথি চা নিয়ে গেল বাবার কাছে।
অফিস থেকে ফিরে জাফর সাহেব সাধারণত হাত মুখ ধুয়ে বারান্দায় বসে থাকেন। মাগরেবের আজানের পর উঠেন। তার আগে না। সারাদিন এই এক ওয়াক্তের নামাজই তিনি পড়েন। আজ তিনি শােবার ঘরে হাত–পা এলিয়ে শুয়ে আছেন। তিথিকে দেখেই বললেন, চা খাব না রে মা।
‘চা খাবে না কেন? শরীর খারাপ? ‘জ্বর জ্বর লাগছে।
‘ক্লান্ত হয়ে আছি এই জন্যে জ্বর জ্বর লাগছে। ডিমটা খাও। বেশি করে কঁচা মরিচ দিয়ে ওমলেট করে এনেছি। ওমলেট খেয়ে চা খাও, দেখবে ভাল লাগবে।
জাফর সাহেব উঠে বসলেন। ডিম নিলেন না। চায়ের কাপটা নিলেন। “তিথি ‘জি বাবা।
‘তাের মা বােধহয় আজ রাতে সিলেট যাচ্ছে বেড়াতে। তুইও যা, ঘুরে আয়। আমার এখানে অসুবিধা হবে না। হােটেল থেকে খাবার আনিয়ে খেয়ে নেব।”
‘আমার এখানে জরুরী কাজ আছে। আমি যেতে পারব না। আমি যাই কি না যাই সেটা বড় কথা না। বড় কথা হল, তােমাদের ঝগড়াটা মিটমাট হওয়া দরকার। আমার অসহ্য লাগছে।
জাফর সাহেব কিছু বললেন না, তিথি চেয়ার টেনে বাবার সামনে বসল। মনে হচ্ছে সে ঝগড়া করবে।
‘বাবা !
‘তুমি ভয়ংকর একটা অন্যায় করেছ। তুমি মা‘র গায়ে হাত তুলেছ। আমি তাে কল্পনাও করতে পারিনি যে, তুমি এমন একটা কাজ করতে পার। তুমি মাকে চড় দাও নি ?”
“কি করে এরকম একটা কাজ করলে ?
জাফর সাহেব বিড় বিড় করে বললেন, রেগে গিয়েছিলাম। রেগে গেলে মানুষের
মাথার ঠিক থাকে না। মানুষ পশুর মত আচরণ করে।
এত রেগেই–বা কেন গেলে? | ‘সে আমাকে গালাগালি করতে করতে তাের দাদাকে গালি দেয়া শুরু করল। বলল – তুমি যেমন গাধা, তােমার বাবাও গাধা। চট করে মাথায় রক্ত উঠে গেল।
‘দাদাকে গাধা বলতেই তাে আর উনি গাধা হয়ে যাননি। ‘তা যায়নি। তবু বাবাকে গালাগালিটা সহ্য হল না। আমাকে যদি কেউ গাধা বলে – তাের কি ভাল লাগবে?
‘না, ভাল লাগবে না। কিন্তু আমি তার জন্যে মারামারি শুরু করব না।
একেক জন মানুষ একেক রকমের মা। কারাে রাগ বেশি, কারাের কম। ‘চা খাওয়া হয়েছে ?
‘এখন ডিমটা খাও। ‘ডিম খাব না।
‘খাও বলছি। আমি কষ্ট করে ভাজলাম আর তুমি খাবে না। এই দেখ, ডিম ভাজতে গিয়ে আমার হাত পুড়ে গেছে। গরম তেল ছিটকে এসে পড়ল।
জাফর সাহেব ডিমের প্লেট হাতে নিলেন।
নুরুজ্জামান তার ঘরে গামলা ভর্তি আনারস নিয়ে বসে আছে। দোকানদার মিথ্যা বলেনি। মধুর মতই মিষ্টি। দুপুরে খাওয়া না হওয়ায় তার খিদে লেগেছে প্রচণ্ড সে দ্রুতগতিতে আনারস খেয়ে চলেছে। নুরুজ্জামানের মনে হল এমন মিষ্টি আনারস সে এই জীবনে খায়নি। মনে হয় বাকি জীবনেও খাবে না।
দরজায় টোকা পড়ছে। নুরুজ্জামান বলল, কে ? তিথি বলল, আমি। আসব? ‘দ্ধি আসুন।
তিথি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, গামলা ভর্তি আনারস নিয়ে বসেছেন বলে মনে হচ্ছে।
নুরুজ্জামান লজ্জিতমুখে বলল, আনারসটা খুব মিষ্টি। ‘এক সঙ্গে এতটা খেতে পারবেন ?” ‘পারব। দুপুরে খাইনি তাে। খুব খিদে লেগেছে। ‘দুপুরে খাননি কেন? ‘ঘােরাঘুরি করতে করতে সময় পার হয়ে গেল। ‘ভাত রান্না করা আছে। গরম করে দেব?’
‘ছি না। ‘আপনাকে একটা কাজ করে দিতে হবে। ‘অবশ্যই দেব।
‘একটা ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি। সেখানে আমার মা আছেন। মাকে কিছু জিনিস পৌঁছে দিতে হবে। পারবেন না? ‘এক্ষুণি দিয়ে আসছি।
এক্ষুণি দিতে হবে না। আপনি আপনার আনারস শেষ করুন। ‘জি আচ্ছা।‘ ‘চা খাবেন? চা করে দেব?’ ‘জি–নাফল খাবার পর পানি জাতীয় কিছু খেতে নেই। খনার বচন আছে –
“ফল খেয়ে পানি খায় যম বলে আয় আয়।” ‘যম আয় আয় বললে পানি না খাওয়াই ভাল।
তিথি ভাত বসিয়েছে। চেয়ার এনে বসে আছে চুলার পাশে। ভাত রান্নার জন্যে ঘরে একটা রাইস কুকার আছে। তিথি সেই কুকারের ব্যবহার জানে না। জানলে এত সমস্যা হত না। তার কাছে মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে সবচে’ জটিল কাজ হচ্ছে ভাত রান্না। ভাত কখন নরম হবে কখন শক্ত হবে কিছুই বলা যায় না। এবার মা এলে তার কাছ থেকে খুব ভাল করে কয়েকটা জিনিস শিখে নিতে হবে। ভাত রান্না এবং তরকারির রং সুন্দর করার কৌশল। তরকারি যা রান্না হচ্ছে খেতে খারাপ হচ্ছে না, কিন্তু দেখাচ্ছে কুৎসিত।
মাটি–মাটি ধরনের হলুদ রঙ। টাইফয়েড রােগির পথ্য। | জাফর সাহেব রান্নাঘরে উঁকি দিলেন। মেয়েকে রান্নাঘরের চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে খুব অবাক হলেন। বিস্মিত হয়ে বললেন, হয়েছে কি তাের? এরকম চুপচাপ বসে আছিস কেন?
‘ভাত রাঁধছি।’ ‘ভাত রাধলে চুলার পাশে এরকম গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে হয় ?
‘অন্যের হয় না, আমার হয়। ভাত রান্নার সময় যে ক‘টা সূরা আমার জানা। আছে সব ক‘টা আমি পড়ে ফেলি।
‘সূরা পড়ে ভাত রাঁধতে হবে না।