তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১০) হুমায়ূন আহমেদ

পাঁচটা বেজে গেছেজাফর সাহেবের আসার সময় হয়ে গেলবিকেলে নাশতা দেয়ার মত কিছু নেইময়দা আছে, লুচি ভেজে দেয়া যায়ঘরে ডিম আছেডিমের ওমলেট আর লুচি ভাজা। 

তিথির নীল তোয়ালে

তিথি অনেক খুঁজেও লুচি বেলার বেলুন পেল নাএকটা টিন ভর্তি চিড়া আছেতার মুখ খুলে দেখা গেল কাল কাল পােকা পড়ে গেছেতিখির অস্থির লাগছেবাবা ক্ষুধার্ত হয়ে অফিস থেকে ফেরেনহাতমুখ ধুয়েই কিছু খাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েনতাকে দেয়ার মত কিছুই নেই। 

তিথি চায়ের পানি চড়াল। 

জাফর সাহেব এলেন সাড়ে পাঁচটার দিকেনুরুজ্জামান তাঁর সঙ্গেই এসেছেসে ঠিক পাঁচটায় অফিসে গিয়ে উপস্থিতনুরুজ্জামান আরাে দুটা আনারস কিনেছেদোকানদার বলে দিয়েছে মধুর মত মিষ্টি না হইলে আমার দুই গালে দুই চড় দিবেন” 

এদের কথা বিশ্বাস করা ঠিক না তবু সে দুটা কিনে ফেলেছে। 

তিথি বলল, আমি আনারস খাই নাবাবাও খান নাআপনি শুধু শুধু এনেছেন। 

নুরুজ্জামান বিব্রতমুখে বলল, আনারস একটা ভাল ফল। 

তিথি বলল, মােটেই ভাল ফল নাএর সারা গা ভর্তি চোখআনারসের দিকে তাকালে মনে হয় সেও হাজার হাজার চোখ মেলে আমাকে দেখছেএই আনারস আপনাকেই খেতে হবে। 

জি আচ্ছা। 

আনারস কি করে কাটতে হয় তাও জানি নাআপনাকেই কাটতে হবেএকটা বটি দিন। 

রান্নাঘরে চলে যানখুঁজে বের করুনএই বাড়ির কোথায় কি আছে আমি জানি না। 

নুরুজ্জামান বটির খােজে রান্নাঘরে চলে গেলতিথি চা নিয়ে গেল বাবার কাছে। 

অফিস থেকে ফিরে জাফর সাহেব সাধারণত হাত মুখ ধুয়ে বারান্দায় বসে থাকেনমাগরেবের আজানের পর উঠেনতার আগে নাসারাদিন এই এক ওয়াক্তের নামাজই তিনি পড়েন। আজ তিনি শােবার ঘরে হাতপা এলিয়ে শুয়ে আছেনতিথিকে দেখেই বললেন, চা খাব না রে মা। 

চা খাবে না কেন? শরীর খারাপ? জ্বর জ্বর লাগছে। 

ক্লান্ত হয়ে আছি এই জন্যে জ্বর জ্বর লাগছেডিমটা খাওবেশি করে কঁচা মরিচ দিয়ে ওমলেট করে এনেছিওমলেট খেয়ে চা খাও, দেখবে ভাল লাগবে। 

জাফর সাহেব উঠে বসলেনডিম নিলেন নাচায়ের কাপটা নিলেনতিথি জি বাবা। 

তাের মা বােধহয় আজ রাতে সিলেট যাচ্ছে বেড়াতেতুইও যা, ঘুরে আয়আমার এখানে অসুবিধা হবে নাহােটেল থেকে খাবার আনিয়ে খেয়ে নেব” 

আমার এখানে জরুরী কাজ আছেআমি যেতে পারব নাআমি যাই কি না যাই সেটা বড় কথা নাবড় কথা হল, তােমাদের ঝগড়াটা মিটমাট হওয়া দরকারআমার অসহ্য লাগছে। 

জাফর সাহেব কিছু বললেন না, তিথি চেয়ার টেনে বাবার সামনে বসলমনে হচ্ছে সে ঝগড়া করবে। 

বাবা

তুমি ভয়ংকর একটা অন্যায় করেছ। তুমি মাগায়ে হাত তুলেছআমি তাে কল্পনাও করতে পারিনি যে, তুমি এমন একটা কাজ করতে পারতুমি মাকে চড় দাও নি ?” 

কি করে এরকম একটা কাজ করলে

জাফর সাহেব বিড় বিড় করে বললেন, রেগে গিয়েছিলামরেগে গেলে মানুষের 

মাথার ঠিক থাকে নামানুষ পশুর মত আচরণ করে। 

এত রেগেইবা কেন গেলে? | সে আমাকে গালাগালি করতে করতে তাের দাদাকে গালি দেয়া শুরু করলবলল তুমি যেমন গাধা, তােমার বাবাও গাধাচট করে মাথায় রক্ত উঠে গেল। 

দাদাকে গাধা বলতেই তাে আর উনি গাধা হয়ে যাননি তা যায়নিতবু বাবাকে গালাগালিটা সহ্য হল নাআমাকে যদি কেউ গাধা বলে তাের কি ভাল লাগবে

না, ভাল লাগবে নাকিন্তু আমি তার জন্যে মারামারি শুরু করব না। 

একেক জন মানুষ একেক রকমের মাকারাে রাগ বেশি, কারাের কমচা খাওয়া হয়েছে

এখন ডিমটা খাওডিম খাব না। 

খাও বলছিআমি কষ্ট করে ভাজলাম আর তুমি খাবে নাএই দেখ, ডিম ভাজতে গিয়ে আমার হাত পুড়ে গেছেগরম তেল ছিটকে এসে পড়ল। 

জাফর সাহেব ডিমের প্লেট হাতে নিলেন। 

নুরুজ্জামান তার ঘরে গামলা ভর্তি আনারস নিয়ে বসে আছেদোকানদার মিথ্যা বলেনিমধুর মতই মিষ্টিদুপুরে খাওয়া না হওয়ায় তার খিদে লেগেছে প্রচণ্ড সে দ্রুতগতিতে আনারস খেয়ে চলেছেনুরুজ্জামানের মনে হল এমন মিষ্টি আনারস সে এই জীবনে খায়নিমনে হয় বাকি জীবনেও খাবে না। 

দরজায় টোকা পড়ছেনুরুজ্জামান বলল, কে ? তিথি বলল, আমিআসব? দ্ধি আসুন। 

তিথি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, গামলা ভর্তি আনারস নিয়ে বসেছেন বলে মনে হচ্ছে। 

নুরুজ্জামান লজ্জিতমুখে বলল, আনারসটা খুব মিষ্টিএক সঙ্গে এতটা খেতে পারবেন ?পারবদুপুরে খাইনি তােখুব খিদে লেগেছেদুপুরে খাননি কেন? ঘােরাঘুরি করতে করতে সময় পার হয়ে গেলভাত রান্না করা আছেগরম করে দেব?’ 

ছি নাআপনাকে একটা কাজ করে দিতে হবেঅবশ্যই দেব। 

একটা ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছিসেখানে আমার মা আছেনমাকে কিছু জিনিস পৌঁছে দিতে হবেপারবেন না? এক্ষুণি দিয়ে আসছি। 

এক্ষুণি দিতে হবে নাআপনি আপনার আনারস শেষ করুনজি আচ্ছাচা খাবেন? চা করে দেব?জিনাফল খাবার পর পানি জাতীয় কিছু খেতে নেইখনার বচন আছে – 

ফল খেয়ে পানি খায় যম বলে আয় আয়যম আয় আয় বললে পানি না খাওয়াই ভাল। 

তিথি ভাত বসিয়েছেচেয়ার এনে বসে আছে চুলার পাশেভাত রান্নার জন্যে ঘরে একটা রাইস কুকার আছেতিথি সেই কুকারের ব্যবহার জানে নাজানলে এত সমস্যা হত নাতার কাছে মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে সবচেজটিল কাজ হচ্ছে ভাত রান্নাভাত কখন নরম হবে কখন শক্ত হবে কিছুই বলা যায় নাএবার মা এলে তার কাছ থেকে খুব ভাল করে কয়েকটা জিনিস শিখে নিতে হবেভাত রান্না এবং তরকারির রং সুন্দর করার কৌশলতরকারি যা রান্না হচ্ছে খেতে খারাপ হচ্ছে না, কিন্তু দেখাচ্ছে কুৎসিত

মাটিমাটি ধরনের হলুদ রঙটাইফয়েড রােগির পথ্য| জাফর সাহেব রান্নাঘরে উঁকি দিলেনমেয়েকে রান্নাঘরের চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে খুব অবাক হলেনবিস্মিত হয়ে বললেন, হয়েছে কি তাের? এরকম চুপচাপ বসে আছিস কেন

ভাত রাঁধছি।’ ভাত রাধলে চুলার পাশে এরকম গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে হয়

অন্যের হয় না, আমার হয়ভাত রান্নার সময় যে টা সূরা আমার জানাআছে সব কটা আমি পড়ে ফেলি। 

সূরা পড়ে ভাত রাঁধতে হবে না

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *