চুলা বন্ধ কর। “রাতে আমরা খাব না ? ‘চল যাই কোন একটা চাইনীজ হােটেল থেকে খেয়ে আসি। “আর নুরুজ্জামান সাহেব? উনি ? ‘ওর জন্যে খাবার নিয়ে আসব।
রােজ রােজ তাে আর চাইনীজ খাওয়া যাবে না। একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই। তুই উঠে আয়। কাপড় পর।।
তিথি উঠে এল। জাফর সাহেব বললেন, ভাল করে সাজগােজ কর তাে। তিথি বিস্মিত হয়ে বলল, কেন?
‘এম্নি। সাজলে তােকে কেমন দেখায় দেখি। দোকান যদি খােলা থাকে তােকে সুন্দর দেখে একটা শাড়ি কিনে দেব।‘
তিথি বলল, দরকার নেই। তুমি কিনে দেবে, মা’র রঙ পছন্দ হবে না। সে আবার দোকানে বদলাতে নিয়ে যাবে। এটা শুনে তুমি আবার রাগ করবে। আমার শাড়ি কেনার দরকার নেই। বাইরে খেতে যাচ্ছি, চল খেয়ে আসি।
তিথি সাজগােজ করবে না বললেও ভালই সাজল। ঢাকা শহরে রাতে গয়না পরে বের হওয়া একেবারে নিষিদ্ধ। তবু সে গলায় একটা হার পরল। কপালে খুব যত্ন করে টিপ আঁকল। গত জন্মদিনে কেন নীল জামদানী শাড়িটা পড়ল। শাড়িটা তার পছন্দ না। এই প্রথম পরছে। বড় বড় শাদা ফুল। চোখে লাগে, কিন্তু পরবার পর সে নিজেই মুগ্ধ হয়ে আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে রইল। এতাে সুন্দর লাগছে তাকে। আশ্চর্য তাে!
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১১) হুমায়ূন আহমেদ
জাফর সাহেব বললেন, তাের ফোন এসেছে। ফোনটা ধর। মাই গড! তুই সাজবিনা বলেও দেখি মারাত্মক সাজ দিয়েছিস।
‘সুন্দর লাগছে বাবা?”
খুব সুন্দর লাগছে। ক্যামেরায় ফিল্ম আছে কি না দেখ তাে। ফিল্ম থাকলে তাের একটা ছবি তুলে রাখব।
ছবি তুলতে হবে না বাবা। তুমি জানালা বন্ধ কর। আমরা এখন বেরুব। ‘তুই টেলিফোন ধরে আয়। মনে হচ্ছে মারুফ।
তিথি টেলিফোন ধরতে গেল। বাবার সামনে ছুটে যেতে লজ্জা লাগছে। কিন্তু তার ইচ্ছা করছে ছুটে গিয়ে ধরতে।
‘হ্যালো!
‘তিথি শােন, বেশিক্ষণ কথা বলতে পারব না। খুব জরুরী খবর আছে। কাল অবশ্যই অবশ্যই অবশ্যই সকাল ন‘টার মধ্যে পিজা কিং–এ থাকবে। কেমন? খােদা হাফেজ।
মারুফ টেলিফোন নামিয়ে রেখেছে। তার পরেও তিথি অনেকক্ষণ রিসিভার কানে ধরে রাখল। শব্দহীন রিসিভার কানে ধরে রাখার মধ্যেও যে আনন্দ আছে তা সে আগে বুঝতে পারে নি।
সকালে দাড়ি কামাতে গিয়ে মারুফ লক্ষ্য করল তাকে বেশ স্বাস্থ্যবান লাগছে।
ভরাট চেহারার একজন মানুষ। কয়েক রাত ভাল ঘুম হয়নি বলে চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। এই কালিটা না থাকলে তাকে আজ মোটামুটিভাবে একজন প্রেজেন্টেবল মানুষ বলা যেত।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১১) হুমায়ূন আহমেদ
গালে সাবান মাখতে গিয়ে হঠাৎ স্বাস্থ্য ভাল হওয়ার কারণ স্পষ্ট হল। ব্রণ উঠছে। কিছু কিছু ব্রণ আছে সুপ্ত অগ্নিগিরির মত। চামড়ার ভেতর মাথা ডুবিয়ে থাকে। মুখ বের করে না, তবে এদের কর্মকাণ্ড ভেতরে ভেতরে চলতে থাকে। তার গাল যে ফুলেফেপে একাকার হয়েছে এই তার রহস্য।
মারুফ ভূরু কুঁচকে আয়নার দিকে তাকিয়ে রইল। মুখভর্তি খোঁচা–খোঁচা দাড়ি। তার কিছু কিছু আবার পেকে গেছে। থুতনীর কাছের সবগুলি দাড়ি পাকা। তার বয়স বত্রিশ। বত্রিশ বছর বয়সে কারাে চুল–দাড়ি এরকম করে পাকে না। তার বেলাতেই বা এরকম হল কেন? প্রকৃতি নানান ভাবে তাকে প্রতারিত করছে। নয়ত তার মত একটি ছেলেকে চার বছর প্রাইভেট টিউশানি করে চলা লাগে?
ডিসপােজেবল শেভিং রেজারটা পুরানাে। সব জিনিস কিনতে মনে থাকে, রেজার কিনতে মনে থাকে না। রেজারের কথা মনে পড়ে সকাল বেলা। রহমতকে পাঠিয়ে এই মুহূর্তেই দোকান থেকে রেজার আনানাে যায়। তাতে লাভ হবে না। গালে ব্রেড ছোঁয়ানো যাবে না। সুপ্ত অগ্নিগিরি জেগে উঠবে।
তিথির কাছে তাকে যেতে হবে এই অবস্থাতেই। মেরুন রঙের হাফ হাওয়াই শার্ট, সাদা পেন্ট এবং সাদা কেড—এর জুতা পরা যাবে না। খোচা খোঁচা দাড়ির সঙ্গে এই পােশাক মানায় না। তাকে পাঞ্জাবি পরতে হবে। আধ ময়লা পাঞ্জাবি।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১১) হুমায়ূন আহমেদ
টেবিলে রহমত চায়ের কাপ রেখে দিয়েছে। পিরিচ দিয়ে ঢেকে রাখার কথা রহমতের মনে নেই। কোনদিন মনে থাকবেও । এর আগে এক লক্ষ বার বলা হয়েছে। চায়ে চুমুক দিতে গেলে অবধারিতভাবে কয়েকটা ভাসমান পিঁপড়া পাওয়া যাবে। সম্ভবত রহমতের ধারণা, চা বানাতে চিনি দুধ যেমন লাগে, পিপড়াও লাগে।
‘রহমত !
‘চা আরেক কাপ বানিয়ে আন। আর পাঞ্জাবি ইশ্রী করিয়ে আন।
রহমত রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এল। টেবিলে রাখা চায়ের কাপ নিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে লম্বা চুমুক দিয়ে চা শেষ করল। এই কাজটা সে রান্নাঘরেও করতে পারত। তা করবে না। একে বিদেয় করে দেবার সময় হয়ে গেছে। তবে সে বিদায় করতে পারবে না। রহমত তার কর্মচারি না। এটা মিজানের ভাড়া বাসা। মিজান তিন মাসের ট্রেনিংএ রাজশাহী আছে বলে সে থাকতে পারছে। মিজান চলে এলে তাকে বিদায়। নিতে হবে কারণ মিজান বিয়ে করেছে। বৌ নিয়ে থাকবে। বৌ চলে এলে বন্ধুর কথা মনে থাকে না।
‘রহমত, দুপুরে আজ রান্না করবে না। দুপুরে ভাত খাব না
রহমত উত্তর দিল না। রহমতের এই একটাই গুণ। কথাটা কম বলে। রােবট টাইপের। তবে বেকুব ধরনের রােবট। ওরা হুকুম তামিল করতে যায় কিন্তু হুকুমটা কি ঠিকমত শুনে না। ব্যাটাকে পাঞ্জাবি ইস্ত্রী করতে বলা হয়েছে। সে হয়ত পাঞ্জাবি বাদ দিয়ে পায়জামা ইস্ত্রী করিয়ে আনবে। এই সম্ভাবনা শতকরা ৬০ ভাগ। মারুফ সিগারেট ধরিয়ে চায়ের জন্যে অপেক্ষা করছে। সে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১১) হুমায়ূন আহমেদ
আজ সারাদিনে তাকে প্রচুর মিথ্যা কথা বলতে হবে। সহজ মিথ্যা না, জটিল ধরনের মিথ্যা। মিথ্যাগুলি বলা হবে তিথিকে। প্রিয়জনকে মিথ্যা বলা বেশ শক্ত। মনের উপর চাপ পড়ে। অসতর্ক হলে মিথ্যার লজিক এলােমেলাে হয়ে যায়। সত্য বলার সময় লজিকের দিকে খেয়াল রাখতে হয় না। মিথ্যা বলার সময় খেয়াল রাখতে হয়। মিথ্যার লজিক হচ্ছে সবচে’ কঠিন লজিক। বােকা লােক এই জন্যেই মিথ্যা বলতে পারে না।
রহমত চা নিয়ে এসেছে। চায়ের কাপ নামিয়েই সে কাপড় ইস্ত্রী করতে গেল। মারুফ আড়চোখে দেখল পাঞ্জাবিটাই নিয়ে যাচ্ছে। সে খানিকটা নিশ্চিত হয়েই চায়ে চুমুক দিল। আগুন–গরম চা। মনে হচ্ছে মুখের ভেতরটা পুড়ে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। সিগারেট বিস্বাদ লাগছে। আজ দিনটা খুব খারাপ ভাবে শুরু হয়েছে। মাথা ঠাণ্ডা রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। অথচ মাথাটা খুব ঠাণ্ডা রাখা দরকার। তিথিকে সে আজ তার প্যারিসে যাবার কথা বলবে, যা পুরােপুরি মিথ্যা, অথচ এমনভাবে তা বলতে হবে যেন তিথি তা অবিশ্বাস না করে। সামান্যতম অবিশ্বাস করা মানেই অরিজিন্যাল ব্লু–প্রিন্টে গণ্ডগােল হয়ে যাওয়া। এটা কিছুতেই হতে দেয়া যাবে না।
এই মিথ্যা বলায় তার কোন পাপ হবে বলে সে মনে করে না। সে মিথ্যা বলবে সারভাইভুেলের জন্যে। অনেক পােকা বেঁচে থাকার জন্যে যে গাছে বাস করে সেই গাছের রঙে নিজের রঙ বদলিয়ে নেয়। এতে পােকাটার কোন পাপ হয় না।