তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১১) হুমায়ূন আহমেদ

চুলা বন্ধ কররাতে আমরা খাব না ? চল যাই কোন একটা চাইনীজ হােটেল থেকে খেয়ে আসিআর নুরুজ্জামান সাহেব? উনি ? ওর জন্যে খাবার নিয়ে আসব। 

তিথির নীল তোয়ালে

রােজ রােজ তাে আর চাইনীজ খাওয়া যাবে নাএকটা কিছু ব্যবস্থা হবেইতুই উঠে আয়কাপড় পর। 

তিথি উঠে এলজাফর সাহেব বললেন, ভাল করে সাজগােজ কর তােতিথি বিস্মিত হয়ে বলল, কেন

এম্নিসাজলে তােকে কেমন দেখায় দেখিদোকান যদি খােলা থাকে তােকে সুন্দর দেখে একটা শাড়ি কিনে দেব‘ 

তিথি বলল, দরকার নেইতুমি কিনে দেবে, মারঙ পছন্দ হবে নাসে আবার দোকানে বদলাতে নিয়ে যাবেএটা শুনে তুমি আবার রাগ করবেআমার শাড়ি কেনার দরকার নেইবাইরে খেতে যাচ্ছি, চল খেয়ে আসি। 

তিথি সাজগােজ করবে না বললেও ভালই সাজলঢাকা শহরে রাতে গয়না পরে বের হওয়া একেবারে নিষিদ্ধতবু সে গলায় একটা হার পরলকপালে খুব যত্ন করে টিপ আঁকলগত জন্মদিনে কেন নীল জামদানী শাড়িটা পড়লশাড়িটা তার পছন্দ নাএই প্রথম পরছেবড় বড় শাদা ফুলচোখে লাগে, কিন্তু পরবার পর সে নিজেই মুগ্ধ হয়ে আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে রইলএতাে সুন্দর লাগছে তাকেআশ্চর্য তাে

তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১১) হুমায়ূন আহমেদ

জাফর সাহেব বললেন, তাের ফোন এসেছেফোনটা ধরমাই গড! তুই সাজবিনা বলেও দেখি মারাত্মক সাজ দিয়েছিস। 

সুন্দর লাগছে বাবা?” 

খুব সুন্দর লাগছেক্যামেরায় ফিল্ম আছে কি না দেখ তােফিল্ম থাকলে তাের একটা ছবি তুলে রাখব। 

ছবি তুলতে হবে না বাবাতুমি জানালা বন্ধ করআমরা এখন বেরুবতুই টেলিফোন ধরে আয়মনে হচ্ছে মারুফ। 

তিথি টেলিফোন ধরতে গেলবাবার সামনে ছুটে যেতে লজ্জা লাগছেকিন্তু তার ইচ্ছা করছে ছুটে গিয়ে ধরতে। 

হ্যালো

তিথি শােন, বেশিক্ষণ কথা বলতে পারব নাখুব জরুরী খবর আছেকাল অবশ্যই অবশ্যই অবশ্যই সকাল টার মধ্যে পিজা কিংথাকবেকেমন? খােদা হাফেজ। 

মারুফ টেলিফোন নামিয়ে রেখেছেতার পরেও তিথি অনেকক্ষণ রিসিভার কানে ধরে রাখলশব্দহীন রিসিভার কানে ধরে রাখার মধ্যেও যে আনন্দ আছে তা সে আগে বুঝতে পারে নি

সকালে দাড়ি কামাতে গিয়ে মারুফ লক্ষ্য করল তাকে বেশ স্বাস্থ্যবান লাগছে। 

ভরাট চেহারার একজন মানুষকয়েক রাত ভাল ঘুম হয়নি বলে চোখের নিচে কালি পড়ে গেছেএই কালিটা না থাকলে তাকে আজ মোটামুটিভাবে একজন প্রেজেন্টেবল মানুষ বলা যেত। 

তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১১) হুমায়ূন আহমেদ

গালে সাবান মাখতে গিয়ে হঠাৎ স্বাস্থ্য ভাল হওয়ার কারণ স্পষ্ট হলব্রণ উঠছেকিছু কিছু ব্রণ আছে সুপ্ত অগ্নিগিরির মতচামড়ার ভেতর মাথা ডুবিয়ে থাকেমুখ বের করে না, তবে এদের কর্মকাণ্ড ভেতরে ভেতরে চলতে থাকেতার গাল যে ফুলেফেপে একাকার হয়েছে এই তার রহস্য। 

মারুফ ভূরু কুঁচকে আয়নার দিকে তাকিয়ে রইলমুখভর্তি খোঁচাখোঁচা দাড়িতার কিছু কিছু আবার পেকে গেছেথুতনীর কাছের সবগুলি দাড়ি পাকাতার বয়স বত্রিশবত্রিশ বছর বয়সে কারাে চুলদাড়ি এরকম করে পাকে নাতার বেলাতেই বা এরকম হল কেন? প্রকৃতি নানান ভাবে তাকে প্রতারিত করছেনয়ত তার মত একটি ছেলেকে চার বছর প্রাইভেট টিউশানি করে চলা লাগে

ডিসপােজেবল শেভিং রেজারটা পুরানােসব জিনিস কিনতে মনে থাকে, রেজার কিনতে মনে থাকে নারেজারের কথা মনে পড়ে সকাল বেলারহমতকে পাঠিয়ে এই মুহূর্তেই দোকান থেকে রেজার আনানাে যায়তাতে লাভ হবে নাগালে ব্রেড ছোঁয়ানো যাবে নাসুপ্ত অগ্নিগিরি জেগে উঠবে। 

তিথির কাছে তাকে যেতে হবে এই অবস্থাতেইমেরুন রঙের হাফ হাওয়াই শার্ট, সাদা পেন্ট এবং সাদা কেডএর জুতা পরা যাবে নাখোচা খোঁচা দাড়ির সঙ্গে এই পােশাক মানায় না। তাকে পাঞ্জাবি পরতে হবেআধ ময়লা পাঞ্জাবি। 

তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১১) হুমায়ূন আহমেদ

টেবিলে রহমত চায়ের কাপ রেখে দিয়েছেপিরিচ দিয়ে ঢেকে রাখার কথা রহমতের মনে নেইকোনদিন মনে থাকবেও এর আগে এক লক্ষ বার বলা হয়েছেচায়ে চুমুক দিতে গেলে অবধারিতভাবে কয়েকটা ভাসমান পিঁপড়া পাওয়া যাবেসম্ভবত রহমতের ধারণা, চা বানাতে চিনি দুধ যেমন লাগে, পিপড়াও লাগে। 

রহমত

চা আরেক কাপ বানিয়ে আনআর পাঞ্জাবি ইশ্রী করিয়ে আন। 

রহমত রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এলটেবিলে রাখা চায়ের কাপ নিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে লম্বা চুমুক দিয়ে চা শেষ করলএই কাজটা সে রান্নাঘরেও করতে পারততা করবে নাএকে বিদেয় করে দেবার সময় হয়ে গেছেতবে সে বিদায় করতে পারবে নারহমত তার কর্মচারি নাএটা মিজানের ভাড়া বাসামিজান তিন মাসের ট্রেনিংএ রাজশাহী আছে বলে সে থাকতে পারছেমিজান চলে এলে তাকে বিদায়নিতে হবে কারণ মিজান বিয়ে করেছেবৌ নিয়ে থাকবেবৌ চলে এলে বন্ধুর কথা মনে থাকে না। 

রহমত, দুপুরে আজ রান্না করবে নাদুপুরে ভাত খাব না 

রহমত উত্তর দিল নারহমতের এই একটাই গুণকথাটা কম বলেরােবট টাইপেরতবে বেকুব ধরনের রােবটওরা হুকুম তামিল করতে যায় কিন্তু হুকুমটা কি ঠিকমত শুনে নাব্যাটাকে পাঞ্জাবি ইস্ত্রী করতে বলা হয়েছেসে হয়ত পাঞ্জাবি বাদ দিয়ে পায়জামা ইস্ত্রী করিয়ে আনবেএই সম্ভাবনা শতকরা ৬০ ভাগমারুফ সিগারেট ধরিয়ে চায়ের জন্যে অপেক্ষা করছেসে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে

তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১১) হুমায়ূন আহমেদ

আজ সারাদিনে তাকে প্রচুর মিথ্যা কথা বলতে হবেসহজ মিথ্যা না, জটিল ধরনের মিথ্যামিথ্যাগুলি বলা হবে তিথিকেপ্রিয়জনকে মিথ্যা বলা বেশ শক্তমনের উপর চাপ পড়েঅসতর্ক হলে মিথ্যার লজিক এলােমেলাে হয়ে যায়সত্য বলার সময় লজিকের দিকে খেয়াল রাখতে হয় নামিথ্যা বলার সময় খেয়াল রাখতে হয়মিথ্যার লজিক হচ্ছে সবচেকঠিন লজিকবােকা লােক এই জন্যেই মিথ্যা বলতে পারে না। 

রহমত চা নিয়ে এসেছেচায়ের কাপ নামিয়েই সে কাপড় ইস্ত্রী করতে গেলমারুফ আড়চোখে দেখল পাঞ্জাবিটাই নিয়ে যাচ্ছেসে খানিকটা নিশ্চিত হয়েই চায়ে চুমুক দিলআগুনগরম চামনে হচ্ছে মুখের ভেতরটা পুড়ে ঝাঁঝরা হয়ে গেছেসিগারেট বিস্বাদ লাগছেআজ দিনটা খুব খারাপ ভাবে শুরু হয়েছেমাথা ঠাণ্ডা রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছেঅথচ মাথাটা খুব ঠাণ্ডা রাখা দরকারতিথিকে সে আজ তার প্যারিসে যাবার কথা বলবে, যা পুরােপুরি মিথ্যা, অথচ এমনভাবে তা বলতে হবে যেন তিথি তা অবিশ্বাস না করেসামান্যতম অবিশ্বাস করা মানেই অরিজিন্যাল ব্লুপ্রিন্টে গণ্ডগােল হয়ে যাওয়াএটা কিছুতেই হতে দেয়া যাবে না। 

এই মিথ্যা বলায় তার কোন পাপ হবে বলে সে মনে করে নাসে মিথ্যা বলবে সারভাইভুেলের জন্যেঅনেক পােকা বেঁচে থাকার জন্যে যে গাছে বাস করে সেই গাছের রঙে নিজের রঙ বদলিয়ে নেয়এতে পােকাটার কোন পাপ হয় না

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *