এরা জোকের মত লেগে
থাকে। না কিনে উপায় নেই।
তিথি মারুফকে বলল, এই, ফুলওয়ালীর হাত থেকে আমাকে বাঁচাও তাে। অসহ্য লাগছে। শাড়ি ধরে টানছে, গায়ে হাত দিচ্ছে।
মারুফ পেছন ফিরে ফুলওয়ালীর দিকে তাকিয়ে হাসল। কিছু বলল না। ফুলওয়ালী এতে আরাে উৎসাহ পেল। যদিও তার বাড়তি উৎসাহের প্রয়ােজন ছিল না।
তিথি বলল, মারুফ তুমি কি দয়া করে একটা রিকশা নেবে? এই ভিড়ে আমি হাঁটতে পারছি না।
‘আর একটু। এই রােড়ের শেষ মাথা পর্যন্ত গিয়েই রিকশা নেব।
এখন নিতে অসুবিধা কি?”
কোন অসুবিধা নেই। এরকম ভিড়ের রাস্তায় তাে আর হঁটব না। শেষ হাঁটা হেঁটে নিচ্ছি। এই দেশের ভিড়েরও যে এমন সৌন্দর্য আছে তা আগে লক্ষ্য করিনি।
“কি সৌন্দর্য? আমি তাে কোন সৌন্দর্য দেখছি না। আমি শুধু দেখছি লােকজন এসে আমার ঘাড়ে পড়ে যাচ্ছে।
মারুফ বলল, শুধু যে লােকজন আমাদের ঘাড়ে পড়ে যাচ্ছে তা না। আমরাও লােকজনদের ঘাড়ে পড়ে যাচ্ছি এবং নির্বিকার ভঙ্গিতেই পড়ছি। এসো এখন রিকশা নেয়া যাক।
ফুলওয়ালী মেয়েটা নেই। এতক্ষণ পেছনে পেছনে এসে হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল। তিথি ভেবে রেখেছিল ফুলওয়ালীকে পাঁচটা টাকা দেবে। মেয়েটা এতক্ষণ যখন লেগেছিল তখন আরেকটু কেন থাকল না?
মারুফ বলল, তুমি এইখানে পঁাড়াও আমি ওপাশ থেকে রিকশা ঠিক করে নিয়ে আসি।
‘আমিও যাই তোমার সঙ্গে? “না না। তুমি গেলে হবে না। মেয়েছেলে সঙ্গে দেখলেই বেশি ভাড়া চাইবে। ‘অল্প কয়েকটা টাকা বাঁচাবার জন্যে এত কষ্ট করার দরকার কি? ‘অল্প কয়েকটা টাকাই–বা শুধু শুধু দেব কেন?”
মারুফ রাস্তা পার হল, সে সাবধানী চোখে রিকশা খুঁজছে। যে কোন একটা রিকশা নিলেই হয় না। রিকশাওয়ালা দেখে বিচার–বিবেচনা করে ভাড়া ঠিক করতে হয়। রিকশাওয়ালা এখানে মানুষ না, ইনজিন। যে ইজিন গাড়ির বনেটের ভেতর ঢাকা থাকে না, চোখের সামনে দেখা যায়। এমন একটা ইনজিন খুঁজে বের করতে হবে — যে ক্লান্ত না হয়ে দীর্ঘ সময় প্যাডেল ঘুরাবে। যার কৌতূহল প্রায় থাকবেই
না। যে পেছনে ফিরে তাকাবে না। পেছনে কি কথাবার্তা হচ্ছে তা শােনার চেষ্টা করবে না। | তিথি দাঁড়িয়ে আছে তাে দাঁড়িয়েই আছে। মারুফের রিকশা আর ঠিক হচ্ছে না। সামান্য একটা রিকশা ঠিক করতে কারাের এতক্ষণ লাগে ?
রােদ কড়া হয়ে উঠেছে। আলাে চোখে লাগছে। তিথি তার হ্যাণ্ডব্যাগ খুলল। আছে – সানগ্লাসটা আছে। সাধারণত দেখা যায়, যেদিন সানগ্লাসটার সবচে‘ বেশি দরকার সেদিনই সেটা আনা হয় না। মারুফ মনে হয় শেষ পর্যন্ত রিকশা ঠিক করতে পেরেছে। তিথি সানগ্লাস পরে অপেক্ষা করছে।
রিকশার হুড ফেলা। মারুফের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। অন্যসময় সিগারেটের ধোঁয়ার পাশে বসতে খারাপ লাগে। আজ লাগছে না। এমন কি সিগারেটের কটু গন্ধটাও ভাল লাগছে।
মারুফ বলল, তিথি শােন। খুব মন দিয়ে শােন। আমার জরুরী কথাগুলি আমি এখন বলব।
রিকশায় বসে বলার দরকার কি? কোথাও গিয়ে বসি, তারপর বল। ‘না, রিকশাতেই শােন। জরুরী কথা চলন্ত অবস্থাতে শােনাই ভাল।
‘পঁড়াও, সিগারেটটা শেষ করে নিই। তারপর বলি।
তিথি লক্ষ্য করল, মারুফকে কেমন যেন চিন্তিত লাগছে। জরুরী কথা সে কি বলবে তা তিথি আঁচ করতে পারছে। এই কথার জন্যে তাকে চিন্তিত হতে হবে কেন?
“তিথি শােন — “শুনছি।
‘আমার হাতে সময় খুব অল্প। রিকশাতেও বেশি সময় তােমার সঙ্গে থাকতে পারব না, আবার দেশেও বেশি দিন নেই। বুঝতে পারছ ?
‘পারছি।
‘যে স্কলারশীপ নিয়ে যাচ্ছি সেটাও গরীবি ধরনের স্কলারশীপ। টাকা জমিয়ে যে একবার দেশে আসব সে উপায়ও নেই। কাজেই দেশ ছেড়ে বাইরে থাকব প্রায় চার বছরের জন্যে। এই সময়টা আমার জন্যে অল্প সময় না। আনেকখানি সময়।
‘ত তো বটেই।
‘আমি চাই যে, যাবার আগে বিয়ে করে তারপর যাব। যাতে আমার স্ত্রী আমি যাবার তিন–চার মাসের ভেতর আমার সঙ্গে জয়েন করতে পারে।
‘আইডিয়া ভাল। সবচে’ ভাল হয় সে যদি একসঙ্গে তােমার সঙ্গে যেতে পারত।
‘সেটা অবশ্যই ভাল হত কিন্তু প্রথম কথা হচ্ছে এই মুহূর্তে আমার কাছে একটা বাড়তি টিকেট কেনার টাকা নেই। কারণ আমার নিজের টিকেটই নিজেকে কিনতে হচ্ছে।”
‘ওরা টিকেট কেনার টাকা দিচ্ছে না?
না। পেঁৗছার পর ওরা টিকেটের টাকাটা রিইম্বার্স করবে, তার আগে না। ‘ও আচ্ছা।
মারুফ আরেকটা সিগারেট ধারতে ধরাতে বলল, তিথি, এখন আমি আমার বক্তব্যের শেষ অংশে চলে এসেছি — মন দিয়ে শোন।
“শুনছি।
‘আমাকে বিয়ে করলে করতে হবে চার থেকে পাঁচদিন সময়ের মধ্যে। লােকজনকে খবর দিয়ে ঢাক–ঢোল পিটিয়ে ফরম্যাল বিয়ে করব সেটা সম্ভব না। বুঝতে পারছ?
‘পারছি।
‘বিয়ের কথা বলার জন্যে একশ’ বার তােমার বাবা–মার সঙ্গে দেখা করা, তাদের বুঝানো – তাও সম্ভব না। পুরাে ব্যাপারটা তােমাকেই ম্যানেজ করতে হবে। তুমি তােমার বাবা–মা, আত্মীয়স্বজন সবাইকে বলে ঠিকঠাক করে রাখবে। একজন কাজীকে খবর দিয়ে রাখবে। আমি যাব আর বিয়ে করে চলে আসব। এটা কি সম্ভব হবে?’
তিথি বলল, হবে। তুমি এত টেন্স হয়ে থেকো না তাে। তােমাকে দেখে মনে হচ্ছে – কি ভয়াবহ সর্বনাশ হয়ে গেছে। সব ব্যবস্থা আমি করে রাখব। তােমাকে কিছু ভাবতে হবে না।
মারুফ বলল, আর ধর, তােমার বাবা–মা, আত্মীয়স্বজন এরা যদি রাজি না হল তাহলে আমরা কোটে বিয়ে করব। কি বল ?
‘কেউ অরাজি হবে না। আমি যা বলব তাই হবে।