তাহলে তাে ভালই। তিথি বলল, ও কি? তুমি আবার সিগারেট ধরালে যে ! ‘টেনশান টেনশান ... তুমি বুঝবে না। ‘কোন টেনশন না তুমি হাসি মুখে বসাে তো।
মারুফ হাসি মুখে থাকার চেষ্টা করছে পারছে না। তার আজ আজিজ সাহেবের অফিসে ঠিক এগারোটার সময় যাবার কথা। আজিজ সাহেবের দুই ছেলেকে সে পড়ায়। পড়ানাের ফাকে ফাকে ছােটখাট কাজ করে দিতে হয়। এতে বাড়তি কিছু আয় হয়। অন্য সবার মত আজিজ সাহেবও তাকে পছন্দ করেন এবং বিশ্বাস। করেন। মারুফ তাকে বলেছে তার খােজে একটা ভাল নীলা পাথর আছে। দাম অনেক কিন্তু সে সস্তায় বেচে দেবে কারণ চোরাই মাল। দশ হাজার টাকা হলেই
ছেড়ে দেবে। আসল বাজারে এর দাম ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার। আজিজ সাহেব সেই পাথর দেখতে চেয়েছেন। মারুফ আজ এগারােটার সময় তাকে পাথর দেখাবে।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১৪) হুমায়ূন আহমেদ
মজার ব্যাপার হল মারুফ পাথরের ব্যাপারে কিছুই জানে না। একজন নীলা বিক্রি করতে চায় এইটা তার তৈরি গল্প। আজিজ সাহেবের পাথরের প্রতি আগ্রহ দেখে গল্পটা বলেছিল। আগ্রহ যে এত বাড়াবাড়ি ধরনের তা বুঝতে পারে নি। বুঝতে পারলে ফট করে এই গল্প করত না। অবশ্যিই পাথরের গল্পের একটা ভাল দিক এখন দেখা যাচ্ছে। আজিজ সাহেব যদি এখন দশ হাজার টাকা দিতে রাজি থাকেন তাহলে বিয়ের খরচটা উঠে যায়।।
এই মুহূর্তে মারুফ আজিজ সাহেবের ব্যাপারটা নিয়েই ভাবছে। কি ধরনের কথাবার্তা হতে পারে তার একটা রিহার্সেল সে মনে মনে করছে।
‘আরে মারুফ সাহেব, আপনার এগারােটার সময় আসার কথা এখন প্রায় বারােটা বাজে। জিনিস এনেছেন ?”
না কেন?”
‘ব্যাটা এখন হাতছাড়া করতে চাচ্ছে না। টাল বাহানা করছে বলছে বেচবে না। মনে হয় অন্য কোন পার্টি পেয়েছে।”
‘আপনি জিজ্ঞেস করেন নি — দিতে চাচ্ছে না কেন?
‘জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিছু বলে না। ‘মারুফ সাহেব, আপনি এক কাজ করুন পনেরো হাজার টাকা নিয়ে যান। জিনিস নিয়ে আসুন। একটা ভাল নীলার আমার অনেক দিনের শখ।
‘বাদ দিন। সামান্য একটা পাথর পনেরাে হাজার টাকা। টাকা কি এত সস্তা।
‘পাথর সামান্য না। নীলা ডেনজারাস পাথর। দশ হাজারে কেন দিতে রাজি হচ্ছিল সেটাই বুঝছি না। আপনি একটা কাজ করুন। কুড়ি হাজার টাকা নিয়ে যান দেখুন – কত তে আনতে পারেন।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১৪) হুমায়ূন আহমেদ
তিথি বলল, আচ্ছা তখন থেকে তুমি এমন চুপ করে আছ কেন? কি ভাবছ? ‘কিছু না। কটা বাজে দেখতাে।”
‘আর এক ঘন্টা তােমার সঙ্গে থাকব। এগারােটার সময় আমার এক জায়গায় যেতে হবে।
মারুফকে এখন খুব হাসি খুশি দেখাচ্ছে। সে শীষ দেবার চেষ্টা করছে। তিথি বলল, শীষ দিও না তো – একজন তরুণীকে পাশে বসিয়ে শীষ দিতে দিতে যাওয়া খুব খারাপ।
মারুফ শীষ দেয়া বন্ধ করল না।
নুরুজ্জামান সকাল ৯ টা থেকে রামপুরা টিভি ভবনের গেটে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে ঢােকার পাশ নেই। নুরুজ্জামানের গায়ে ইস্ত্রী করা পায়জামা–পাঞ্জাবি। পায়ের স্যাণ্ডেল জোড়াও নতুন। স্যাণ্ডেল কেনার তার ইচ্ছা ছিল না। ফুটপাতে সাজানাে স্যাণ্ডেল দেখে কৌতূহলী হয়ে দাম করতে গেল। দাম জিজ্ঞেস করে ফিরে আসছিল, দোকানদার বলল, একটা দাম কইয়া তারপরে যান। দাম না কইয়া যান গিয়া এইটা কেমুন ধর্ম? নুরুজ্জামান অস্বাভাবিক কম দাম বলল। দোকানদার নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, লইয়া যান। এই হচ্ছে তার নতুন স্যাণ্ডেলের রহস্য।
নুরুজ্জামানের পাঞ্জাবির পকেটে পাঁচ–ছটা অশ্বত্থ গাছের কচি পাতা। ফজরের নামাজ শেষ করেই সে পাতার সন্ধানে গিয়েছিল। সােহরাওয়ার্দি উদ্যানে খানিকটা হাঁটতেই পাতা পেয়ে গেল। পাতাগুলি মিইয়ে যাচ্ছে। পাতা বেশিক্ষণ থাকে না। দু ঘণ্টার মধ্যে মিইয়ে যায়। মিয়ানাে পাতায় সুর ধরে না। ফেটে ফেটে যায়। সে বুঝতে পারছে না – আবারও কিছু টাটকা পাতা নিয়ে আসবে কি না। কামরুদ্দিন সাহেব এখনাে পাশ পাঠাচ্ছেন না কেন তাও বুঝতে পারছে না। ভুলে গেলেন নাকি? ব্যস্ত মানুষ। ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক না। উনাকে খবর পাঠাতে পারলে হত। খবর কিভাবে পাঠানো যায় তাও সে বুঝতে পারছে না।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১৪) হুমায়ূন আহমেদ
একটার সময় টিভি ভবনের দারােয়ান বলল, কতক্ষণ আর এইভাবে ঘােরাঘুরি করবেন? যান, ভিতরে চলে যান। ‘পাশ নাই তাে।‘ ‘পাশ লাগবে না। ‘অশেষ শােকরিয়া।”
নুরুজ্জামান কামরুদ্দিনের ঘর খুঁজে বের করল। ঘর তালাবন্ধ। জানা গেল, তিনি ইউনিট নিয়ে আউটডাের শুটিং–এ গেছেন। শুটিং হচ্ছে সাভারে – বড়খালি নামের এক গ্রামে। সন্ধ্যা পর্যন্ত শুটিং হবে। নুরুজ্জামান বড়খালি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সন্ধ্যা সন্ধ্যায় পৌঁছতে পারলেই হল। সমস্যাটা হল – বড়খালি জায়গাটা
কোথায় কেউ বলতে পারছে না। সাভার চলে গেলে একটা খোঁজ নিশ্চয়ই পাওয়া যায়। উপস্থিত হতে পারলে দু‘টা লাভ হবে — কামরুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা হবে। টিভির শুটিং কিভাবে করে তাও দেখা হবে। ব্যাপারটা তার দেখার শখ।
সন্ধ্যার আগে–আগে নুরুজ্জামান বড়খালি গ্রামে উপস্থিত হল। শুটিং ততক্ষণে শেষ হয়েছে। কামরুদ্দিন প্যাক আপ করে দিয়েছেন। ক্যামেরা গাড়িতে উঠছে। নুরুজ্জামান কামরুদ্দিনের কাছে গিয়ে হাসিমুখে বলল, স্নামালিকুম স্যার।
কামরুদ্দিন অন্ধকার মুখে বলল, কে ?
‘স্যার আমি নুরুজ্জামান। আপনি টিভিতে যেতে বলেছিলেন, গিয়েছিলাম, শুনলাম এখানে আছেন। চলে এসেছি। তাই তাে দেখছি। ‘শুটিং কি শেষ হয়ে গেছে স্যার?” “হ্যা’ ‘জিনিসটা দেখার শখ ছিল।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১৪) হুমায়ূন আহমেদ
কামরুদ্দিন শুকনাে মুখে বলল, বেশি বেশি শখ ভাল না। শখ কম থকা ভাল। ‘জি, তা ঠিক। স্যার, আমি তাহলে কবে দেখা করব ?” “কি জন্যে? কি ব্যাপারে ?”
নুরুজ্জামান বিস্মিত হয়ে বলল, ঐ যে স্যার পাতার বাঁশি।। ‘কিসের পাতার বাঁশি?
‘স্যার আপনার মনে নেই। ঐ যে আপনি গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলেন, আপনাকে পাতার বাঁশি শুনালাম। আপনি বললেন ঢাকায় এলে দেখা করতে।
“ও আচ্ছা। এই বারে কিছু হবে না। আগামী প্রান্তিক পর্যন্ত সব বুক হয়ে আছে। ছয় মাস পরে আসুন, দেখি কি করা যায়।
‘আষাঢ় মাসে আসব ? ‘আসুন।
টিভির বিরাট বাস এসেছে। বাস খালি পড়ে আছে। কামরুদ্দিন সাহেব ইচ্ছা করলেই নুরুজ্জামানকে সঙ্গে নিয়ে নিতে পারতেন। তা নিলেন না। নুরুজ্জামান হাঁটা ধরল। তাকে হাঁটতে হচ্ছে খালি পায়ে। নতুন স্যাণ্ডেলের ফিতা এর মধ্যেই খুলে গেছে। এখনাে চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়নি, এর মধ্যেই এই অবস্থা।