ও আচ্ছা আচ্ছা। ভুলে গিয়েছিলাম। ‘আপনি শুনতে চাইলে খাওয়ার পর খানিকক্ষণ ... ‘আরেকদিন শুনব। আজ আমার বাশি শুনতে ইচ্ছা করছে না। ‘জি আচ্ছা। ‘আপনি শুয়ে পড়ুন। ‘আপনার খাওয়া শেষ হলেই শুয়ে পড়ব। ‘ঢাকার কাজ কর্ম শেষ হয়েছে ? ‘জি না। মন্ত্রী সাহেবের সঙ্গে এখনাে দেখা করতে পারিনি।
চেষ্টা করছেন? ‘জি। উনার পিএ আমাকে টেলিফোন করে সময় দেবেন। মন্ত্রীরা খুব ব্যস্ত থাকেন। বললেই সময় দিতে পারেন না। আমি আপনাদের টেলিফোন নাম্বার দিয়ে এসেছি।
তিথি বলল, আমাদের টেলিফোন নাম্বার লােকজনদের দিয়ে বেড়াবেন না। টেলিফোন নাম্বার হল খুবই ব্যক্তিগত ব্যাপার।
‘আমি শুধু উনাকেই দিয়েছি। আর কাউকে না।
তিথি খাওয়া শেষ না করেই উঠে পড়ল। খেতে ভাল লাগছে না। সে এখন নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে খানিকক্ষণ শুয়ে থাকবে। ঠাণ্ডা মাথায় ভাববে বাবাকে পুরাে ব্যাপারটা কি ভাবে বলা যায়। যখন সমস্ত কথাবার্তা গােছানাে শেষ হবে তখন সে বাবার ঘরে যাবে। তিনি জেগে থাকলে তাকে তখনি বলবে। জেগে না থাকলে ভােরবেলা বলবে।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১৬) হুমায়ূন আহমেদ
সে নিজে ঘুমুবে না। সারারাত ভাববে। দরকার হলে পুরো ব্যাপারটা কাগজে গুছিয়ে লিখবে। ভােরবেলা নিজের মুখে কিছু না বলে কাগজটা ধরিয়ে দেবে। নরম গলায় বলবে – এখানে কিছু জরুরি কথা লেখা আছে। তুমি এখন পড়বে না। অফিসে নিয়ে যাও। অফিসে গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় পড়বে। তারপর যদি আমাকে কিছু বলতে চাও – বাসায় টেলিফোন করবে আমি বাসাতেই থাকব।
তিথি নিজের ঘরে ঢুকল। ঘরে বাতি জ্বলছিল বাতি নিভিয়ে দিল। প্রচুর কাজ পড়ে আছে রান্নাঘর কিছুই গােছানাে হয় নি। ঐ ঘরে এখন ঢুকতেই ইচ্ছা করছে না।
তিথি বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। এত ক্লান্তি লাগছে মাথার নিচে বালিশটা পর্যন্ত টেনে দিতে ইচ্ছে করছে না। তিথি চোখ বন্ধ করল আর তখনি জাফর সাহেবের গলা শােনা গেল। ভয় পাওয়া গলায় তিনি ডাকছেন – “ও তিথি তিথি। এরকম অদ্ভুত
ভঙ্গিতে বাবা তাকে ডাকছেন কেন? তিথি প্রায় ছুটে গেল।
জাফর সাহেবের ঘরে বাতি জ্বলছে। তিনি খাটের মাঝখানে উবু হয়ে বসে আছেন। তার ঘুম ভেঙ্গেছে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে। স্বপ্নের ঘাের এখনাে রয়ে গেছে। তঁার বুক ধ্বক ধুক করছে।
‘বাবা কি হয়েছে? ‘কিছু না। পানি খাব। পানি দে।
তিথি পানি এনে দিল। জাফর সাহেব এক চুমুকে পানি শেষ করে গ্রাস মেয়েকে ফেরত দিতে দিতে বললেন, এক কাজ করলে কেমন হয়রে তিথি।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১৬) হুমায়ূন আহমেদ
“কি কাজ?”
‘চল – কাল দু’জনে সিলেট চলে যাই। তােরতাে অনেক দিনের ইচ্ছা ছােটমামার চা বাগান দেখবি। বাগান দেখা হল।
‘চল যাই।
‘সকালে ট্রেন আছে। ঐ ট্রেনে যাওয়া যাবে না। অফিস থেকে ছুটি নিতে হবে। রাতের ট্রেনে যাই চল।”
‘আমি রাজি। কাল সব গুছিয়ে রাখব।
ঐ গাধাটাকে কি করবি? কোন গাধা?’ “নুরুজ্জামান।
‘ও আচ্ছা। উনাকে বাসা পাহারা দেবার দায়িত্বে রেখে যাব।
সেটা মন্দ না।‘ “তােমার কি শরীর খারাপ ভাবটা একটু কমেছে?”
‘ভাত খাবে এনে দেই? আজকের তরকারী তত খারাপ হয় নি। মুখে দিতে পারবে।
‘ভাত খাব নারে মা। ভাত ছাড়া অন্য কিছু থাকলে এনে দে।” ‘স্যাণ্ডউইচ আছে। দেব?
‘সঙ্গে এক গ্লাস দূধ দেব?’ “আচ্ছা দে।”
জাফর সাহেব বেশ আরাম করেই স্যাণ্ডউইচ খাচ্ছেন। তিথি সামনে বসে আছে। তিথির খুব মায়া লাগছে। তিথি নরম গলায় ডাকল, বাবা!
“কি রে মা।।
তিথি খানিকটা অস্বস্থি খানিকটা লজ্জা মেশানাে গলায় বললাে, বাবা শােন! আমি যদি নিজের পছন্দের একটা ছেলেকে বিয়ে করতে চাই তাহলে তুমি কি খুব রাগ করবে?
জাফর সাহেব খাওয়া বন্ধ করে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তিথি হঠাৎ অসম্ভব লজ্জা পেয়ে গেল। সে জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি এমন করে তাকিয়ে আছ কেন?
জাফর সাহেব বললেন, তাের পছন্দের কোন ছেলে আছে ?
‘আশ্চর্য কাণ্ড ! তুইতাে সেদিনের বাচ্চা মেয়ে।”
‘বাবা আমি সেদিনের বাচ্চা মেয়ে না। আমি M.Sc পরীক্ষা দিয়ে বসে আছি। আমার বয়স এখন ২৪ বৎসর তিন মাস।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১৬) হুমায়ূন আহমেদ
জাফর সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, বলিস কি তাের চব্বিশ হয়ে গেছে? ‘হয়েছে।” ‘ছেলেটা কি করে?”
এতদিন কিছু করত না। খবরের কাগজে ফ্রীল্যান্স লেখা লিখত দু‘ তিনটা প্রাইভেট টিউশুনি করে। এখন অবশ্যি ph.D করতে ফ্রান্সে যাচ্ছে। তার ইচ্ছা ছিল। আমেরিকা যাবার।
‘ছেলের বাবা কি করেন?
‘ছেলের বাবা কি করেন আমি জানি না। কখনাে জিজ্ঞেস করি নি। ছেলের বাবা কি করেন সেটা কি খুব জরুরি?”।
জাফর সাহেব চুপ করে রইলেন। তিথি বাবার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বলল, একটা মেয়ের যখন একটা ছেলেকে ভাললাগে তখন ছেলের বাবা মেয়েটির সামনে থাকে না।
‘প্রচ্ছন্ন ভাবে থাকে। ছেলের বাবার ছায়া থাকে ছেলের মধ্যে। আমার খানিকটা ছায়া কি তাের মধ্যে নেই ?
“জানি না, আছে হয়ত। আচ্ছা বাবা ধর ছেলের বাবা খুবই সামান্য একজন মানুষ। কোন অফিসের পিওন, কিংবা ধর রিকশাওয়ালা। এই অবস্থায় তুমি কি করবে? তুমি কি বলে দেবে না বিয়ে হবে না।
জাফর সাহেব বললেন, ছেলেটিকে তাের কি খুব পছন্দ?
‘আমি দেখেছি তাকে?” ‘একদিন দেখেছ। তবে তােমার নিশ্চয়ই মনে নেই। ‘ওর কোন ছবি আছে তাের কাছে ? নিয়ে আয়তাে।
তিথি লজ্জিত গলায় বলল, তুমি ভেবেছ কি আমাকে? আমি বুঝি ওর ছবি বালিশের নিচে রেখে ঘুমাই? ছবি টবি নেই। তিথি এইখানে খানিকটা মিথ্যা বলল। মারুফের ছবি তার কাছে আছে। একটা না বেশ কয়েকটা ছবি ।
দেখতে কেমন? ‘মােটামুটি। তবে এ্যাপােলাে না। ‘বুদ্ধিমান? ‘অবশ্যই বুদ্ধিমান। ‘ওর নাম কি ? ‘মারুফ।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১৬) হুমায়ূন আহমেদ
জাফর সাহেব খুশি খুশি গলায় বললেন, নামটাতাে ভাল – মা দিয়ে শুরু। যে সব ছেলের নাম মা দিয়ে শুরু হয় তাদের হৃদয় নরম থাকে। আমাদের সঙ্গে একটা ছেলে ছিল — মাহফুজ নাম, খুব ভাল ছেলে।
‘তােমার অদ্ভুত ধরণের কথাবার্তা বন্ধ করতাে বাবা।