মা দিয়ে নাম শুরু হলে ছেলে হবে হৃদয়বান। দুধটা খেয়ে শেষ কর – গ্লাস হাতে নিয়ে বসে আছ কেন?
জাফর সাহেব এক চুমুকে দুধ শেষ করলেন। তাকে এখন খুব আনন্দিত বলে মনে হচ্ছে। তিথি বলল, তুমি কিন্তু এখনাে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও নি।
‘তুই আবার কি প্রশ্ন করেছিস?”
‘এই যে বললাম – আমি যদি আমার পছন্দের একটা ছেলেকে বিয়ে করি তুমি রাগ করবে কি–না।
‘রাগ করব কেন?” ‘বিয়েটা যে খুব তাড়াতাড়ি হওয়া দরকার সেটা কি বুঝতে পারছ?” ‘না – তাড়াতাড়ি হওয়া দরকার কেন?”
‘ও বিয়ে করে তারপর যেতে চায়। যাতে ও চলে যাবার কিছুদিনের মধ্যেই আমি ওর কাছে চলে যেতে পারি। এখন বুঝতে পারছ ?”
‘পারছি। ভালই হল কাল সিলেট গিয়ে তাের মাকে নিয়ে আসি। ও ব্যবস্থা ট্যাবস্থা করুক। ছেলের আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গেও আমার কথা বলা দরকার। মামুনকে বললে ও কি তার বাবাকে নিয়ে আসতে পারবে না ?
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১৭) হুমায়ূন আহমেদ
‘মামুন না বাবা মারুফ।” । ‘ও সরি। মারুফ। ওকে বল ও যেন ইমিডিয়েটলি ওর বাবাকে খবর দিয়ে নিয়ে আসে।‘
‘ওকে বলতে পারব না বাবা। ও এখন দেশের বাড়িতে গেছে আত্মীয় স্বজন। সবার কাছ থেকে বিদায় নিবে।
“আসবে কবে? ‘তাওতাে বলতে পারছি না। দু‘ তিন দিন নিশ্চয়ই লাগবে।
জাফর সাহেব উৎসাহের সঙ্গে বললেন – নাে প্রবলেম তুই চিঠি লিখে দে। নুরুজ্জামান গাধাটা চিঠি নিয়ে ওর বাড়িতে চলে যাক। ওতাে বসেই আছে।
‘ওর বাড়ির ঠিকানা জানি না বাবা। ‘তাহলেতাে প্রবলেম হয়ে গেল। ‘কোন প্রবলেম নেই। তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাও। ‘কাল কি আমরা সিলেট যাচ্ছি?” ‘হা যাচ্ছি।
“সকালের ট্রেনে চলে যেতে পারলে হত। তাের মা’র সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে আলাপ করা দরকার। এখন কি টেলিফোনে কথা বলব?
‘এখন টেলিফোনে কথা বলার দরকার নেই। অনেক রাত হয়ে গেছে। এত রাতে টেলিফোন করলে মা রাগ করবে। তাছাড়া আমরা হঠাৎ উপস্থিত হয়ে মা’কে তো সারপ্রাইজ দেবই। আগে ভাগে কথা বলে সেই সারপ্রাইজ নষ্ট করা ঠিক না। বাবা তুমি শুয়ে পড়।
জাফর সাহেব শুয়ে পড়লেন। তিথি রান্নাঘরে ঢুকে চা বানাল। তার ক্লান্তি হঠাৎ করে কেটে গেছে। এখন কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে থেকে চা খাওয়া যায়। আজ
আকাশে চঁাদের অবস্থাটা কি কে জানে?
চা–টা চমৎকার হয়েছে। কাপ শেষ হবার পর মনে হল — বিরাট মগভর্তি এক মগ চা বানালে ভাল হত। অনেকক্ষণ ধরে খাওয়া যেত। টেলিফোন বাজছে। এত রাতে কে টেলিফোন করবে? আজে বাজে কল না তাে ? ইদানিং গভীর রাতে দুষ্ট প্রকৃতির কিছু লােকজন টেলিফোন করে বিরক্ত করে।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১৭) হুমায়ূন আহমেদ
তিথি ভয়ে ভয়ে বললাে, হ্যালাে।
ও পাশ থেকে মারুফ বলল, তিথি জেগে আছ? ‘সেকি তুমি দেশে যাও নি?”
“কেন?”
‘যাবার জন্যে ব্যাগ গুছিয়ে ঘর থেকে বের হয়েই দেখি – পিতাজী। রিকশা থেকে নামছেন ?
‘কে নামছেন। ‘আমার বাবা। “ও আচ্ছা। উনি কি এখন ঢাকায়?” “হ্যা ঢাকায়। ‘কোথায়? তােমার এখানে? ‘া আমার এখানেই। ‘ক’ দিন থাকবেন বলতাে?”
কয়েকদিন নিশ্চয়ই থাকবেন। কেন বলতাে?”
তিথি আনন্দিত ভঙ্গিতে বলল, আমি বাবাকে সব কথা বললাম। বাবা উনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন। ভালই হয়েছে উনি এখন ঢাকায়। তুমি কি কাল ভােরে তাকে আমাদের এখানে নিয়ে আসবে? আমরা এক সঙ্গে সকালে নাশতা খাব। মারুফ চিন্তায় পড়ে গেল। বাবাকে নিয়ে হঠাৎ এই সমস্যা হবে সে বুঝতে পারে নি। একটা মিথ্যা ঢাকতে এখন পরপর অনেকগুলি মিথ্যা বলতে হবে। প্রতিটি মিথ্যাই খুব গুছিয়ে বলতে হবে। যেন যুক্তিতে কোন খুঁত না থাকে।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১৭) হুমায়ূন আহমেদ
‘হ্যালাে কথা বলছ না কেন? নিয়ে আসতে পারবে সকালে?” ‘পারারতাে কথা। তবে আমি নিশ্চিত না।‘ ‘নিশ্চিত না কেন?
‘বাবা এসেই অকারণে আমার সঙ্গে ঝগড়া করলেন। নিতান্ত ফালতু বিষয় নিয়ে হৈ চৈ। রাগারাগি। আমি নাকি ছমাস ধরে তার চিঠির কোন জবাব দিচ্ছি না। শেষ পর্যন্ত চিন্তিত হয়ে তাঁকে চলে আসতে হয়েছে।
‘চিন্তিত হওয়াটাই তাে স্বাভাবিক। তুমি ছ’ মাস চিঠি দেবে না আর উনি চিন্তিত হতে পারবেন না ?”।
‘অবশ্যই চিন্তিত হতে পারবেন তবে তার মানে এই না যে তিনি রিকশাওয়ালার সামনে আমাকে গাধা বলবেন।
তিথি হাসতে হাসতে বলল, উনার স্বভাবও দেখি আমার বাবার মত। আমার বাবাও রেগে গেলে এমন গালাগালি করেন। তবে তার রাগ অবশ্যি বেশিক্ষণ থাকে।
বাবার রাগ ভাদ্র মাসের বৃষ্টির মত ক্ষণ স্থায়ী।
‘আমার বাবারটা স্থায়ী। আমার উপর রাগ করেই রাতে ভাতটাত না খেয়ে ঘুমুতে গেছেন। ঘুম আসছে না। পেটে প্রচণ্ড ক্ষিধে ঘুম আসার কথা না। এপাশ ওপাশ করছেন। তিনি তাঁর ব্যাগ গুছিয়ে মাথার কাছে রেখে দিয়েছেন। এটা হচ্ছে বিশেষ এক লক্ষণ – বাবা ফজরের নামাজ পড়েই বাসা ছেড়ে চলে যাবেন।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১৭) হুমায়ূন আহমেদ
বল কি ? ‘আমি প্রাণপন চেষ্টা করব উনাকে আটকে রাখতে। যদি পারি তাহলে অবশ্যই সকাল আটটার মধ্যে তােমাদের বাসায় এনে উপস্থিত করব। যদি না পারি তাহলে আমি নিজেই আসব। তাতে কাজ হবে ?
‘হা হবে।‘ ‘তােমাকে যে জন্যে টেলিফোন করেছিলাম সেটাইতাে বলা হয় নি। “কি জন্যে টেলিফোন করেছ ?” ‘চার লাইনের কবিতা শুনাতে চেয়েছিলাম — ‘শােনাও।” “থাক এখন না। কাল সকালে যখন আসব তখন শােনাব।
না এক্ষুণী শুনাও। ‘নিঝুম রাতের জ্যেৎস্না এসে স্মৃতির ভাড়ার লােটে
ফাগুন হাওয়ায় সিঁদকাঠিটা বুকের মধ্যে ফোটে হৃদয় ফেটে কাব্য ঝরে ব্যথার শােনিত পারা রূপকথা নয়, রূপকথা নয়, এই জীবনের ধারা।
জাফর সাহেব আটটার আগেই অফিসে চলে যান। আজ সাড়ে ন‘টা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। ছেলের বাবা আসবে তাঁর সঙ্গে কথা বলা দরকার। কি কি বলবেন তাও গুছিয়ে রেখেছেন। তিনি বলবেন, ছেলে চলে যাবে মেয়ে একা থাকবে এটা তার পছন্দ না। দুজন এক সঙ্গেই যাক। টিকিটের টাকা তিনি দেবেন। এটা কোন ব্যাপার।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১৭) হুমায়ূন আহমেদ
তঁার ক্ষিধে লেগেছে। এখনাে নাশতা করেন নি। মেহমানদের সঙ্গে নিয়ে নাশতা করবেন এই ভেবে রেখেছেন।
তিথি বলল, তুমি খেয়ে নাও বাবা। তারা বােধহয় আসবেন না। ‘আসবে না কেন?
‘বাবা আর ছেলের মধ্যে রাগারাগি হয়েছে। মনে হয় বাবার রাগ ভাঙ্গানাে যাচ্ছে । তুমি খেয়ে নাও।
‘ওরা যদি এসে দেখে আমরা নাশতা টাশতা খেয়ে বসে আছি সেটা কি একটা নিতান্তই অনুচিত কাজ হবে না?‘।