কিছুদিন এই ভাবে থাকার পর লােকলজ্জার ভয়েই হােক কিংবা মেয়েদের কারণেই হােক আবার তোমরা একত্রে থাকা শুরু করতে পারবে।
‘শায়লা এটা চায়?”
সে যা চায় তা ভয়াবহ। সে চায় ডিভাের্স। তারতাে এম্নিতেই মাথা গরম। উকিল ডেকে এনে হুলুস্থুল কাণ্ড ! বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে এটাতে রাজি করিয়েছি।”
‘আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে ?
‘শায়লা তােমাকে একটা চিঠি দিয়েছে। চিঠি আমার সঙ্গেই আছে। চিঠিটা পড়। চিঠিতে সব লেখা আছে। আমি নিজেও পড়েছি। উচিত হয়নি, তবু পড়লাম।
সম্বােধন হীন চিঠি। ইংরেজিতে লেখা। জাফর সাহেবের মনে হল তিনি অপরিচিত কোন মেয়ের লেখা চিঠি পড়ছেন। তার পা কাঁপতে লাগল। শায়লা এসব কি শুরু করেছে। শুরুর লাইনটি হল –
I always longed for Love, never got it... আমি সবসময় ভালবাসার জন্যে তৃষ্ণিত ছিলাম, কখনো তা পাইনি। তুমি আমার জীবনে রােবট স্বামী হিসেবে এসেছ। আমাদের দুজনের মধ্যে সামান্যতম মিলও ছিল না। আমি বেড়াতে পছন্দ করি, তুমি ঘরে বসে থাকতে পছন্দ কর। আমি গান ভালবাসি – গান শুনলে
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১৯) হুমায়ূন আহমেদ
তােমার মাথা ধরে যায়। তােমার সঙ্গে থেকে থেকে আমার নিজের জীবনটাও রােবটের মত হয়ে গেছে। তুমি আমাকে বদলে দিয়েছ। আমি তােমাকে বদলাতে পারি নি। বরং আমি তােমার মধ্যে ক্রোধ ঘৃণা এইসব নিম্নস্তরের আবেগ তৈরী করেছি যা বেড়ে বেড়ে এখন এই পর্যায়ে এসেছে যে তুমি আমার গায়ে হাত তুলতে দ্বিধা করছ না। গায়ে হাত তােলার ব্যাপারটি যে এবারই প্রথম ঘটেছে তা না। আগেও ঘটেছে। তােমার মনে নেই। সেই সময় তুমি রাগে অন্ধ হয়ে থাক। এমন রাগের মুহূর্তে মানুষ স্মৃতি শূন্য হয়ে পড়ে। সে কি করে
করে তা সে বলতে পারে না। প্রচণ্ড রাগ তােমার আগে ছিল না। যতই দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে। আমার জন্যেই যে বাড়ছে তাও আমি বুঝতে পারছি। আমিতাে নির্বোধ নই। কোনকালে ছিলাম না। বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত তুমি কখনাে আমাকে ভালবেসেছ বলে আমি মনে করি না। তুমি আমাকে সহ্য করে গিয়ে এই পর্যন্ত। এখন তাও পারছ না। পরে কি হবে ভাবতেও আমার ভয় হচ্ছে । কাজেই আমি মনে করি “আর কখনােই আমরা একত্রে বাস করব
” এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে হবে। এই সিদ্ধান্ত দু’জনের জন্যেই মঙ্গল জনক হবে। যে ফ্ল্যাট বাড়িতে আমরা বাস করছি তুমি নিশ্চয়ই জান সে ফ্ল্যাট বাড়ি আমার টাকার কেনা। আমার বাবা আমাকে যে টাকা দিয়েছেন সেই টাকায়। কাজেই এ বাড়িতে তােমার কোন অধিকার থাকার কথা না। তুমি অন্য কোথাও চলে যাবে। আমাদের টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করার তােমার প্রয়ােজন নেই। আমার যা আছে তা দিয়ে আমি আমার মেয়েদের নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারব।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১৯) হুমায়ূন আহমেদ
সাইদুর রহমান বললেন, চিঠি পড়েছ?
‘শায়লার সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়েছে। সেই সব আর তােমাকে বলতে চাচ্ছি না। তােমার কিছু বলার আছে কি না বল।।
‘না।‘ ‘বেশ আমি তাহলে উঠব। যাবার আগে এক কাপ চা খেয়ে যাবেন বলেছিলেন। দিতে বলি। ‘না থাক। চিঠিটা টেবিল থেকে পড়ে গেছে। তুলে রাখ। এই চিঠি অন্যের হাতে
যাওয়া ঠিক না। তিথি দুপুরে বাবার কাছে এসে দেখে জাফর সাহেব গম্ভীর মুখে বসে আছেন। তিথি বলল, কি হয়েছে বাবা?
জাফর সাহেব চোখ তুলে তাকালেন। মনে হল মেয়েকে চিনতে পারছেন না। তিথি বলল, তােমার কি হয়েছে বাবা? ‘কিছু হয়নি। ‘আমি ছবি নিয়ে এসেছি।” “কিসের ছবি?” ‘পাসপাের্ট সাইজ ছবি।
ও আচ্ছা, আচ্ছা। চল যাই ... । ‘ট্রেনের টিকিট করেছ? না, টিকিট করা হয়নি। ‘কখন করবে? ‘শরীরটা ভাল লাগছে না। যেতে ইচ্ছে করছে না। ‘তুমি যাবে না? জাফর সাহেব ইতস্ততঃ করে বললেন, এক কাজ কর। তুই চলে যা।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১৯) হুমায়ূন আহমেদ
আমি একা যাব? ‘হ্যা। ফাস্ট ক্লাসে যাবি। দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকবি। অসুবিধা কি? গাধাটাকে সঙ্গে করে নিয়ে যা।
‘তুমি সত্যি যাবে না ?
‘ঠিক করে বল তাে – তােমার কি এর মধ্যে মা‘র সঙ্গে কোন কথা হয়েছে?
‘আমার দিকে তাকিয়ে বল। অন্যদিকে তাকিয়ে বলছ কেন? কথা হয়েছে মা‘র সঙ্গে?‘
জাফর সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত গলায় বললেন, না, কোন কথা হয়নি। চল যাই। দু‘টার সময় অফিস বন্ধ করে দেয়।
‘তােমাকে অন্য রকম লাগছে। কি হয়েছে বল তাে?” “কিছু হয়নি। কিছু হয়নি।
পাসপাের্ট অফিসের কাজ সেরে জাফর সাহেব বললেন, চল, তাের সঙ্গে খানিকক্ষণ ঘুরি। আজ আর অফিসে ফেরত যাব না।
তিথি বিস্মিত হয়ে বলল, আমার সঙ্গে কোথায় যাবে?
‘তােরা কোথায় কোথায় বেড়াতে যাস তা তাে জানি না। তুই আমাকে কোথাও নিয়ে যা। তার আগে চল কোথাও খেতে যাই।‘
‘তুমি তাে দুপুরে কিছু খাও না। ‘আজ খাব। খিদে লেগেছে। ‘চাহনীজ খাবে?”
‘তুমি সত্যি তাহলে সিলেট যাবে না? ‘না। তুই যা। গাধাটাকে সাথে করে নিয়ে যা। ‘তুমি একা একা থাকবে ? ‘। এক দিনেরই তাে ব্যাপার। তাের তাে চলেই আসবি। ‘আমিও থেকে যাই। মাকে টেলিফোন করে আসতে বলি।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(১৯) হুমায়ূন আহমেদ
‘টেলিফোন করলে আসবে না। তােকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হবে। আমাকে যেভাবে সব গুছিয়ে বললি, তাের মাকেও সেইভাবে বলবি। তারপর সঙ্গে করে নিয়ে আসবি। নুরুজ্জামান গাধাটাকে খবর দেয়া দরকার। গাধাটা এখন আছে কোথায় ?
‘দিনে কোথায় থাকে তা তাে বাবা জানি না। জিজ্ঞেসও করিনি। রাতে ফিরে আসে। হাতে করে দুটা আনারস ঝুলিেেয় আনে। ভাত খায় না। আনারস খায়।
‘বলিস কি! ‘সত্যি বাবা।
তিথি মিট মিট করে হাসছে। তিথির হাসি হাসি মুখের দিকে আনন্দ এবং বিস্ময় নিয়ে জাফর সাহেব তাকিয়ে আছেন। বিস্ময়ের কারণ হল, তার মেয়ে যে এত সুন্দর করে হাসে তা তিনি আগে কখনাে লক্ষ্য করেন নি। অন্য মেয়ে দুটি কেমন করে হাসে কে জানে? এরাও কি তিথির মত সুন্দর করে হাসে?