দুপুরবেলা চাইনীজ রেস্টুরেন্টগুলি ফাঁকা থাকে। আজ আরাে ফাঁকা। দোতলার হলঘরে একটা লােকও নেই। তিথি বলল, অন্য কোথাও চল তাে বাবা। ফাঁকা ঘরে চাহনীজ খেতে ভাল লাগে না।
‘ফাঁকাই তাে ভাল। নিরিবিলি। ‘হােটেলের নিরিবিলি অসহ্য লাগে। হােটেল থাকবে গমগমা, লােকজনে ভর্তি। ‘তাহলে চল লােকজনে ভর্তি গমগমা হােটেল খুঁজে বের করি। ‘চল যাই গাড়ি ছেড়ে দাও বাবা। আমরা রিকশা করে ঘুরব।”
জাফর সাহেব গাড়ি ছেড়ে দিলেন। রিকশায় উঠেই তিথি বলল, তুমি কি : চাইনীজ খাওয়া নিয়ে এই গল্পটা শুনেছ?
‘কোন গল্প ?”
ঢাকা শহরে এক লােক হঠাৎ আলাউদ্দিনের চেরাগ হাতে পেয়ে গেল। চেরাগে ঘসা দিতেই দৈত্য এসে উপস্থিত। দৈত্য বলল, জাহাপনা, কি চাই বলুন। হুকুম করুন। হুকুম করলেই হুকুম তামিল হবে।
লােক বলল, প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। কিছু খাবার আন। দৈত্য বলল, কি খাবার খাবেন হুকুম করুন হুজুরে আলা। “চাইনীজ খাব। দৈত্য অস্বস্তির সঙ্গে বলল, সত্যি চাইনীজ খাবেন? “অবশ্যই খাব। তােমার অসুবিধা আছে ? ‘জি না। তবে একটু সময় লাগবে। “লাগুক। খাবার যেন ফ্রেশ হয়। “অবশ্যই ফ্রেশ হবে।”
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(২০) হুমায়ূন আহমেদ
লােকটা খাবার জন্যে অপেক্ষা করছে। ঘণ্টা খানেক পর দৈত্য ঘাড়ে করে এক আধবুড়াে চাইনীজ নিয়ে উপস্থিত। দৈত্য বলল, হুজুরে আলা, চাইনীজ খেতে চেয়েছেন। চাইনীজ ধরে নিয়ে এসেছি। একেবারে পিকিং থেকে এনেছি বলে বিলম্ব হয়েছে। এখন ব্যাটাকে খান। আমি দেখি।
জাফর সাহেব শব্দ করে হাসলেন। তিথি হাসছে। রিকশাওয়ালা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে। জাফর সাহেব তাঁর হাসি থামাতে পারছেন না। যতবারই হাসি থামাতে যান। ততবারই চোখের সামনে ভেসে উঠে আধবুড়াে চাইনীজটার হতভম্ব মুখ।
তিথি বলল, বাবা থাম তাে। অনেক হেসেছ।
জাফর সাহেব হাে হাে, হা হা করে হাসতেই লাগলেন। | “প্লীজ বাবা, থাম। তােমাকে নিয়ে তাে ভাল যন্ত্রণায় পড়া গেল। আগে জানলে কে তােমাকে হাসির গল্প বলতাে !
‘মা, আরেকটা গল্প বল তাে। হাে হো হাে। হি হি হি।
তিখি অবাক হয়ে বাবাকে দেখছে। আশ্চর্য, এত হাসি ! তিথি তার বাবাকে এমন করে কখনো হাসতে দেখেনি। তাঁর শরীর ভাল তো? অসুস্থ মানুষ মাঝে মাঝে এমন করে, সামান্য কারনে প্রচুর হাসে। প্রচুর কাদে। তিথি প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে বলল, বাবা, নুরুজ্জামান সাহেবকে যে নিয়ে যাব – উনি থাকবেন কোথায় ? ধর, এক রাত আমাদের সিলেট থাকতে হল। তখন কি করব? উনাকে কি কোন হােটেলে পাঠিয়ে দেব? | জাফর সাহেব হাসি থামাতে পারছেন না। অনেক কষ্টে হাসির ফাঁকে ফাঁকে বললেন, গাধাটাকে ধাক্কা দিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দিবি – হি হি হি।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(২০) হুমায়ূন আহমেদ
কি কথার কি উত্তর ! কি হয়েছে বাবার?
নুরুজ্জামান মুগ্ধ চোখে চিড়িয়াখানার জলাধারের পাশে দাঁড়িয়ে। জলহস্তী পরিবারের কাণ্ডকারখানায় সে মুগ্ধ ও বিস্মিত। কিছুক্ষণ পর পর সে বলছে, “কি আজিব জানােয়ার !‘ তার ইচ্ছা করছে কলা বা বাদাম কিনে এদের খাওয়ায়। বাইরে সাইনবাের্ড ঝুলছে – “চিড়িয়াখানার পশুদের কিছু খাওয়াবেন না।” নােটিশ না থাকলে সে অবশ্যই কলা বা এই জাতীয় কিছু কিনে খাওয়াতো। এরা ফল–মূল খায় কিনা কে জানে। পানির জানােয়ার, মাছ খাওয়ারই কথা। তবে পানির জানােয়ার হলেও শুকনাতেও এরা অনেকক্ষণ থাকে।
কাজেই স্থলভূমির খাবার খেতেও পারে। কাকে জিজ্ঞেস করা যায়? চিড়িয়াখানার লােকজন নিশ্চয়ই জানবেন। নুরুজ্জামান চিড়িয়াখানার লােকজনদের খোঁজে বের করত। তার হাতে সময় বেশি নেই। সন্ধ্যা ৭ টায় মন্ত্রী সাহেবের সঙ্গে এপয়েন্টমেন্ট হয়েছে। পি. এ সাহেবের স্ত্রী ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কথা ছিল – এপয়েন্টমেন্ট হয়ে গেলে পি, এ সাহেব টেলিফোন করে জানাবেন। তা জানান নি। টেলিফোন নাম্বার হারিয়ে ফেলেছিলেন। নুরুজ্জামান আবার খোঁজ নিতে গিয়ে ব্যাপারটা জানল। ভাগ্যিস খোঁজ নিতে গিয়েছিল! মিনিস্টার সাহেবের আবার জাপান চলে যাবার কথা।
জলহস্তী কি খায় এই তথ্য নুরুজ্জামান বের করতে পারছে না। এই পর্যন্ত দু’জনকে জিজ্ঞেস করল। প্রথমজন তাকে রীতিমত অপমানই করল। সে বলল, জলহস্তী কি খায় তা দিয়ে আপনার কি দরকার? আপনি কি জলহস্তী?
দ্বিতীয়জন এ জাতীয় অপমান করল না। সে বলল, জানি না। সে বালতিতে করে কুচি কুচি করে কাটা লাউ নিয়ে যাচ্ছে। কাকে খাওয়াবে কে জানে? লাউ কে খায়?
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(২০) হুমায়ূন আহমেদ
নুরুজ্জামান ঠিক করল আরেকদিন এসে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকবে। এর মধ্যে একসময় না একসময় জলহস্তীকে খাবার দেবেই। তখন দেখে নিলেই হবে। আজ থাকা যাবে না। মিনিস্টার সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে হবে। এক্ষুণি রওনা দেয়া দরকার।
শিক্ষামন্ত্রী চৌধুরী নবী নেয়াজ খান বিরক্ত মুখে বসে আছেন। তাঁর আলসার আছে। বিকেলের পর থেকে আলসারের ব্যথাটা জানান দেয়। ব্যথা তেমন তীব্র নয়, তবে অস্বস্তিকর। বিকেল থেকে আলসারের ব্যথার থেকেও তীব্র ব্যথা শুরু হয়। সেটা হল দর্শনার্থীর যন্ত্রণা। দেশটার কি হয়েছে কে জানে? অতি তুচ্ছ বিষয়। নিয়ে আজকাল লােকজন মন্ত্রীর কাছে চলে আসে।
গতকাল একজন এসেছিল – তার টেলিফোনে বিল বেশি হচ্ছে। বিল বেশি হচ্ছে তাে তিনি কি করবেন? তিনি টেলিফোনের মন্ত্রী না। তার হল শিক্ষা দপ্তর। শিক্ষা সংক্রান্ত ব্যাপারে তার কাছে আসা যায়। তাও ছোটখাট কিছু নিয়ে না। বড় কিছু —তা আসবে না। তুচ্ছ সব ব্যাপার নিয়ে আসবে – সময় নষ্ট করবে। গত সপ্তাহে একজন আসল ক্লাস ফোরের ধর্ম বইয়ে ভুল আছে এই খবর নিয়ে। একা আসে নি। সঙ্গে বিরাট দল। তুমুল হৈ–চৈ।
‘স্যার বলুন, আপনি বলুন, আরবিতে কি ‘ভ আছে?”