তিনি তাৎক্ষণিকভাবে মনে করতে পারলেন না আরবীতে ‘ভ আছে কি–না। মনে মনে আলিফ বে তে ছে পড়তে লাগলেন –
‘স্যার আপনি বলুন – আছে ভ’?” তিনি অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, মূল ব্যাপারটা বলুন।
‘সূরা নাস–এর বাঙলা উচ্চারণ লিখেছে – “মিন শাররিল ওয়াস ওয়াসিল খান্নাসিল লাযি ইউয়াসভিসু ফী সুদূরিম্নাস। দেখুন অবস্থা – ইউয়াসভিসু। লেখা উচিত ইউয়াসফিসু। ‘ফ’য়ের জায়গায় হয়েছে ভ।।
তিনি বললেন, “।। ‘জরুরী ব্যবস্থা নিতে হবে স্যার। ছাত্ররা খােদার পাক কালাম ভুল শিখবে –?” তিনি আবারও বললেন, হুঁ।
‘আপনি স্যার এই বই নিষিদ্ধ করুন। নতুন করে বই ছাপা হবে, তারপর ছাত্ররা পড়বে।
‘ছােটখাট ভুল তাে থাকতেই পারে। শিক্ষকরা সেগুলি শুধরে দেবেন।
‘আপনি কি বলছেন স্যার ! খােদার পাক কালামে ভুল থাকবে? এটা কি স্যার বিবেচনার কথা হল ? ...‘
প্রতিদিন এরকম কিছু সমস্যা নিয়ে তাকে সময় নষ্ট করতে হয়। আর শুনতে হয় তদবির। কত ধরনের তদবির নিয়ে লােকজন যে আসে তা আল্লাহ জানেন এবং তিনিই জানেন।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(২১) হুমায়ূন আহমেদ
স্থানীয় দারােগা ঘুষ খাচ্ছে। তাকে বদলি করতে হবে।
‘সেই একই দারােগা অত্যন্ত সৎ। তাকে এখানেই রাখতে হবে।
এজি অফিসে টিএ বিল অটিকে রেখেছে। বিল পাশ করতে হবে। “অমুক ছেলে সন্ত্রাসী মামলায় পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। অতি ভাল ছেলে। পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে। শেষ রাতে ফজরের নামাজ পড়তে বের হয়েছিল, টহল পুলিশ ধরে ফেলেছে। লম্বা চুল দেখে সন্দেহ করেছে। আশেপাশের লােকজনের শত্রুতাও আছে। তারাও তাল দিয়েছে। কিন্তু ছেলে সরকার পার্টি করে। আপনি স্যার এক্ষুণি আই, জি, সাহেবকে টেলিফোন করুন। আপনি না বললে আমাদের অন্য সাের্স ধরতে হবে।
চৌধুরী সাহেব সন্ধ্যা থেকে রাত ন‘টা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে দেন–দরবার শুনেন। সন্ধ্যা থেকে তার মাথাধরা শুরু হয়। রাত ন‘টায় সেই ব্যথা অসহনীয় হয়ে উঠে। তিনি এক সঙ্গে দু‘টা প্যারাসিটামল এবং একটা সিডাকসিন খেয়ে বাতি নিভিয়ে চুপচাপ চেয়ারে বসে থাকেন। মাথাব্যথা খানিকটা কমলে এশার নামাজ পড়েন। চার রাকাত নামাজ, তাতেই গণ্ডগোল হয়ে যায়। ক’ রাকাত পড়েছেন তার হিসাব থাকে না। তার ধারণা, প্রতিবারই চার রাকাতের জায়গায় তিনি হয় তিন রাকাত কিংবা পাঁচ রাকাত পড়েন। একবার অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করলেন, তিনি রুকুতে দাঁড়িয়ে সুরা ফাতিহা বাদ দিয়ে আত্তাহিয়াতু পড়েছেন। মা–খারাপের লক্ষণ ছাড়া আর কি?
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(২১) হুমায়ূন আহমেদ
আজ সন্ধ্যা থেকেই তার মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে। তিনি পি, এ.–কে বললেন, আজ আর কাউকে পাঠিও না। শরীর খারাপ।
‘কাউকেই না ?” “আচ্ছা পাঠাও এতক্ষণ ধরে বসে আছে।
‘আপনি স্যার শুধু শুনে যান। আমিও বলে দেব যেন বেশিক্ষণ আপনাকে বিরক্ত না করে।
‘রাত আটটার পর আর কাউকে পাঠাবে না। ‘জি আচ্ছা স্যার।
নুরুজ্জামান মন্ত্রীর ঘরে ঢুকল রাত ঠিক আটিটায়। ঢুকেই সে বলল, স্যার, আপনার কি শরীর খারাপ? | চৌধুরী সাহেব দর্শনপ্রার্থীর মধ্যে এই প্রথম এ–জাতীয় কথা শুনলেন। অন্যরা ঘরে ঢুকেই তাদের সমস্যার কথা বলতে শুরু করে। সময় নষ্ট করতে চায় না।
চৌধুরী সাহেব বললেন, আপনি বসুন।
নুরুজ্জামান বলল, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনার শরীরটা খুবই খারাপ। স্যার, আমি আরেকদিন আসব।
‘শরীর এমন কিছু খারাপ না। বসুন।
নুরুজ্জামান বলল, আপনার ঘরে খুব ভয়ে ভয়ে ঢুকেছিলাম। মন্ত্রীর ঘর। মন্ত্রীদের আগে শুধু দূর থেকে দেখেছি।
‘ভয় কেটেছে ? ‘জি স্যার, কেটেছে।
চৌধুরী সাহেব বেল টিপে দু‘কাপ চা দিতে বললেন। নুরুজ্জামান বলল, স্যার, আমি চা খাই না। গ্রামাঞ্চলে থাকি। চায়ের অভ্যাস হয় নাই। | ‘অভ্যাস না হলেও খান। মন্ত্রীর ঘরের চা খেয়ে দেখুন কেমন লাগে। দেশে ফিরে গল্প করতে পারবেন। বলতে পারবেন, মন্ত্রী সাহেব আমাকে খুব খাতির করেছেন। নিজের হাতে চা বানিয়ে খাইয়েছেন।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(২১) হুমায়ূন আহমেদ
“জি আচ্ছা স্যার, চা খাব।”
চৌধুরী সাহেব চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আবেগশূন্য গলায় বললেন, এখন বলুন দেখি কি তদবির নিয়ে এসেছেন।
‘একটা স্কুলের ব্যাপারে এসেছি স্যার। আমি একটা গার্লস স্কুল দিয়েছি। নাম দিয়েছি বেগম রােকেয়া গার্লস হাইস্কুল। পায়রাবন্দের বেগম রােকেয়া।
‘ব্যাখ্যা লাগবে না। বেগম রােকেয়ার নাম আমি জানি। শিক্ষামন্ত্রী মানেই যে মূখ হতে হবে এমনতাে কথা নেই।‘
‘আগে নাম ছিল মমিনুন্নেছা গার্লস হাইস্কুল। মমিনুন্নেছা আমার ফুপুর নাম। তারপর শেষ রাতে একটা স্বপ্ন দেখে নামটা বদলে দিলাম।”
‘স্বপ্নে দেখলেন বেগম রােকেয়া আপনাকে বলছেন – তার নামে স্কুলের নাম রাখতে?
‘জি–না। ব্যাপারটা কি আপনাকে বলব?”
বলুন। যতক্ষণ আমি চা খাব ততক্ষণই বলবেন। চা শেষ হওয়া মাত্র আপনার ইতিহাস বর্ণনা বন্ধ করবেন এবং চলে যাবেন। পারবেন না?
‘পারব স্যার। আমার ফুপু মমিনুন্নেছা খুব দুঃখী মহিলা স্যার। বিয়ের দু‘ বছরের মধ্যে স্বামী মারা গিয়েছিল। তার তখন দুটা জমজ সন্তান – একটা ছেলে একটা মেয়ে। মেয়েটার নাম সাবেরা, ছেলেটার নাম ...”
‘নামের দরকার নেই। বলে যান। নাম বলতে গিয়ে সময় নষ্ট করছেন। আমার চা প্রায় শেষ হয়ে আসছে।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(২১) হুমায়ূন আহমেদ
জমজ বাচ্চা দুটাকে নিয়ে স্বামীর সংসারে পড়ে রইলেন। কোথাও গেলেন না। বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। বিয়েও করলেন না। বাচ্চা দু‘টার বয়স যখন সাত বৎসর তখন দুজন একসঙ্গে পানিতে ডুবে মারা গেল। ভাইটা পানিতে পড়ে
গিয়েছিল, তাকে বাঁচাতে গিয়ে বােনটাও মারা গেল।
‘বলেন কি?” তারপরেও ফুপু দীর্ঘদিন বেঁচে গেলেন। মারা গেলেন গত বৎসর শ্রাবণ মাসে। মরার সময় তার সব জমি জমা আমার নামে লিখে দিয়ে গেলেন। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমি ভাবলাম, ফুপু খুব কষ্ট নিয়ে পৃথিবী থেকে গেছেন। তার জন্য যদি ভাল কিছু করতে পারি তাহলে তার আত্মা শান্তি পাবে। তখন তার সবটা জমি আমি স্কুলের জন্যে দিয়ে দিলাম। স্কুলের নাম দিলাম ফুপুর নামে। তারপর স্বপ্ন দেখলাম।