‘আপনি তাহলে একজন পাতাবাদক? ভাল ভাল।
‘একদিন শুনাবাে আপনাকে। পাতা পাওয়া গেলে হয়। সব পাতায় আবার সুর উঠে না। শহর বন্দর জায়গা পাতা পাওয়া মুশকিল। আশে পাশে অশ্বথ গাছ আছে ?”
জানি না আছে কি না। ‘আমগাছের পাতা দিয়েও হয়। খুব ভাল হয় না।
দেখি অশ্বখের পাতা জোগাড় করব। আছে নিশ্চয়ই। এত বড় শহর থাকারতেী কথা।‘
তিখি বলল, আপনাকে এত কষ্ট করার দরকার নেই। যদি গ্রামে কখনাে যাই তখন শুনাবেন।
‘আর আপনারা কি কখনাে গ্রামে যাবেন। আপনারা হয়েছেন শহরবাসী। শহরের নেশা একবার লেগে গেলে গ্রাম ভাল লাগে না। শহরের নেশা বড় খারাপ নেশা।
তিথি বলল, তাও ঠিক। তবে আমার গ্রাম খুব খারাপ লাগে না। একবার গিয়ে দাদাজানের সঙ্গে দুসপ্তাহ ছিলাম।
‘আমি জানি উনি আমাকে বলেছেন। উনি আমাকে খুব পেয়ার করেন। ও আচ্ছা ভুলেই গেছি উনি আপনাকে একটা পত্র দিয়েছেন। বলে দিয়েছেন জরুরী। আমি নিয়ে আসি।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৫) হুমায়ূন আহমেদ
নুরুজ্জামান উঠতে গেল। তিথি বলল, খাওয়া শেষ করুন। তারপর দেবেন।
নুরুজ্জামান খাওয়া শেষ করল। খাওয়ার শেষ পর্বও দর্শণীয়। প্লেটে খানিকটা পানি ঢেলে সেই পানি দিয়ে প্লেট পরিষ্কার করে, সেই পানি ডালের মত চুমুক দিয়ে খাওয়া। রীতিমত গা গিনগিন করা ব্যাপার। তিথি তাকিয়ে আছে বলেই লজ্জিত গলায় বলল, নবী এ করিম এই ভাবে খেতেন। এতে আয়ু বৃদ্ধি হয়।
“ও আচ্ছা। ‘ঘরে কি পান আছে?”
“জ্বি না। মা পান খান। তিনি বাসায় নেইতাে – তাই তাঁর পানের সরঞ্জামও নেই। আচ্ছা আমি পানের ব্যবস্থা করছি।‘
“কি ভাবে করবেন ?
‘রিসিপসানে লােকজন আছে – এদের বললে ওরা পান এনে উপরে দিয়ে যাবে।
“সামান্য পানের জন্যে আপনাকে নিচে নামার দরকার নাই।” ‘আমাকে নিচে নামতে হবে না। আমি ইন্টারকমে বলে দেব।
তিথি কিছু খেতে পারল না। ভাতের গামলা ফ্যানের নিচে এতক্ষণ ছিল বলেই ভাত ঠাণ্ডা কড়কড়া হয়ে গেছে। চিবানাে যায় না – এমন অবস্থা। তরকারীও কোনটিতে লবন, হয় নি। নুরুজ্জামান প্রচুর লবন কেন নিয়েছে তা এখন বােঝা যাচ্ছে। তিথির খুব ক্লান্তি লাগছে। অনেক কাজ বাকি। টেবিল থেকে থালাবাসন সরানাে, পরিস্কার করা। রান্নাঘরও নােংরা হয়ে আছে। শােবার আগে সব ঝকঝকে না করে রাখলে ভাল ঘুম হয় না। ঘুমের মধ্যেও বার বার মনে হয় কি যেন বাকি। থাকল। কি যেন বাকি থাকল।
সব কাজ শেষ করে এক পেয়ালা চা হাতে তিথি বারান্দায় এসে বসল। ঘুমুতে যাবার আগে এটি হচ্ছে তার শেষ রুটিন। ন’ তলার দক্ষিণমুখী বারান্দা। খুব হাওয়া। এক একবার মনে হয় বেতের চেয়ার সহ তাকে উল্টে ফেলে দিচ্ছে। আকাশের কাছাকাছি বাস করার অনেক সুবিধার একটি হচ্ছে – হাওয়ার সঙ্গে খেলার সুযােগ। আজ আবার জোছনা হয়েছে। বারান্দা চাদের আলােয় মাখামাখি। জোছনাটাও বেশ অদ্ভুত। মনে হচ্ছে শুধু বারান্দায় জোছনা হয়েছে। আর কোথাও নয়।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৫) হুমায়ূন আহমেদ
টেলিফোন বাজছে। ওঠে ধরতে ইচ্ছা করছে না। অনেক রাতে খুব আজে বাজে
ধরনের কল আসে। আবার মারুফও মাঝ রাত ছাড়া টেলিফোন করে না। ষাট ভাগ সম্ভাবনা কুৎসিত মানসিকতার কোন মানুষ টেলিফোন করেছে। তিথি টেলিফোন ধরা মাত্র সে বলবে, আপা এত রাত পর্যন্ত জেগে আছেন কেন? কি করছেন? তারপরই
শুরু করবে অশ্লীলতম কিছু কথা বার্তা।
আবার চল্লিশভাগ সম্ভাবনা হল – মারুফ টেলিফোন করেছে। টেলিফোন না ধরা মানে সেই সম্ভাবনা অগ্রাহ্য করা। তিথি তা পারবে না। তিথি কেন কোন মেয়েই পারবে না। তিথি টেলিফোন ধরে ভয়ে ভয়ে বলল,
‘হ্যালাে। ‘তিথি ?”
“তােমাদের টেলিফোন নষ্ট না–কি বলতাে? সন্ধ্যাবেলা অনেকবার চেষ্টা
‘সন্ধ্যাবেলা টেলিফোনের লাইন খােলা ছিল। ‘ও আচ্ছা। তুমি এখনাে ঘুমাও নি?”
করছিলে কি?” বারান্দায় বসে জোছনা দেখছিলাম।‘ ‘জোছনা আছে নাকি?
তােমার গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে খুব ক্লান্ত। “কিছুটা ক্লান্ততো বটেই। অনেক কাজ করলাম। রান্না বান্না ঘর গােছানাে। ‘তােমার মা এখনাে আসেন নি ?
‘তােমার মা–কি খুব রাগী মহিলা? তাকে দেখে কিন্তু মনে হয় না।”
‘মা মােটেই রাগী মহিলা না। তাঁর সব রাগ শুধু বাবার উপর। আর কারাে উপর তার কোন রাগ নেই।
তােমার মা‘র প্রসঙ্গে কথা তােলায় তুমি আবার রাগ করনিতাে ? ‘না। আমার সবচে ভাল গুন হল আমি কখনাে রাগ করি না। ‘কারাে উপর তােমার রাগ হয় না?”
হয়। তবে আমার একটা টেকনিক আছে। ঐ টেকনিক ব্যবহার করে রাগটাকে অভিমানে নিয়ে যাই। তারপর খানিকক্ষণ কাদি। অভিমান দূর হয়ে যায়।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৫) হুমায়ূন আহমেদ
‘তুমি দেখি একেবারে বইয়ের ভাষায় কথা বলছ — সত্যি কি এরকম কর ?
করি। ‘কি ভাবে কাদো? ভেউ ভেউ করে না নিঃশব্দ কান্না ?
‘ছােট বেলায় ভেউ ভেউ করেই কাঁদতাম। এখন নিঃশব্দে কাদতে চেষ্টা করি। পারি না। কি করি জান – বাথরুমে ঢুকে যাই। আমার একটা খুব নরম নীল রঙের তােয়ালে আছে ঐ তােয়ালেতে মুখ ঢেকে কাদি। যাতে কান্নার শব্দ কেউ শুনতে না পারে।
‘পানির ট্যাপ ছেড়ে রাখলেই হয়। পানি পড়ার শব্দে কান্নার শব্দ ঢাকা পড়ার কথা।
তিথি হাসতে হাসতে বলল, আমার হচ্ছে নীল তােয়ালে টেকনিক। সবার টেকনিকতো এক রকম না।
“তােমার কি ঘুম পাচ্ছে তিথি ?”
‘সারারাত, কথা বলতে পারবে? ‘অন্য কারাে সঙ্গে পারব না – তবে তােমার সঙ্গে পারব।
‘বেশ আজ তাহলে সারারাত কথা বলব। কত মানুষ কত ধরণের রেকর্ড করে। আমরা সারারাত ননষ্টপ কথা বলে রেকর্ড করব। রাজি আছ?
‘আছি। ‘বেশ তাহলে শুরু করা যাক – প্রথম বাক্যটি কি আমি বলব?”
‘তুমি এত ভাল কেন তিথি ?”