তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৬) হুমায়ূন আহমেদ

তিথির চোখে পানি এসে গেলটেলিফোনের এই এক সুবিধা কথা বলতে বলতে চোখে পানি এসে গেলেও ও পাশের মানুষটা বুঝতে পারবে না। 

তিথির নীল তোয়ালে

হ্যালাে তিথি, হ্যালাে আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? হ্যালাে .. তিখি বলল, শুনতে পাচ্ছিহ্যালাে, হ্যালাে তিথি হ্যালাে...আমি তাে তােমার কথা শুনতে পাচ্ছিপরিস্কার শুনতে পাচ্ছিতিথি তিথি ... । 

ওপাশ থেকে অনেকক্ষণ হ্যালাে হ্যালাে শােনা গেলটেলিফোনের খটখট শব্দ হল, তারপর পুরােপুরি নিঃশব্দনষ্ট টেলিফোন থেকে শোঁ শোঁ যে আওয়াজ হয় তাও হচ্ছে না| তিথি আবারও বারান্দায় এলএখন আর চাঁদটা দেখা যাচ্ছে নাআর্কিটেক্ট বাড়ি ডিজাইন করার সময় পূর্বপশ্চিম কত কিছু খেয়াল করেনকোন দিকে রােদ 

আসবে, কোন দিকে আসবে না সব তঁাদের নখদর্পণে ... কিন্তু চাঁদের আলো সম্পর্কে তারা কিছু ভাবেন না কেন? চাঁদটা কি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ না? এমন একটা বারান্দা কি তারা বানাতে পারেন না যেখানে যতক্ষণ চাঁদ থাকবে ততক্ষণ চাঁদের আলাে থাকবে

তিথির হাই ওঠছে বিছানায় যেতেও ইচ্ছা করছে নামনে হচ্ছে, আজ রাতে তার ঘুম হবে নাতাকে জেগে থাকতে হবেতিথি নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ কবলবাথরুমে গা ধােলশীত নেমে গেছেপানি কনকনে ঠাণ্ডাইচ্ছা করলেই গরম পানি মিশিয়ে নিতে পারেইচ্ছা করছে নাশরীরে এক ধরনের যন্ত্রণা হচ্ছেএই যন্ত্রণা দূর করতে ঠাণ্ডা পানি লাগবে। 

তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৬) হুমায়ূন আহমেদ

বিছানায় শুতে গিয়ে তার মনে হল দাদাজানের চিঠিটা পড়া হয়নিখাবার ঘরের টেবিলে চিঠিটা পড়ে আছেচিঠির যদি প্রাণ থাকত তাহলে সে নিশ্চয়ই বলত, এই যে তিথি, এখনও তুমি আমাকে পড়ছ না কেন? এত কিসের অবহেলা ? তিথির গায়ে নাইটিএমন একটা স্বচ্ছ পােশাকে কি খাবার ঘরে যাওয়া ঠিক হবে ? যদি হুট করে লােকটা খাবার ঘরে ঢুকে পড়ে? এই পােশাকে তাকে দেখলে লােকটা কি ভাববে কে জানে ? হয়ত তার ছােটখাট একটা স্ট্রোক হয়ে যাবে। 

বসার ঘরে কেউ নেইতিথি চিঠি নিয়ে শােবার ঘরে ঢুকে গেলতিথির দাদাজান লিখেছেন – 

তিথি সােনামণি, বয়সের টি পর্যায়ে মানুপরিত্যক্ত হয়আমি সেই পর্যায়ে পৌছিয়াছিআমার সঙ্গ এখন সবার বিরক্তি উৎপাদন রেনিজের পুত্র কন্যারাও এখন আর মাপত্রের জবাব দেয় নাতাহারা পত্র পাঠ করে কিনা সেই বিষয়েও আজ আমার সন্দেহ হয়তােমার বাবাকে গত চার মাসে মােট ছয়টি পত্র দিয়াছিসে একটিরও জবাব দেয় নাই। 

তােমার কথা স্বতন্ত্রগত চার মাসে তােমাকে আমি তিনটি পত্র দিয়াছিতুমি তিনটিরই যে শুধু জবাব দিয়াহ তাই না নিজ থেকেও একটি পত্র লিখিয়াছতােমার পত্রগুলি বার বার করিয়া পড়িয়াছি এবং বড়ই তৃপ্তি লাভ করিয়াছি। 

তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৬) হুমায়ূন আহমেদ

তােমার পত্রপাঠে মনে হয়, তুমি তােমার জীবন নিয়া বড়ই চিন্তিতএত চিন্তিত হইবার কিছু নাইযাহা ঘটিবার তাহা ঘটিবেআল্লাহপাক মানুষকে সীমিত স্বাধীন সত্তা দিয়া পাঠাইয়াছেনমাদের কাজ করিতে হইবে এই সীমিত স্বাধীনতায়মূল চাবিকাঠি 

তাঁহার হাতেকাজেই এত চিন্তা করিয়া কি হইবে? যাহা হােক, আমি তােমাকে আধ্যাত্মবাদ শিখাইতে চাই নাসব কিছুরই একটা সময় আছেআমি শুধু তােমাকে মন স্থির রাখিবার উপদেশ দিতেছিমনকে কাঁটা কম্পাসের মত ইতে হইবেকম্পাসের কাঁটা সাময়িকভাবে নাড়া খাইতে পারে বে তাহার দিক কিন্তু ঠিকই থাকে। 

এক্ষণে অন্য একটি বিষয়ের অবতারণা করিতেছিনুরুজ্জামান ছেলেটিকে ভাল করিয়া লক্ষ্য করআমার অত্যন্ত ছন্দের ছেলেতাহার কাজকর্ম নির্বোধের ন্যায়তবে সে নিবোধ নয়! তাহার কম্পাসের কাঁটার ন্যায় স্থিরএই সমাজে যাহা সচরাচর দেখা যায় নাতুমি গত চিঠিতে জানিতে চাহিয়াছিলে কোন ধরনের ছেলে তােমার বিবাহ করা উচিতনুরুজ্জামান হচ্ছে সেই ধরনের ছেলেআমার ধারণা, নুরুজ্জামানের কোন একজনের সঙ্গে তোমাবিবাহের ফল অত্যন্ত শুভ হইবেআমি সরাসরি নুরুজ্জামানের কথালিতে পারিতাম, বলিলাম না কারণ তােমাদের বাস্তবতা আমি জানিআমার ত্রপাঠে রাগ করিও না বা বিরক্তও হইও না

তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৬) হুমায়ূন আহমেদ

আমি যাহা ভাল বিবেচনা করিয়াছি তাহাই বলিয়াছি...  বাকি চিঠি আর পড়তে ইচ্ছে করছে নাতিথি চিঠিটা দলা পাকিয়ে কাবার্ডের দিকে ছুঁড়ে মারলদাদাজানের বুদ্ধিশুদ্ধি কি পুরােপুরিই গেছে

জাফর সাহেবের ঘরে এয়ারকুলার সারাবার মিস্ত্রী এসেছেগােটা ভাদ্রমাস এয়ারকুলার বন্ধ ছিলদেনদরবার করেও মিস্ত্রী পাওয়া যায় নিএখন শীত পড়ে গেছেবিকেলে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে রীতিমত ঠাণ্ডা লাগে, আর এখন কিনা এসেছে এয়ারকুলার ঠিক করতেতাঁর ইচ্ছা করছে মিস্ত্রী দুজনকেই ঘাড় ধরে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে তালাবন্ধ করে রাখতেবাথরুমের শাওয়ারটা খুলে দিতে পারলে ভাল হতসারাক্ষণ শাওয়ারের পানিতে ভিজুকসব ইচ্ছা পূর্ণ হবার নয়অপরিচিত কারাের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা তাঁর ধাতে নেইখারাপ ব্যবহার শুধু মাত্র প্রিয় এবং পরিচিতজনদের সঙ্গেই করা যায়তিনি মিস্ত্রী দুজনের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, চা খাবেন

দুজন একসঙ্গে বলল, খামু স্যার। 

এদের আসার পর থেকেই জাফর সাহেব দেখছেন, এদের মতের মিল হচ্ছে নাএকজন এক রকম করতে বলছে তাে অন্যজন আরেক রকম বলছেচা খাবার প্রশ্ন দুজনকেই তাৎক্ষণিকভাবে একমত হতে দেখা গেলজাফর সাহেব চায়ের কথা বললেনতিনি কাজে মন বসাতে পারছেন নাপ্রায় দুশ পৃষ্ঠার এক গাবদাফাইল তার সামনে পড়ে আছে। আজ দিনের মধ্যে ফাইল পড়ে নােট দিতে হবেপড়ায় মন বসছে নামিস্ত্রী দুজন বিরক্ত করছেঅন্য কোথাও বসে যে কাজ করবেন সেই উপায় নেইতিনি নিজের ঘর ছাড়া বসতে পারেন নাদম আটকে 

আসে

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *