তিথির চোখে পানি এসে গেল। টেলিফোনের এই এক সুবিধা কথা বলতে বলতে চোখে পানি এসে গেলেও ও পাশের মানুষটা বুঝতে পারবে না।
‘হ্যালাে তিথি, হ্যালাে – আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? হ্যালাে .. তিখি বলল, শুনতে পাচ্ছি। ‘হ্যালাে, হ্যালাে তিথি – হ্যালাে...‘ ‘আমি তাে তােমার কথা শুনতে পাচ্ছি। পরিস্কার শুনতে পাচ্ছি।” ‘তিথি তিথি ... ।
ওপাশ থেকে অনেকক্ষণ হ্যালাে হ্যালাে শােনা গেল। টেলিফোনের খটখট শব্দ হল, তারপর পুরােপুরি নিঃশব্দ। নষ্ট টেলিফোন থেকে শোঁ শোঁ যে আওয়াজ হয় তাও হচ্ছে না। | তিথি আবারও বারান্দায় এল। এখন আর চাঁদটা দেখা যাচ্ছে না। আর্কিটেক্ট বাড়ি ডিজাইন করার সময় পূর্ব–পশ্চিম কত কিছু খেয়াল করেন। কোন দিকে রােদ
আসবে, কোন দিকে আসবে না সব তঁাদের নখদর্পণে ... কিন্তু চাঁদের আলো সম্পর্কে তারা কিছু ভাবেন না কেন? চাঁদটা কি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ না? এমন একটা বারান্দা কি তারা বানাতে পারেন না যেখানে যতক্ষণ চাঁদ থাকবে ততক্ষণ চাঁদের আলাে থাকবে?
তিথির হাই ওঠছে – বিছানায় যেতেও ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে, আজ রাতে তার ঘুম হবে না। তাকে জেগে থাকতে হবে। তিথি নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ কবল। বাথরুমে গা ধােল। শীত নেমে গেছে। পানি কনকনে ঠাণ্ডা। ইচ্ছা করলেই গরম পানি মিশিয়ে নিতে পারে। ইচ্ছা করছে না। শরীরে এক ধরনের যন্ত্রণা হচ্ছে। এই যন্ত্রণা দূর করতে ঠাণ্ডা পানি লাগবে।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৬) হুমায়ূন আহমেদ
বিছানায় শুতে গিয়ে তার মনে হল – দাদাজানের চিঠিটা পড়া হয়নি। খাবার ঘরের টেবিলে চিঠিটা পড়ে আছে। চিঠির যদি প্রাণ থাকত তাহলে সে নিশ্চয়ই বলত, এই যে তিথি, এখনও তুমি আমাকে পড়ছ না কেন? এত কিসের অবহেলা ? তিথির গায়ে নাইটি। এমন একটা স্বচ্ছ পােশাকে কি খাবার ঘরে যাওয়া ঠিক হবে ? যদি হুট করে ঐ লােকটা খাবার ঘরে ঢুকে পড়ে? এই পােশাকে তাকে দেখলে লােকটা কি ভাববে কে জানে ? হয়ত তার ছােটখাট একটা স্ট্রোক হয়ে যাবে।
বসার ঘরে কেউ নেই। তিথি চিঠি নিয়ে শােবার ঘরে ঢুকে গেল। তিথির দাদাজান লিখেছেন –
তিথি সােনামণি, বয়সের একটি পর্যায়ে মানুষ পরিত্যক্ত হয়। আমি সেই পর্যায়ে পৌছিয়াছি। আমার সঙ্গ এখন সবার বিরক্তি উৎপাদন করে। নিজের পুত্র কন্যারাও এখন আর আমার পত্রের জবাব দেয় না। তাহারা পত্র পাঠ করে কি–না সেই বিষয়েও আজ আমার সন্দেহ হয়। তােমার বাবাকে গত চার মাসে মােট ছয়টি পত্র দিয়াছি। সে একটিরও জবাব দেয় নাই।
তােমার কথা স্বতন্ত্র। গত চার মাসে তােমাকে আমি তিনটি পত্র দিয়াছি। তুমি তিনটিরই যে শুধু জবাব দিয়াহ তাই না – নিজ থেকেও একটি পত্র লিখিয়াছ। তােমার পত্রগুলি বার বার করিয়া পড়িয়াছি এবং বড়ই তৃপ্তি লাভ করিয়াছি।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৬) হুমায়ূন আহমেদ
তােমার পত্রপাঠে মনে হয়, তুমি তােমার জীবন নিয়া বড়ই চিন্তিত। এত চিন্তিত হইবার কিছু নাই। যাহা ঘটিবার তাহা ঘটিবে। আল্লাহপাক মানুষকে সীমিত স্বাধীন সত্তা দিয়া পাঠাইয়াছেন। আমাদের কাজ করিতে হইবে এই সীমিত স্বাধীনতায়। মূল চাবিকাঠি
তাঁহার হাতে। কাজেই এত চিন্তা করিয়া কি হইবে? যাহা হােক, আমি তােমাকে আধ্যাত্মবাদ শিখাইতে চাই না। সব কিছুরই একটা সময় আছে। আমি শুধু তােমাকে মন স্থির রাখিবার উপদেশ দিতেছি। মনকে কাঁটা কম্পাসের মত হইতে হইবে। কম্পাসের কাঁটা সাময়িকভাবে নাড়া খাইতে পারে তবে তাহার দিক কিন্তু ঠিকই থাকে।
এক্ষণে অন্য একটি বিষয়ের অবতারণা করিতেছি। নুরুজ্জামান ছেলেটিকে ভাল করিয়া লক্ষ্য কর। আমার অত্যন্ত পছন্দের ছেলে। তাহার কাজকর্ম নির্বোধের ন্যায়। তবে সে নিবোধ নয়! তাহার মন কম্পাসের কাঁটার ন্যায় স্থির। এই সমাজে যাহা সচরাচর দেখা যায় না। তুমি গত চিঠিতে জানিতে চাহিয়াছিলে কোন ধরনের ছেলে তােমার বিবাহ করা উচিত। নুরুজ্জামান হচ্ছে সেই ধরনের ছেলে। আমার ধারণা, নুরুজ্জামানের মত কোন একজনের সঙ্গে তোমার বিবাহের ফল অত্যন্ত শুভ হইবে। আমি সরাসরি নুরুজ্জামানের কথাও বলিতে পারিতাম, বলিলাম না কারণ তােমাদের বাস্তবতা আমি জানি। আমার পত্রপাঠে রাগ করিও না বা বিরক্তও হইও না।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৬) হুমায়ূন আহমেদ
আমি যাহা ভাল বিবেচনা করিয়াছি তাহাই বলিয়াছি।... বাকি চিঠি আর পড়তে ইচ্ছে করছে না। তিথি চিঠিটা দলা পাকিয়ে কাবার্ডের দিকে ছুঁড়ে মারল। দাদাজানের বুদ্ধিশুদ্ধি কি পুরােপুরিই গেছে ?
জাফর সাহেবের ঘরে এয়ারকুলার সারাবার মিস্ত্রী এসেছে। গােটা ভাদ্রমাস এয়ারকুলার বন্ধ ছিল। দেন–দরবার করেও মিস্ত্রী পাওয়া যায় নি। এখন শীত পড়ে গেছে। বিকেলে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে রীতিমত ঠাণ্ডা লাগে, আর এখন কি–না এসেছে এয়ারকুলার ঠিক করতে। তাঁর ইচ্ছা করছে মিস্ত্রী দু‘জনকেই ঘাড় ধরে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে তালাবন্ধ করে রাখতে। বাথরুমের শাওয়ারটা খুলে দিতে পারলে ভাল হত। সারাক্ষণ শাওয়ারের পানিতে ভিজুক। সব ইচ্ছা পূর্ণ হবার নয়। অপরিচিত কারাের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা তাঁর ধাতে নেই। খারাপ ব্যবহার শুধু মাত্র প্রিয় এবং পরিচিতজনদের সঙ্গেই করা যায়। তিনি মিস্ত্রী দু’জনের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, চা খাবেন?
দু‘জন একসঙ্গে বলল, খামু স্যার।
এদের আসার পর থেকেই জাফর সাহেব দেখছেন, এদের মতের মিল হচ্ছে না। একজন এক রকম করতে বলছে তাে অন্যজন আরেক রকম বলছে। চা খাবার প্রশ্ন দু‘জনকেই তাৎক্ষণিকভাবে একমত হতে দেখা গেল। জাফর সাহেব চায়ের কথা বললেন। তিনি কাজে মন বসাতে পারছেন না। প্রায় দুশ পৃষ্ঠার এক গাবদা। ফাইল তার সামনে পড়ে আছে। আজ দিনের মধ্যে ফাইল পড়ে নােট দিতে হবে। পড়ায় মন বসছে না। মিস্ত্রী দুজন বিরক্ত করছে। অন্য কোথাও বসে যে কাজ করবেন সেই উপায় নেই। তিনি নিজের ঘর ছাড়া বসতে পারেন না। দম আটকে
আসে।