জাফর সাহেব ভুরু কুঁচকে বললেন, আপনাদের কাজ শেষ করতে কতক্ষণ লাগবে?
‘ধরেন খুব বেশি হইলে আধা ঘণ্টা।
জাফর সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, আধঘণ্টা অপেক্ষা করা যেতে পারে। এই ফাঁকে শায়লার সঙ্গে কি কথা বলে নেবেন? বিনীত ভঙ্গিতে বলবেন, “সব
অপরাধ আমার। বাসায় ফিরে আস।” দু‘টি মাত্র বাক্য, বলা কঠিন হবার কথা না। “সব অপরাধ আমার” – এই বাক্যটা বলাটাই সমস্যা। তিনি জানেন, সব অপরাধ
তাঁর না। এটা বলা মানে মিথ্যা কথা বলা।
মিথ্যা বলা মানে আত্মার ক্ষয়। জন্মের সময় মানুষ বিশাল এক আত্মা নিয়ে পৃথিবীতে আসে। মিথ্যা বলতে যখন শুরু করে তখন আত্মা ক্ষয় হতে থাকে। বৃদ্ধ বয়সে দেখা যায়, আত্মার পুরােটাই ক্ষয় হয়ে গেছে। জাফর সাহেব সতেরাে বছর বয়সের পর থেকে আত্মর ক্ষয়রোধ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। মানুষের সব চেষ্টা সফল হয় না। এটিও হচ্ছে না। পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। শায়লার সঙ্গে প্রায়ই মিথ্যা বলতে হচ্ছে। এই যে তিনি বলবেন, ‘সব অপরাধ আমার এতে আত্মার
অনেকটা ক্ষয় হবে।
জাফর সাহেব টেলিফোনের ডায়াল ঘুরালেন। তার মেজো মেয়ে ইরা ধরল। হাসিখুশি গলা। বাড়ি ছেড়ে এই যে এতদিন বাইরে আছে তার কোন রকম ছাপ মেয়ের গলায় নেই।
‘হ্যালো বাবা, কেমন আছি?” ‘ভাল। “তুমি কি অফিস থেকে টেলিফোন করছ?
‘বাবা শােন, আমরা সিলেট বেড়াতে যাচ্ছি। ছােট মামার চা বাগানে। ‘কবে যাবি?
‘আজ রাতের ট্রেনে, সুরমা মেইল। মামা বলছিল গাড়িতে করে যেতে। বাই রােড। মা রাজি হল না।
“ও আচ্ছা।
‘বাবা শোন, তুমি আমাদের সামনের মাসের হাত খরচের টাকাটা এডভান্স দিতে পারবে? একদম খালি হাতে সিলেট যাচ্ছি তো। ভাল লাগছে না।
‘ক’দিন থাকবি?”
‘ক’দিন থাকব বলতে পারছি না। মা যতদিন থাকতে চায় ততদিন। বাবা, তুমি হাত–খরচের টাকা দেবে কি দেবে না তা তাে বললে না?
পাঠিয়ে দেব। ‘থ্যাংকস। ‘তাের মা কি আছে?” ‘আছে। কথা বলবে?
‘ধর তুমি, ডেকে দিচ্ছি। তবে মা তােমার সঙ্গে কথা বলবে কি–না তা তাে জানি । মনে হয় বলবে না। যা রেগে আছে!
‘তুই ডেকে দে। “আচ্ছা।
জাফর সাহেব টেলিফোন হাতে বসে আছেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, মিস্ত্রী দু‘জন কাজ ফেলে হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। টেলিফোনের কথা শুনছে। এই দুটার মাথা কামিয়ে দিলে কেমন হয়? শায়লার গম্ভীর গলা পাওয়া গেল –
‘হ্যালাে।
জাফর সাহেব বললেন, কেমন আছ? ‘আমি কেমন আছি সেটা দিয়ে তোমার দরকার নেই। কি বলতে চাচ্ছ বল।” ‘সিলেট না–কি যাচ্ছ?” ‘কেন – কোন অসুবিধা আছে ? স্বামীর অনুমতি ছাড়া নড়তে পারব না। ‘অনুমতির কথা তাে আসছে না। যেতে চাচ্ছ যাবে।” শায়লা গম্ভীর গলায় বললেন, রাখি?
“শােন শায়লা, হ্যালাে – আমি অনেক ভেবে–টেরে দেখলাম, অপরাধটা আসলে আমার। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি, সংসারে চলার পথে ...?
খট করে শব্দ হল। শায়লা টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। জাফর সাহেবের দিকে মিস্ত্রী দুজন এখনাে তাকিয়ে আছে। তিনি এমন ভাব করলেন যেন টেলিফোনে খুব আনন্দজনক সংবাদ পেয়েছেন। তিনি হাসিমুখে বললেন, আপনার কাজ কতদূর?
‘কাজ বন্ধ স্যার। ‘বন্ধ কেন ? ‘পার্টস নাই।” ‘পার্টস নাই, তাহলে শুধু শুধু বসে আছেন কেন?” ‘স্যার চলে যাব ?”
‘অবশ্যই চলে যাবেন। এক থেকে পাঁচ গুনার আগেই যাবেন। ওয়ান টু থ্রি ফোর....
‘মেশিনটা জায়গায় ফিট কইরা থুইয়া যাই ? ‘নো। এক্ষুণি বিদায় হতে হবে। রাইট নড়ি।
জাফর সাহেব বুঝতে পারছেন তাঁর রাগ বিপদসীমা অতিক্রম করতে যাচ্ছে। এক্ষুণি ভয়াবহ কিছু হবে। এদের উপর রাগ করাটা অর্থহীন। স্ত্রীর উপর রাগ তিনি এদের উপর ঝাড়তে পারেন না ....
এমন এক বিপজ্জনক মুহূর্তে নুরুজ্জামান দরজা ঠেলে মাথা বের করে বলল,
স্যার আসি?
জাফর সাহেব থমথমে গলায় বললেন, কি ব্যাপার!
‘কোন ব্যাপার না স্যার। আপনার অফিসের ঠিকানা ছিল। ভাবলাম দেখা করে যাই। মৌচাক মার্কেটে যাচ্ছিলাম।
“আমার সঙ্গে কি কোন দরকার আছে?” *জি না স্যার। ‘তাহলে এলে কেন?”
নুরুজ্জামান ভয়ে ভয়ে বলল, মন্ত্রী সাহেবের পিএ–র সঙ্গে কথা হয়েছে। উনি আবার নেত্রকোনায় বিবাহ করেছেন।
উনি নেত্রকোনা বিয়ে করেছেন তাতে কি হয়েছে?” যােগাযােগের একটা সুবিধা হয়ে গেল।
জাফর সাহেব হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এতটা নির্বোধ কোন সুস্থ মানুষ হতে পারে তা তার ধারণায় নেই। চতুস্পদরা এরচে কিছু বেশি বুদ্ধি ধরে।
নুরুজ্জামান বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সামনের চেয়ারে বসেছে। জাফর সাহেব যে রেগে আগুন হয়ে আছেন তাও তার মাথায় ঢুকছে না। নুরুজ্জামান উৎসাহের সঙ্গে বলল, পি এ সাহেবের বাসায় একদিন চলে যাব। একটা ব্যবস্থা তখন হবেই।
“হুট করে একজন অপরিচিত মানুষের বাসায় উঠে যাবে? “হুট করে যাব না। আগে টেলিফোন করব। টেলিফোন নাম্বার নিয়ে এসেছি।‘
জাফর সাহেব লক্ষ্য করলেন নুরুজ্জামান টেলিফোন সেটটার দিকে তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে এখান থেকে টেলিফোন করবে এই মতলব করেই এসেছে। এই যদি মতলব হয় তাহলে তাকে খুব নির্বোধ বলা যাবে না। জাতে মাতাল হলেও তালে ঠিক
আছে।
‘স্যার একটা টেলিফোন করব?’ ‘কাকে করবে পি এ সাহেবের স্ত্রীকে?
‘জ্বী না। আমাদের দেশের একজন মানুষ আছে রামপুরায় বাসা। উনি আমাকে একটা সুযােগ করে দিবেন বলেছিলেন।
“কিসের সুযাে?’ ‘বাঁশি বাজাবার সুযােগ।