আমার একটু শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা দরকার। কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছি আপা।‘
‘আচ্ছা, আমি বলে দেব। ও ব্যবস্থা করে দেবে। ‘আপা, আপনার অনেক মেহেরবানী। এখন পানিটা খাই।
নুরুজ্জামান এক নিঃশ্বাসে সরবতের গ্লাস শেষ করে বরফের টুকরা চিবাতে
তিথির নীল তােয়ালে–৩
লাগল। দাঁত দিয়ে বরফ ভাঙার কচকচ শব্দ হচ্ছে। ভদ্রমহিলা বললেন, আরেক গ্লাস এনে দেই?
“জ্বি আচ্ছা।
‘আপনি একটা কাগজে আপনার নাম–ঠিকানা লিখে দিন। ও একটা পাশ দিয়ে রাখবে। আপনি সেক্রেটারীয়েটে ঢুকে ওর সঙ্গে দেখা করবেন। ও নিশ্চয়ই ব্যবস্থা করবে।
কবে ? ‘আগামীকাল দশটায় আসুন।
‘জ্বি না। আগামীকাল আসতে পারব না। আগামীকাল টিভিতে আমার একজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা। উনার নাম কামরুদ্দিন। উনি আমাকে একটা
অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে দিবেন। পাতার বাঁশি। আমি পাতার বাশি বাজাই।
ও আচ্ছা। তাহলে একটা কাগজে আপনার নাম–টাম লিখে দিন। কোন টেলিফোন নাম্বার কি আছে যাতে ও আপনার সঙ্গে যােগাযােগ করতে পারে?
‘জ্বি আছে।
‘টেলিফোন নাম্বার লিখে রেখে যান। ও আপনার সঙ্গে কথা বলে একটা এপয়েন্টমেন্ট করবে।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৯) হুমায়ূন আহমেদ
‘আপা, তাহলে উঠি। ‘আরেক গ্লাস পানি খাবার কথা না? বসুন, পানি নিয়ে আসি।
তৃষ্ণা চলে গেছে আপা।
নুরুজ্জামান হাসছে। ভদ্রমহিলাও হাসছেন। বিদায় নেবার সময় ভদ্রমহিলাকে পুরােপুরি হকচকিয়ে দিয়ে নুরুজ্জামান তাকে কদমবুসি করে ফেলল। নুরুজ্জামানের পকেট থেকে সানগ্লাস, চাবির রিং এবং ভাংতি পয়সা গড়িয়ে পড়ল।
তিথি দুপুরে দুজনের জন্যে ভাত বেঁধেছিল। সে আর নুরুজ্জামান। জাফর সাহেব দুপুরে বাসায় খেতে আসেন না। কেনটিন থেকে একটা স্যাণ্ডউইচ আর কলা এনে খান। | নুরুজ্জামান দুপুরে আসেনি। এক গাদা ভাত ফ্রীজে ঢুকিয়ে রাখতে হয়েছে। ফেলতে মায়া লাগছে বলেই ফ্রীজে ঢুকিয়ে রাখা। সে ভাল করেই জানে শেষ পর্যন্ত ফেলে দিতে হবে। ফ্রীজের ভাত গরম করলে কেমন শক্ত হয়ে যায়। চিবানো যায় না। নতলায় কোন ভিখিরী আসে না। কাজেই ভিখিরীকে ভাত দিয়ে দেয়ারও প্রশ্ন আসে না। ফ্রীজের ঠাণ্ডা ভাত গরম করারও হয়ত কোন কায়দা আছে। সে তা।
জানে না। মা নিশ্চয়ই জানেন। তিথি ঠিক করে রেখেছে মা’কে টেলিফোনে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করবে। এটা আসলে তার একটা অজুহাত। মা‘র সঙ্গে কথা বলার অজুহাত।
টেলিফোন সেই যে কাল রাতে নষ্ট হয়েছে এখনাে ঠিক হয়নি। পাশের ফ্ল্যাট থেকে মা’কে টেলিফোন করতে হবে। নীলক্ষেত এক্সচেঞ্জেও জানাতে হবে। অফিসে যাবার সময় বাবাকে বলে দিলে তিনি একটা ব্যবস্থা করতেন। বাবাকে বলার কথা তিথির মনে পড়েনি।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৯) হুমায়ূন আহমেদ
একা একা ভাত খাওয়ার মত খারাপ ব্যাপার আর হয় না। একমাত্র পশুরাই খাবার একা খেতে পছন্দ করে। মানুষ পারে না।
দুপুরে তিথি খানিকক্ষণ ঘুমুলো। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখল, টেলিফোন ঠিক হয়ে গেছে। মারুফ কথা বলছে। মারুফ বলছে – শােন তিথি, পশুর সঙ্গে মানুষের সবচে’ বড় তফাৎ হল – মানুষ দলবল নিয়ে খেতে পছন্দ করে। পশু তার খাবার নিয়ে একা একা চলে যায়। এমনভাবে খায় যেন কেউ দেখতে না পারে।
তিথি বলল, পাখিদের বেলায় কি হয় ?
পাখিদের জন্যেও একই ব্যাপার। শুধু খাঁচায় বন্দি পাখিদের একসঙ্গে খেতে হয় কারণ তাদের উপায় নেই। ক্রিং ক্রিং ক্রিং।
তিথি বলল, ক্রিং ক্রিং শব্দ হচ্ছে কেন? মারুফ বলল, বুঝতে পারছি না। বােধহয় তােমাদের বাসায় কলিংবেল বাজছে। ‘দরজা খুলে দেব?”
‘দরজা খােলার কোন দরকার নেই। তুমি ঘুমুতে থাক। যে এসেছে সে খানিকক্ষণ বেল বাজিয়ে চলে যাবে।
‘ক্রিং ক্রিং ক্রিং।
তিথির ঘুম ভাঙল। কলিং বেল না, টেলিফোন বাজছে। ঘুমের ঘাের তার এখনাে কাটেনি। সে জড়ানাে গলায় বলল, হ্যালাে।
ওপাশ থেকে শায়লা বললেন, তােদের টেলিফোন নষ্ট না–কি? সকাল থেকে টেলিফোন করছি, লাইন পাচ্ছি না।
‘টেলিফোন নষ্ট ছিল না। এখন ঠিক হয়েছে। তুমি কেমন আছ?” ‘ভাল। শােন, আমরা সিলেট যাচ্ছি। ‘কবে?”
‘আজ রাতের ট্রেনে, সুরমা মেল। তাের ছােট মামার চা বাগান দেখে আসি। তুই যাবি?”
‘অবশ্যই যাব।”
‘তাহলে তাের কাপড়–চোপড় গুছিয়ে এখানে চলে আয়। আমি এক ঘণ্টা পরে গাড়ি পাঠিয়ে দেব। আমার ঘরে পরার কয়েকটা শাড়ি সঙ্গে নিয়ে আসবি – আর কাবার্ডের নিচে রাখা স্যাণ্ডেল জোড়া আনবি।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৯) হুমায়ূন আহমেদ
‘ইটালীয়ান স্যাণ্ডেল ?
‘ক’ দিন থাকবে?” ‘ঠিক নেই। চার–পাঁচ দিন থাকতে পারি। ‘বাবাকে তাহলে এক সপ্তাহের ছুটি নিতে বলি ?” ‘ওর ছুটি নেয়া–নেয়ির কি আছে?” ‘বাবা কি সঙ্গে যাচ্ছে না?”
না।
‘তুই মনে হয় আকাশ থেকে পড়লি। ‘বাবা একা–একা থাকবে?
‘হ্যা থাকবে। সে কচি খােকা না। তাকে ফিডিং বােতল দিয়ে দুধ খাওয়াতে হয় না।”
‘বাবা একা থাকবে আর আমরা দল বেঁধে বেড়াতে যাব ? ‘হ্যা।। ‘তাহলে মা তােমরা যাও, আমি যাব ন। ‘তুই যাবি না?”
না। এবং মা আমার মনে হয় – তুমি বাড়াবাড়ি করছ।। ‘আমি বাড়াবাড়ি করছি না। তুই বাড়াবাড়ি করছিস। আমি তাের বাবাকে একটা কঠিন শিক্ষা দিতে চাচ্ছি – তাের জন্যে পারছি না।
‘কঠিণ শিক্ষা শুধু বাবার একার হবে কেন? তােমারও তো হওয়া উচিত। ‘তুই কি বললি?” ‘রাগ করাে না, মা। ‘যার যা ইচ্ছা আমাকে বলে যাবে আর আমি রাগ করব না?
‘মা শােন, চল আমরা সিলেট থেকে ঘুরে আসি। অনেক দিন ফ্ল্যাট বাড়িতে। থেকে থেকে আমাদের মন–টন ছােট হয়ে গেছে। বাইরে ঘুরলে ভাল লাগবে। বাবাও আমাদের সঙ্গে যাক। তুমি তার সঙ্গে কথা বলাে না – তাহলেই হল। তুমি এমন ভাব করবে যেন বাবা একজন অপরিচিত মানুষ।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৯) হুমায়ূন আহমেদ
‘আমার সঙ্গে চাল চালবি না তিথি।।
‘আমি কোন চাল চালছি না মা।”
‘আমি তাের বাবাকে এমন শিক্ষা দেব যে সে তার নিজের নাম পর্যন্ত ভুলে যাবে। তার এত বড় সাহস, সে আমার গায়ে হাত তুলে ...।
এখন দেখি একবারে আঁৎকে উঠলি। তাের বাবা এলে তাকে জিজ্ঞেস করিস, তারপর তুই তাের বাবার হয়ে ওকালতি করিস। তার আগে না।
তিথি চুপ করে রইল, টেলিফোনের ওপাশ থেকে কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। তিথি কি করবে বুঝতে পারছে না। তিথি নরম করে ডাকল, ‘মা।
‘কি? “ফ্রীজের ঠাণ্ডা ভাত কি করে গরম করতে হয় ? ‘জানি না। চুপ কর। শায়লা টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন।