বাঁশি বাজাব। ‘তুমি বাঁশি বাজাতে জান?” ‘পাতার বাঁশি স্যার। দু‘টা পাতা ভাজ করে ঠোটের ভেতর দিয়ে ...‘
নুরুজ্জামান। ‘জ্বী স্যার।
‘আমি এখন অত্যন্ত জরুরি একটা কাজ করছি। আমার মন মেজাজও ভাল নেই – তুমি যাও।
‘জ্বী আচ্ছা স্যার।
জাফর সাহেব লক্ষ্য করলেন, নুরুজ্জামান তার কথায় দুঃখিতও হল না। অপমানিত বােধ করল না। হাসি মুখে উঠে দাঁড়াল। সহজ গলায় বলল, স্যার বাসায় ফিরবেন কখন?
“কেন?”
বাসায় ফেরার সময়টা জানা থাকলে এখানে চলে আসতাম তারপর আপনার সাথে একসঙ্গে গাড়িতে চলে যেতাম। গাড়িতে চড়ার মজাই অন্যরকম।
‘আমি পাঁচটার সময় বাসায় যাব। “জ্বী আচ্ছা স্যার। আমি চলে আসব।
জাফর সাহেবের মাথা দপদপ করছে। জ্বর এসে গেছে কিনা কে জানে। বমি বমি ভাব হচ্ছে। অতিরিক্ত মেজাজ খারাপ হলে তঁার এমন বমি বমি ভাব হয়।
নুরুজ্জামান বলল, স্যার যাই। স্লীমালিকুম। ‘ওয়ালাইকুম সালাম।
জাফর সাহেব ফাইল সামনে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। মেজাজ এতই খারাপ যে ফাইলের দিকেও তাকাতে পারছেন না। অথচ পুরাে ফাইল আজ দিনের মধ্যেই দেখে দিতে হবে।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৮) হুমায়ূন আহমেদ
ঝা ঝা রােদে নুরুজ্জামান হাঁটছে। এমন ভাবে হাঁটছে যেন এই শহরটা তার খুবই পরিচিত। তার প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে। দুপুরে এখনো কিছু খাওয়া হয় নি। এক হােটেলে খেতে বসেছিল। দাম শুনে বুক ধড়ফড় শুরু হল। এক পিস মাছ কুড়ি টাকা। ভাত ফুল প্লেট পাঁচ টাকা পরের হাফ দু টাকা ডাল এক বাটি পঁাচ টাকা। একবেলা খেতেই বত্রিশ টাকা।
অসম্ভব ব্যাপার। কাজেই এক কাপ চা খেয়ে সে বের হয়ে এসেছে। চায়ের দামও নিল দু‘ টাকা। টাকাটা একেবারে পানিতে পড়ে গেছে। এতটুক কাপে এক কাপ চা এর দাম দু‘ টাকা, পাগলের দেশ না–কি ? টেলিফোন করতে গিয়েও পাঁচ টাকা নষ্ট হল। ফার্মেসী থেকে টেলিফোন করেছিল। এরা কল প্রতি তিনটাকা নেয়। পাঁচ টাকার একটা নোট দিল। তারা নােটটা রেখে দিয়ে বলল, ভাংতি নাই। আরেক সময় এসে আরেকটা টেলিফোন করে যাবেন। এখন যান। বিরক্ত করবেন না।
নুরুজ্জামান একবার ভাবল বলে, টাকাটা দিন আমি ভাংতি করে দেই। শেষ পর্যন্ত বলল না। এই লােকের মুখ দেখে মনে হচ্ছে বললেও লাভ হবে না।।
নুরুজ্জামান এখন যাচ্ছে মৌচাকের দিকে।
ভরদুপুরে কারাের বাসায় উপস্থিত হওয়া ঠিক না, কিন্তু খবর পাওয়া গেছে। কামরুদ্দিন সাহেব বাসায় খেতে যান। তাঁকে ধরার এইটাই উৎকৃষ্ট সময়।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৮) হুমায়ূন আহমেদ
নুরুজ্জামান দুটা আনারস কিনল। এই সময় আনারস পাবার কথা না। ঢাকা শহরের ব্যাপার–ট্যাপার সবই অদ্ভুত। আনারস পাওয়া যাচ্ছে।
বাচ্চা কাচ্চার বাসা, খালি হাতে যাওয়া ঠিক না।
কামরুদ্দিন সাহেব বাসাতেই ছিলেন। দুপুরের খাওয়া শেষ করে পান মুখে দিয়েছেন। তার দুপুরে কিছুক্ষণ ঘুমানাের অভ্যাস – এই সময়ে দরজা খুলতে হল। নুরুজ্জামান হাসিমুখে বলল, স্যার চিনতে পারছেন? আমি নুরুজ্জামান।
কামরুদ্দিন বললেন, কি ব্যাপার? বলেছিলেন ঢাকায় এলে যেন দেখা করি।‘ ‘এখন তাে একটু ব্যস্ত আছি।” ‘তাহলে স্যার পরে আসি?‘ ‘আচ্ছা আসুন, পরে আসুন।
‘আমাকে চিনতে পারছেন তাে স্যার? – পাতার বাঁশি। বলেছিলেন একটা ব্যবস্থা করে দিবেন।
‘বাচ্চা–কাচ্চার জন্যে দু’টা আনারস এনেছিলাম।
কামরুদ্দিন বিরক্তমুখে আনারস হাতে নিলেন। নুরুজ্জামান বলল, কবে আসব স্যার?
‘আসুন, কাল আসুন। বাসায় না, অফিসে আসুন। বাসায় লােকজন আসা আমি পছন্দ করি না। দশটার দিকে অফিসে আসুন।
‘টিভি ভবনে ?” ‘হঁ্যা। গেটে পাশ থাকবে। নাম যেন কি বললেন?
নুরুজ্জামান। মুহম্মদ নুরুজ্জামান। পাতার বাশি কি সঙ্গে করে নিয়ে আসব স্যার?
‘আনুন।
‘তাহলে আজ স্যার যাই। কাল দেখা হবে। আমি ঠিক দশটার সময় চলে আসব স্যার।
“আচ্ছা। কামরুদ্দিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। আগামী কাল তিনি টিভি ভবনে যাচ্ছেন
অন্য কাজ আছে। এই লােক কিছুক্ষণ ঘােরাফেরা করে চলে যাবে। তার কপাল ভাল হলে আর আসবে না। কপাল মন্দ হলে আবারও আসবে। জীবন অস্থির করে দেবে। কামরুদ্দিন সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলেন, নির্বোধ লােকের সংখ্যা এত দ্রুত বাড়ছে – এর কারণ কি?
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৮) হুমায়ূন আহমেদ
নুরুজ্জামান আবার হাঁটতে শুরু করেছে। হাঁটতে তার ভাল লাগছে। ঢাকা শহরে হেঁটে বেড়ানাের আলাদা মজা। কত কিছু আছে দেখার। এত ব্যস্ত রাস্তায় এক গেঞ্জী–গায়ে লােককে দেখা গেল ঘােড়ার পিঠে চড়ে চলে গেল। দুবলা–পাতলা ঘােড়া না, বেশ তরতাজা ঘােড়া। শহরের রাস্তায় ঘােড়াটাকে মানাচ্ছে না, আবার গেঞ্জী গায়ে লোকটাকেও ঘােড়ার পিঠে মানাচ্ছে না। তারপরেও পুরো ব্যাপারটা মানিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে ঘোড়ার পিঠে এই মানুষটার দরকার ছিল।
নুরুজ্জামান ঘড়ি দেখল। দুটা ত্রিশ। তার ঘড়ি পাঁচ মিনিট ফাস্ট আছে। আসল সময় দুটা পঁচিশ। পিএ সাহেবের বাসায় কি চলে যাবে? ঠিকানা আছে, যাওয়া যায়। দুপুর বেলা উপস্থিত হলে উনি কি রাগ করবেন? করতে পারেন। করাটাই স্বাভাবিক। তবু চেষ্টা করতে দোষ কি? উনার বাসা কলাবাগান। ঐদিকে বাস যায় কিনা খোজ করতে হবে। হেঁটে রওনা দেয়াটা ঠিক হবে না। বাসের কোন খোজ পাওয়া যাচ্ছে না। আজ নাকি বাস স্ট্রাইক। নুরুজ্জামান হাঁটা শুরু করল।
কলিংবেল টিপতেই একজন মহিলা দরজা খুলে দিলেন, নুরুজ্জামান বলল, স্লামালিকুম আপা।
‘ওয়ালাইকুম সালাম। উনি তাে বাসায় নেই।‘
‘আপা, আমি আপনার কাছে এসেছি। আমার নাম নুরুজ্জামান। আমি অতিথপুর গার্লস স্কুলের হেডমাস্টার। আমি এক গ্লাস পানি খাব।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৮) হুমায়ূন আহমেদ
‘আপনি তাে ঘামে ভিজে জবজবা হয়ে গেছেন। আসুন, ফ্যানের নিচে আসুন।
নুরুজ্জামান বসার ঘরে বসল। মহিলা তাকে পানি দিলেন না, এক গ্লাস সরবত এনে দিলেন। সরবতের উপর বরফের টুকরা ভাসছে। ভদ্রমহিলা বললেন, এক্ষুনি খাবেন না। একটু ঠাণ্ডা হয়ে নিন।