খাবার ঘরের এক কোণায় চারটা মুরগি পায়ে দড়ি বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। এরা কোন শব্দ করছে না। সবক‘টা একসঙ্গে ঘাড় উচিয়ে তিথিকে দেখছে।
তিথির মনে হল মুরগিগুলি খুব অবাক হচ্ছে – এতদিন তারা গ্রামের ঝোপেঝাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, আজ হঠাৎ নতলা ফ্ল্যাটে। তাদের পায়ের নিচে মাটি নেই আছে শ্যাগ কার্পেট।
তিথি প্লাস্টিকের একটা বাটিতে খানিকটা পানি এগিয়ে লি। চারজনই ঝাপিয়ে পড়ল পানির বাটির উপর। আহা বেচারারা ! তৃষ্ণায় নিশ্চয়ই এদের বুক ফেটে যাচ্ছিল। মুখ ফুটে বলতে পারছিল না। তিথি খানিকটা চাল এনে দিল। খুঁটে খুঁটে চাল খাচ্ছে। পা একসঙ্গে বাঁধা থাকায় আরাম করে খেতেও পারছে না। আহা। বেচারারা! আহা।
‘নিন, চা নিন। নুরুজ্জামান উঠে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপ হাতে নিল।
‘ঘরে বিসকিট নেই। এক স্লাইস রুটি মাখন লাগিয়ে এনেছি। চা খেয়ে একটা কাজ করে দেবেন?‘
নুরুজ্জামান বিস্মিত হয়ে বলল, কি কাজ? | ‘মুরগিগুলির পায়ে দড়ি বাঁধা। দড়ি খুলে দেবেন। কাজের লােকের একটা ঘর আছে রান্নাঘরের পাশে। ঐখানে ছেড়ে রাখব। সারাদিন বাঁধা ছিল। খুব মায়া লাগছে।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৪)
নুরুজ্জামান বলল, জ্বি আচ্ছা।
তিথি একটুক্ষণ থেমে থেকে বলল, আপনি যখন দেশে ফিরে যাবেন তখন মুরগিগুলি সঙ্গে নিয়ে যাবেন। গ্রামে নিয়ে ছেড়ে দেবেন। পারবেন না?
‘জি পারব।’
তিথি কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বলল, ওরা ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাকে দেখছিল। পানি দিলাম, এত আগ্রহ করে পানি খাচ্ছিল। মায়া পড়ে গেছে। নুরুজ্জামান বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। কি অদ্ভুত কথা বলছে এই মেয়ে। একটা মানুষকে একা একা খেতে দেয়া যায় না। আবার নিতান্ত অপরিচিত একজন মানুষকে ভাত বেড়ে দিয়ে বসে থাকা যায় না। তিথি টেবিলে ভাত। বাড়ছে।
জাফর সাহেব জানিয়েছেন তিনি রাতে ভাত খাবেন না। এক গ্লাস লেবুর সরবত খাবেন। ঘরে লেবু নেই। লেবু ছাড়া লেবুর সরবত বানাতে হবে। তিথির ধারণা তার বাবা লেবু নেই কেন এ নিয়েও খানিকক্ষণ হৈ চৈ করবেন। তার নিজেরও ক্ষিধে লেগেছে। লােকটির খাওয়া শেষ হবার পরই তার খাওয়ার প্রশ্ন আসে। সে কতক্ষণ ধরে খাবে কে জানে? গ্রামের মানুষ বেশি খায় কিন্তু সেই বেশি খাওয়াটা দ্রুত খায় ,ধীরে ধীরে খায় তা তার জানা নেই।
নুরুজ্জামান ইতিমধ্যেই লুঙ্গী পরে মােটামুটি ঘরােয়া ভাব ধরে ফেলেছে। লুঙ্গী সাদা হলেও গায়ের গেঞ্জীটা গাঢ় নীল। চুলে তেল দেয়ায় মাথা চকচক করছে।
সে খুব সহজ ভঙ্গিতে টেবিলে খেতে বসল। তিথির দিকে তাকিয়ে বলল, কাটা চামচ দিয়ে খাওয়ার অভ্যাস নাই।
তিথি বলল, আপনাকে কাঁটা চামচ দেয়া হয়নি হাত দিয়েই খাবেন। ‘হাত ধােয়ার পানি ?
‘আসুন বেসিন দেখিয়ে দেই। বেসিনে হাত ধুয়ে নিন। হাত ধুয়ে খেতে শুরু করুন। আমি বাবাকে এক গ্লাস সরবত বানিয়ে দিয়ে আসি। একা একা খেতে আপনার অসুবিধা হবে নাতাে?”
‘জি না। অসুবিধা কি ?
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৪)
নুরুজ্জামান তিথির ভদ্রতায় আরেকবার মুগ্ধ হল।
জাফর সাহেব ভুড়, কুঁচকে বললেন, লেবুর সরবত দিতে বললাম – লেবু কোথায় ?
লেবু নেই বাবা। থাকবে না কেন? নিশ্চয়ই আছে। ভালমত খুঁজে দেখ।
‘খুঁজে যদি লেবু পাওয়াও যায় – তােমাকে দেয়া হবে না। রাতে লেবু খাওয়া ঠিক না – পেটে এসিডিটি হয়। তােমার এই বয়সে পেটে এসিডিটি হওয়া ঠিক না। পেটে গ্যাস হবে। সেই গ্যাস ফুসফুসে চাপ দেবে। অক্সিজেন ফুসফুসে আসতে দেবে না — ফলে ব্রেইনে অক্সিজেনের অভাব হবে। মাথা ঘুরতে থাকবে – এক সময় দেখা যাবে পালস পাওয়া যাচ্ছে না।‘
জাফর সাহেব অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন | ‘আমার কথা তােমার বিশ্বাস হচ্ছে না বাবা?” ‘হচ্ছে ।”
‘তাহলে এ ভাবে তাকিয়ে আছ কেন? সরবত খাও।‘
তিনি এক চুমুকে গ্লাস শেষ করলেন। তিথিকে গ্লাস ফিরিয়ে দিতে দিতে বললেন, গাধাটা খেয়েছে?
‘খেতে বসেছে। ‘তুই খেয়েছিস ?
না। উনার খাওয়া হলেই খেতে বসব। অবশ্যি ক্ষিধে মরে গেছে। খেতে ইচ্ছাও করছে না। একা একা খেতে ভাল লাগে না।‘
‘তুই খেতে বসার সময় আমাকে ডাকবি। আমি বসব তাের সঙ্গে। ‘আমার সঙ্গে তােমার বসতে হবে না। তােমার ঘুম পেয়েছে তুমি ঘুমিয়ে পড়।
নুরুজ্জামান হাত গুটিয়ে বসে আছে। এখনাে খেতে শুরু করে নি। তিথি অবাক হয়ে বলল, খাচ্ছেন না কেন?
‘নিমক নাই। নিমকের জন্যে বসে আছি।
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৪)
তিথি রান্নাঘর থেকে লবনের বাটি এনে দিল। লবনকে নিমক বলার অর্থ তার কাছে পরিস্কার হচ্ছে না, পাতে খাবার লবনকে সম্মান দেখিয়ে নিমক বলা হয়। কি? অনেকে যেমন দৈ বলে না। বলে দধি। বড় সাইজের রই মাছকে রুই মাছ বলে
, বলে রুহিত মাছ। তিথি টেবিলের অন্য প্রান্তে বসেছে। নুরুজ্জামানের ‘নিমক’ খাওয়া বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছে। খানিকটা লবণ প্লেটের এক কোনায় নিল। খানিকটা নিল তর্জুনির মাথায়। সেই ‘নিমক’ জীবে ছুঁইয়ে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কি যেন বলল। কোন দোয়া হাব। একজন মানুষের সামনে চুপচাপ বসে থাকা যায় না। তিথি বলল, ঢাকায় কদিন থাকবেন?”
‘মিনিষ্টার সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাত করব। তারপর একটু অন্য কাজও আছে। ‘আর কি কাজ?
‘একটু ঘুরাফিরা করব। ঢাকায় আগেও দুইবার এসেছি । ঘুরাফিরা করতে পারি নাই। দেখার জিনিসেরতে এই শহরে কোন অভাব নাই। এইবার ভাবছি – যতটা পারি দেখব। ডায়ানার একটা সন্তান হয়েছে। সেইটাও দেখে যাব।
“আপনার কথা বুঝলাম না। কার সন্তান হয়েছে? ‘ডায়ানার।” ‘ডায়ানাটা কে ?
‘চিড়িয়াখানায় যে মেয়ে জলহস্তি আছে তার নাম ডায়ানা। খবরের কাগজে দেখেছি – ডায়ানার একটা পুত্র সন্তান হয়েছে। আগে একটা কন্যা হয়েছিল।
‘ও আচ্ছা। আপনি তাহলে চিড়িয়াখানা – শিশুপার্ক এই সব ঘুরে ঘুরে
দেখবেন ?*
‘শিশুপার্ক দেখব না। গতবার দেখে গেছি। বড় ভাল লেগেছিল।” ‘ভাল ভাল জিনিষতে বার বার দেখা যায়। ‘তাও ঠিক। ‘খেতে পারছেনতাে ?
“জি পারছি। পারব না কেন? গ্রাম দেশে এত পদ দিয়ে তাে কখনাে খাই না। দুইটা পদ থাকে। তরকারী – ডাল। কোনকোনদিন ভাজি আর ডাল।
‘ঢাকার কাজ কর্ম সারতে আপনার তাহলে কিছু সময় লাগবে ?
তিথির নীল তোয়ালে-পর্ব-(৪)
‘দ্ধি লাগবে। আমাদের এলাকায় একজন লােক আছে টেলিভিশনে কাজ করে। উনার সাথেও একটু দেখা করব। উনার ঠিকানা আনতে আবার ভুলে গেছি। এই নিয়ে একটু দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত। তবে টেলিভিশনে গেলে নিশ্চয়ই উনার ঠিকানা পাব।
‘হা পাবেন।
উনি বলেছিলেন ঢাকায় আসলে যেন তার সঙ্গে দেখা করি। পারলে আমাকে একটা সুযােগ করে দিবেন বলেছিলেন।
তিথি বিস্মিত হয়ে বলল, কিসের সুযোগ?
নুরুজ্জামান সহজ গলায় বলল – আমি পাতার বাঁশি বাজাতে পারি। উনি শুনে। খুব খুশি হয়েছিলেন। তখন ঠিকানা দিয়ে বলেছিলেন – বাচ্চু মিয়া ঢাকায় আসলে দেখা করবেন। আমার ডাক নাম বাচ্চু।