হুমায়ূন আহমেদের লেখা ”তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে ”খন্ড-১

নবনী অনেকক্ষণ থেকে হাঁটছেকতক্ষণ সে জানে নাতার হাতে ঘড়ি নেইএরকম অজ পাড়াগাঁয়ে ঘড়ির দরকারও নেইতবে গায়ে চাদর থাকলে ভাল হতশীত লাগতে শুরু করেছেকিছুক্ষন আগেও শীত ছিল না, এখন ঝপ করে শীত পড়ে গেছেনবনী মনে মনে বলল, বাহআশ্চর্য তাে!মনে মনে বলার প্রয়ােজন ছিল না, চেঁচিয়েও বলা যেত আশে পাশে কেউ নেই

তার পরনে সবুজ রঙের সিল্কের শাড়িসিল্কের শাড়ি সে কখনই পড়ে নাশীতের সময় সিল্ক পরলে গায়ে হিম হিম ভাব হয় ভাল লাগে নাসবুজ রঙটাও তার পছন্দ নাতার ধারণা, সবুজ গাছেদের রঙ এই রঙ তাদেরই থাকা উচিতসবুজ শাড়ি পরার পর তার নিজেকে খানিকটা গাছ গাছ মনে হচ্ছিলএখন আর মনে হচ্ছে না

তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণেশীত লাগছেগাছদের নিশ্চয়ই শীত লাগে নানবনী হাঁটতে হাঁটতে একটা বটগাছের কাছে চলে এসেছেএটা যে একটা বটগাছ দূর থেকে বােঝা যায়নিবেলা পড়ে এসেছে, চারদিক অস্পষ্ট, ছায়া ছায়ানবনী এগুচ্ছিল পায়েচলা পথেতার অভ্যাস মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটাহাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সে গাছটার সামনে পড়ে গেল

অন্ধকারের মধ্যে হুলস্থুল একটা ব্যাপার বিশাল ঝুড়ি নেমেছে চারদিকেপুর গাছটাকে মনে হচ্ছে প্রকাণ্ড একটা পাহাড়নবনী বাচ্চাদের মত গলায় চেঁচিয়ে বলল, মিস্টার বটগাছ! আপনি কোথেকে এলেন? মনের আনন্দে এখানে চেঁচিয়ে কথা বলা যায়কেউ শুনে ফেলবে না এবং ভুরু কুঁচকে ভাববে না মেয়েটা পাগল নাকি

সে চারদিকে তাকালকেউ কোথাও নেইমাথার উপর কিছু পাখি ওড়াউড়ি করছেকি পাখি? কি আশ্চর্য, টিয়া!নবনী আবারাে চেঁচিয়ে বলল, টিয়া, টিয়া, টিয়াকেউ শুনবে নাযত ইচ্ছা চেঁচানাে যায়আচ্ছা, এই জায়গাটা জনশূন্য কেন? মানুষজন তাে নাই, গরু ছাগলও নেই, কে জানে এই জায়গাটা হয়ত দোষীসব গ্রামে একটা দোষীপথ থাকেসন্ধ্যার পর পথে কেউ যায় নাএকটা থাকে দোষী গাছবেশির ভাগ সময়ই শ্যাওড়া গাছদোষী গাছের কাছে যাওয়া নিষেধএই বটগাছটা আবার দোষী না তাে!

”তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে ”

নবনী বলল, মিস্টার বটগাছ, আপনি দোষী না নিদোষী? সে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলমাথার উপর দিয়ে ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দ করে ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া উড়ে যাচ্ছেএত সুন্দর একটা পাখি এত বিশ্রী করে ডাকেপাখি যত সুন্দর হয় তার ডাকও হয় তত কুৎসিতচিড়িয়াখানায় একবার ময়ুরের ডাক শুনে তার হাত থেকে বাদামের ঠোঙ্গা পড়ে

গিয়েছিলনবনী এমনিতে বেশ ভীতুঢাকায় তাদের বাড়িতে রাতে ঘুম ভাঙলে মনে হয় খাটের নিচে কেউ একজন বসে আছেমশারির নিচ দিয়ে সে তার বরফ শীতল হাত ঢুকিয়ে নবনীকে ছুঁয়ে দেবেরাতে অন্ধকার ঘরে সুইচ জ্বালাতে গিয়ে তার সব সময় মনে হয় সুইচ বাের্ডে হাত দিতে গিয়ে সে অন্য একজনের হাতে হাত দিয়ে ফেলবে

”তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে ”

অথচ সম্পূর্ণ অচেনা এই গ্রামে অন্ধকার হয় হয় অবস্থায়ও তার এতটুভয় করছে নাবরং মজা লাগছেবটগাছটার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছেননী বটগাছের একটা বুডিতে হাত রেখে বলল, মিস্টার বটগাছ, এটা কি আপনার হাত, না পা? আপনার গায়ের চামড়া এত খসখসে কেন

 নবনীর হঠাৎ মনে হল, আহা বটগাছটা যদি এখন কথা বলে উঠে তাহলে তা কেমন লাগবে? সেকি ভয় পাবে? বটগাছটা যদি বলে, নববী, এটা আমার হাতও না পানাআমরা তাে মানুষ নই যে আমাদের হাত পা থাকবেআমরা হচ্ছি গাছতাহলে কি নবনী ভয়ে চিৎকার করে উঠবে? মনে হয় নাভয় পেলে আগেই পেত আচ্ছা, সে ভয় পাচ্ছে না কেন এটাও তাে এক আশ্চর্য ব্যাপার

পরিবেশ মানুষকে বদলে দেয় হয়তঢাকা শহরে সে ছিল দারুণ ভীতু একটা মেয়ে। এখানে অসম্ভব সাহসী একজন, যে হেঁটে হেঁটে একা চলে এসেছে প্রকাণ্ড এক বটগাছের কাছে| নবনী ঠিক করল, পুব্রো গাছটা একটা চক্কর দিয়ে সে যে পথে এসেছিল সেই পথেই ফিরে যাবেডাকবাংলােয় পৌছতে পৌছতে অন্ধকার হয়ে যাবেতাতে অসুবিধা হবে না

”তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে ”

একটাই পথতাছাড়া গতকাল পূর্ণিমা গেছেআজও কিছুক্ষণের মধ্যেই টান উঠবেগতকাল কুয়াশা ছিল, আজ কুয়াশা নেইট্রাদ উঠলে চারদিকে ঝলমল করতে থাকবেনবনী আগে লক্ষ্য করেনি হঠাৎ লক্ষ্য করল বটগাছের গুঁডিটা বঁধানােচারদিকে ঝুড়ি নেমেছে বলে বাঁধানাে গুড়ি চোখে পড়ছে না এমন জংলা জায়গায় একটা প্রাচীন গাছ কে বাধিয়ে রেখেছে কেউ কি এখানে এসে বসে? এখন কি কেউ চুপচাপ বসে আছেননীর হঠাৎ একটু ভয় ধুয়ে গেল

গা কেপে গেলদ্রুত অন্ধকার হয়ে আসছেগাছটাকে এখন আর ভাল লাগছে নাটিয়া পাখির শব্দ কানে বাজছেমনে হচ্ছে এরা এখন অনেক নিচু দিয়ে উড়ছেএকটা পাখি তাে প্রায় ননীর চুল দুয়ে গেলনবনীকে দেখে পাখিলি কি বিরক্ত হচ্ছে স্লাা কেউ কি নিঃশ্বাস ফেলল? নবনী পরিক্ষার নিশ্বাস ফেলার শব্দ শুনলতার নিজের নিঃশ্বাস ফেলার শব্দই কি সে শুনেছে। 

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা ”তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে ”খন্ড-২

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *