নবনী অনেকক্ষণ থেকে হাঁটছে। কতক্ষণ সে জানে না। তার হাতে ঘড়ি নেই। এরকম অজ পাড়াগাঁয়ে ঘড়ির দরকারও নেই। তবে গায়ে চাদর থাকলে ভাল হত। শীত লাগতে শুরু করেছে। কিছুক্ষন আগেও শীত ছিল না, এখন ঝপ করে শীত পড়ে গেছে। নবনী মনে মনে বলল, ‘বাহ। আশ্চর্য তাে!‘ মনে মনে বলার প্রয়ােজন ছিল না, চেঁচিয়েও বলা যেত – আশে পাশে কেউ নেই।
তার পরনে সবুজ রঙের সিল্কের শাড়ি। সিল্কের শাড়ি সে কখনই পড়ে না। শীতের সময় সিল্ক পরলে গায়ে হিম হিম ভাব হয় – ভাল লাগে না। সবুজ রঙটাও তার পছন্দ না। তার ধারণা, সবুজ গাছেদের রঙ – এই রঙ তাদেরই থাকা উচিত। সবুজ শাড়ি পরার পর তার নিজেকে খানিকটা গাছ গাছ মনে হচ্ছিল। এখন আর মনে হচ্ছে না।
শীত লাগছে। গাছদের নিশ্চয়ই শীত লাগে না। নবনী হাঁটতে হাঁটতে একটা বটগাছের কাছে চলে এসেছে। এটা যে একটা বটগাছ দূর থেকে বােঝা যায়নি। বেলা পড়ে এসেছে, চারদিক অস্পষ্ট, ছায়া ছায়া। নবনী এগুচ্ছিল পায়ে–চলা পথে। তার অভ্যাস মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটা। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সে গাছটার সামনে পড়ে গেল।
অন্ধকারের মধ্যে হুলস্থুল একটা ব্যাপার । বিশাল ঝুড়ি নেমেছে চারদিকে। পুর গাছটাকে মনে হচ্ছে প্রকাণ্ড একটা পাহাড়। নবনী বাচ্চাদের মত গলায় চেঁচিয়ে বলল, মিস্টার বটগাছ! আপনি কোথেকে এলেন? মনের আনন্দে এখানে চেঁচিয়ে কথা বলা যায়। কেউ শুনে ফেলবে না এবং ভুরু কুঁচকে ভাববে না – মেয়েটা পাগল নাকি?
সে চারদিকে তাকাল। কেউ কোথাও নেই। মাথার উপর কিছু পাখি ওড়াউড়ি করছে। কি পাখি? “কি আশ্চর্য, টিয়া!” নবনী আবারাে চেঁচিয়ে বলল, “টিয়া, টিয়া, টিয়া”। কেউ শুনবে না। যত ইচ্ছা চেঁচানাে যায়। আচ্ছা, এই জায়গাটা জনশূন্য কেন? মানুষজন তাে নাই, গরু ছাগলও নেই, কে । জানে এই জায়গাটা হয়ত ‘দোষী’ সব গ্রামে একটা দোষী’ পথ থাকে। সন্ধ্যার পর ঐ পথে কেউ যায় না। একটা থাকে দোষী গাছ‘। বেশির ভাগ সময়ই শ্যাওড়া গাছ। দোষী গাছের কাছে যাওয়া নিষেধ। এই বটগাছটা আবার দোষী না তাে!
”তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে ”
নবনী বলল, মিস্টার বটগাছ, আপনি দোষী না নিদোষী? সে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল। মাথার উপর দিয়ে ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দ করে ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া উড়ে যাচ্ছে। এত সুন্দর একটা পাখি এত বিশ্রী করে ডাকে। পাখি যত সুন্দর হয় তার ডাকও হয় তত কুৎসিত। চিড়িয়াখানায় একবার ময়ুরের ডাক শুনে তার হাত থেকে বাদামের ঠোঙ্গা পড়ে।
গিয়েছিল। নবনী এমনিতে বেশ ভীতু। ঢাকায় তাদের বাড়িতে রাতে ঘুম ভাঙলে মনে হয় খাটের নিচে কেউ একজন বসে আছে। মশারির নিচ দিয়ে সে তার বরফ – শীতল হাত ঢুকিয়ে নবনীকে ছুঁয়ে দেবে। রাতে অন্ধকার ঘরে সুইচ জ্বালাতে গিয়ে তার সব সময় মনে হয় সুইচ বাের্ডে হাত দিতে গিয়ে সে অন্য একজনের হাতে হাত দিয়ে ফেলবে।
”তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে ”
অথচ সম্পূর্ণ অচেনা এই গ্রামে অন্ধকার হয় হয় অবস্থায়ও তার এতটুর ভয় করছে না। বরং মজা লাগছে। বটগাছটার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। ননী বটগাছের একটা বুডিতে হাত রেখে বলল, মিস্টার বটগাছ, এটা কি আপনার হাত, না পা? আপনার গায়ের চামড়া এত খসখসে কেন?
নবনীর হঠাৎ মনে হল, আহা বটগাছটা যদি এখন কথা বলে উঠে তাহলে তা কেমন লাগবে? সে–কি ভয় পাবে? বটগাছটা যদি বলে, নববী, এটা আমার হাতও না পা— ও না। আমরা তাে মানুষ নই যে আমাদের হাত পা থাকবে। আমরা হচ্ছি গাছ।” তাহলে কি নবনী ভয়ে চিৎকার করে উঠবে? মনে হয় না। ভয় পেলে আগেই পেত । আচ্ছা, সে ভয় পাচ্ছে না কেন এটাও তাে এক আশ্চর্য ব্যাপার।
পরিবেশ মানুষকে বদলে দেয় হয়ত। ঢাকা শহরে সে ছিল দারুণ ভীতু একটা মেয়ে। এখানে অসম্ভব সাহসী একজন, যে হেঁটে হেঁটে একা চলে এসেছে প্রকাণ্ড এক বটগাছের কাছে। | নবনী ঠিক করল, পুব্রো গাছটা একটা চক্কর দিয়ে সে যে পথে এসেছিল সেই পথেই ফিরে যাবে। ডাকবাংলােয় পৌছতে পৌছতে অন্ধকার হয়ে যাবে। তাতে অসুবিধা হবে না।
”তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে ”
একটাই পথ। তাছাড়া গতকাল পূর্ণিমা গেছে। আজও কিছুক্ষণের মধ্যেই টান উঠবে। গতকাল কুয়াশা ছিল, আজ কুয়াশা নেই। ট্রাদ উঠলে চারদিকে ঝলমল করতে থাকবে। নবনী আগে লক্ষ্য করেনি হঠাৎ লক্ষ্য করল বটগাছের গুঁডিটা বঁধানাে। চারদিকে ঝুড়ি নেমেছে বলে বাঁধানাে গুড়ি চোখে পড়ছে না। এমন জংলা জায়গায় একটা প্রাচীন গাছ কে বাধিয়ে রেখেছে কেউ কি এখানে এসে বসে? এখন কি কেউ চুপচাপ বসে আছে। ননীর হঠাৎ একটু ভয় ধুয়ে গেল ।
গা কেপে গেল। দ্রুত অন্ধকার হয়ে আসছে। গাছটাকে এখন আর ভাল লাগছে না। টিয়া পাখির শব্দ কানে বাজছে। মনে হচ্ছে এরা এখন অনেক নিচু দিয়ে উড়ছে। একটা পাখি তাে প্রায় ননীর চুল দুয়ে গেল। নবনীকে দেখে পাখিলি কি বিরক্ত হচ্ছে স্লাা কেউ কি নিঃশ্বাস ফেলল? নবনী পরিক্ষার নিশ্বাস ফেলার শব্দ শুনল। তার নিজের নিঃশ্বাস ফেলার শব্দই কি সে শুনেছে।
Read More
হুমায়ূন আহমেদের লেখা ”তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে ”খন্ড-২