আনিস বলল, চিকিৎসা কী করেছেন? সাইফুদ্দিন সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন চিকিৎসার কিছু নাই। আপনে
যান। দেখলেই বুঝবেন। এখন একমাত্র চিকিৎসা দোয়া দরুদ। একটা স্যালাইন দিতে পারলে ভালাে হতাে। গ্রামের মানুষ স্যালাইন দেয়াটা বড় চিকিৎসা মনে করে। স্যালাইন দিলাম না। দেড় দুই ঘণ্টা সময় দরকার। এর মধ্যে যদি রােগী মরে যায় আত্মীয়স্বজনরা বলবে ভুল চিকিৎসা করে মেরে ফেলেছি। কী দরকার ?
রােগীর বাড়ি থেকে কান্নার শব্দ আসছে। মেয়েরা কাঁদছে। বুঝাই যাচ্ছে রােগী মারা গেছে। গ্রাম অঞ্চলে মৃত্যুশােকের প্রাথমিক প্রকাশ অসম্ভব তীব্র। নিকটজনরা মাটিতে গড়াগড়ি করতে করতে বুকফাটা আর্তনাদ করতে থাকেন।
আনিস থমকে দাঁড়িয়ে গেল। এই অবস্থায় রােগীর বাড়িতে না ঢােকাই ভালাে। আনিস পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট বের করল। তার সিগারেট খাবার অভ্যাস ছিল না। গ্রামে এসে এই অভ্যাস হচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে অভ্যাস তত বাড়ছে।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(শেষ) হুমায়ূন আহমেদ
বৃদ্ধ এক দ্রলােক লাঠিতে ভর দিয়ে এগুচ্ছেন। লুঙ্গি পরা খালি গা, কিন্তু তার এগিয়ে আসার ভঙ্গিতেই মনে হচ্ছে অতি প্রতাপশালী একজন। রােগীর দাদা বা এই স্থানীয় হবেন।
ডাক্তার সাব না ?
জ্বি।
আপনের অনেক সুনাম শুনেছি। আমার আফসােস আপনেরে এরা শেষ সময়ে এনেছে। আপনে গিয়া রােগীর কাছে বসেন। লােকজনরে বলতে পারব নাতির চিকিৎসার ত্রুটি হয় নাই। তার মৃত্যুর সময়ও বড় একজন ডাক্তার তার বিছানার পাশে বসাইয়া রাখছিলাম।
আনিস হাতের জ্বলন্ত সিগারেট ফেলে দিয়ে বলল চলুন।
মৃত্যু ঠেকানাে সম্ভব না। কিন্তু মৃত্যুকে সহনীয় করার চেষ্টা একজন ডাক্তারকে করতে হয়।
ঘর ভর্তি মানুষ। খাটের ওপর রােগী পড়ে আছে। নিঃশ্বাস নিতে তার ভয়ঙ্কর কষ্ট হচ্ছে। ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে ট্রেসেকটমী করতে হবে। ফুসফুসে অক্সিজেন ঢােকার ব্যবস্থা করতে হবে। এখনি করতে হবে। দেরি করা যাবে না।
আনিস দ্রুত চিন্তা করছে– এলার্জিক কোনাে রিএকশান কি ? মাঝে মাঝে এলার্জি ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
এলার্জির কারণে শরীরে এভাবে পানি আসতে পারে না। কোনাে সাইড এফেক্ট কি? শরীরের পানি বের করার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে সবার আগে যা দরকার তা হলাে–– ছেলেটার নিঃশ্বাস নেবার ব্যবস্থা করা। এলার্জির চিকিৎসা করে শ্বাসনালির ফোলাটা একটু যদি কমানাে যায়। শেষ চেষ্টা ট্রেসেকটমী। ইশ যদি অক্সিজেনের বােতল থাকত!
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(শেষ) হুমায়ূন আহমেদ
আনিস বলল, ঘর খালি করে দিন। গরম পানি দিন। একটা বড় চামুচ আনুন।
আনিস তার ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করছে। তার মনে হচ্ছে। স্কুলের স্পাের্টস হচ্ছে। একশ মিটার দৌড়ে সে নাম দিয়েছে। রেফারি হুইসেল দেবার সঙ্গে সঙ্গে তাকে প্রাণপণে দৌড়াতে হবে। তার সঙ্গে যে দৌড়াবে তার নাম মৃত্যু। দৌড়ে মৃত্যুকে হারাতে হবে।
একজন মহিলা গরুর মতাে বড় বড় চোখে আনিসের দিকে তাকিয়ে আছেন। একটু পর পর তিনি কেঁপে কেঁপে উঠছেন। ডাক্তারের মনে হলাে উনি ছেলের মা। অসংখ্য মহিলার মধ্যেও রােগীর মা’কে সব সময় আলাদা করা যায়।
আনিস মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি রােগীর গলায় ফুটো করব। ভয় পাবেন না। এ ছাড়া অন্য উপায় নেই।
মহিলা পাথরের মতাে স্তব্ধ হয়ে গেলেন।
দুই ঘণ্টার মতাে সময় পার হয়েছে।
রােগীর দাদা উঠোনে জলচৌকিতে বসে তামাক খাচ্ছিলেন। তাঁকে একজন দৌড়ে এসে বলল, কাদের ভালাে আছে। শ্বাস কষ্ট কমেছে। পানি খাইতে চায়।
বৃদ্ধ বললেন, ডাক্তার সাব কী করতেছে ? উনি সিগারেট ধরাইছেন। বারান্দাত খাড়াইয়া সিগারেট খাইতেছেন।
বৃদ্ধ বললেন, আমারে অজুর পানি দেও। অজু কইরা দুই রাকাত শােকরানা নামাজ পড়ব। দুইটা গরু জবেহ কইরা মেহমানি দেও, আমার মনত ছিল। আরেকটা কথা, ডাক্তার সাবরে ভিজিটের টাকা দিবা না। এইটাতে উনার অপমান হবে। বৌমারে বল ডাক্তারের পা ছুঁইয়া যেন সালাম করে।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(শেষ) হুমায়ূন আহমেদ
বৃদ্ধ হঠাৎ কাঁদতে শুরু করলেন।
নবনী, কখন এসেছ?
নবনী বই হাতে উঠে দাঁড়াল। প্রশ্নের জবাব দিল না। কিছু প্রশ্ন আছে— জবাব দিতে হয় না। প্রশ্নকর্তা জবাব পাবার আশায় প্রশ্ন করেন না। আনিসের এই প্রশ্নটাও সেই গােত্রের। জবাব দিলে ক্ষতি নেই, না দিলেও ক্ষতি নেই।
আনিস বলল, মিঠাপুর বলে একটা জায়গায় রােগী দেখতে গিয়েছিলাম। রােগীর অবস্থা খুবই খারাপ— ওরা আমাকে রেখে দিতে চেয়েছিল। ভাগ্যিস থাকি নি।
নবনী বলল, রােদে পুড়ে তুমি তাে দেখি ঝলসে গেছ। আনিস হাসতে হাসতে বলল, তুমি খুব সুন্দর হয়েছ। চুল কেটেছ—তাই
না ?
পথে অসুবিধা হয়েছে? একা একা আস কেন ? কাউকে সঙ্গে নিয়ে এলেই হয়। এমন তাে না যে তােমাদের বাড়িতে মানুষের অভাব।
নবনী হালকা গলায় বলল, একা আসি নি তাে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নান্দাইল রােড স্টেশন পর্যন্ত সঙ্গে ছিলেন। আমি তােমার এখানে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। রাজি হন নি।
আনিস অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। নবনী গম্ভীর গলায় বলল, উনার মাথায় হঠাৎ করে গনি এসে গেল বলে আমিও জোর করি নি। গানের একটা লাইনই এসেছে, অন্য লাইনগুলাে আসে নি। লাইনটা হলাে—
‘আলো ভাঙার এই আলাে। লাইনটা সুন্দর না ?
আনিস বলল, কিছুই বুঝতে পারছি না। কার সঙ্গে তােমার দেখা। কোন রবীন্দ্রনাথ ?
জোড়াসাকোর রবীন্দ্রনাথ। কবিগুরু।
আনিসের মুখের হতভম্ব ভাব আরাে প্রবল হলাে। নবনী হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠে বলল– তুমি এমন কাঠখােট্টা হয়ে যাচ্ছি কীভাবে? ঠাট্টা বুঝ না। ঠাট্টা করছিলাম।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(শেষ) হুমায়ূন আহমেদ
ঠাট্টা করছিলে?
ইয়েস ডাক্তার সাহেব। তােমার চোখ মুখ শক্ত হয়ে যাচ্ছে, মনে হয় তুমি রেগে গেছ।
রাগি নি। তােমার মধ্যে ঠাট্টা করার প্রবণতা আছে এটা ভুলেই গিয়েছিলাম।তােমার ঠাট্টাগুলাে অন্যরকম। হঠাৎ শুনলে ধাক্কার মতাে লাগে।
নবনী বলল, গােসল করে এসাে। খেতে বসব। আমার ক্ষিধে চলে গিয়েছিল আবার ফিরে এসেছে। এখন যদি চলে যায় আর ফিরে আসবে না। আচ্ছা শােন, তােমাদের এখানকার ইমাম সাহেব না–কি ভূত হয়ে লােকজনদের ভয় দেখাচ্ছেন? মতিকে শুনলাম অড়া করে পুকুরে নিয়ে ফেলেছে। সে আমাকে বলছিল ।
আনিস চুপ করে রইল। নবনী বলল, না একটা কিছু বল। আনিস বলল, এ রকম কথাবার্তা শােনা যাচ্ছে। তােমাকে উনি কখনাে তাড়া করেন নি ?
এই প্রসঙ্গটা থাক। থাকবে কেন?
সব আলাপ এক সঙ্গে করে ফেললে কীভাবে? কিছু ভােলা থাক। থাক, ভােলা থাক।
নবনীর ঘুম পাচ্ছে। সে হাই তুলতে তুলতে বলল, তােমার টেবিলের ড্রয়ারে দেখলাম একটা মেয়ের কয়েকটা ছবি। খুবই সুন্দর মেয়ে। সে কে?
জহির খাঁ সাহেবের ভাইস্তি। তােমার ড্রয়ারে তার ছবি কেন ?
চেয়ারম্যান সাহেব মেয়েটার বিয়ে দিতে চান। আমাকে পাত্র খুঁজতে বলেছেন। এইসব ছবি পাত্রপক্ষকে দেবার জন্যে।
এই মেয়ের পাত্র খোঁজার দরকার কী ? পাত্ররাই তাকে খুঁজবে। তা ঠিক।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে উঠতে উঠতে রাত এগারােটা বেজে গেল। আনিস বলল, টায়ার্ড হয়ে এসেছ শুয়ে পড়। আজ গরম কম আছে— ভালাে ঘুম হবে। এই কদিন প্রচণ্ড গরম পড়েছিল। তুমি তাে আবার গরম একেবারেই সহ্য করতে পারি না।
নবনী বলল, আমি শীতও সহ্য করতে পারি না। দুটাই আমার অসহ্য। তবে গরমটা বেশি অসহ্য। তােমাদের এখানে মশা কেমন ?
মশা নেই।