তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(১১) হুমায়ূন আহমেদ

নবনী তার শাশুড়ির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেফরিদা তাঁর পুত্রবধূর দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সুপারি কাটতে কাটতে বললেনচট করে কোনাে সিদ্ধান্ত নিও না মা

তেঁতুল বনে জোছনানবনী বলল, আমি কোনাে সিদ্ধান্ত নেই নিবলেই তার মনে হলো সে ভুল কথা বলেছেসিদ্ধান্ত সে নিয়েছেকঠিন সিদ্ধান্তসিদ্ধান্তের কথা কাউকে জানাতে ইচ্ছা করছে না। 

ফরিদা শান্তগলায় বললেন, মাগাে আমি তােমার শ্বশুরের মতাে বােকা মানুষ আমার অনেক বুদ্ধিতুমি যে একটা কিছু ঠিক করেছ তা আমি জানিতােমার মাছ হয়ে গেছেমাছের ডেগচিটা নামাও। 

নবনী চুলা থেকে হাড়ি নামালফরিদা বললেন, তরকারির রঙ ভালাে হয়েছেএখানে যে সব হলুদ পাওয়া যায় তাতে তরকারিতে রঙ হয় নাপাটনাইয়া হলুদে ভালাে রঙ হয়লবণ মনে হয় সামান্য বেশি হয়েছেসুরুয়া কেমন ছাড়াছাড়া লাগছেএকটু লবণ চেখে দেখতাে। 

নবনী লবণ চেখে বিস্মিত গলায় বলল, আপনি এত কিছু শিখেছেন কোথায়

আমার মার কাছে শিখেছিতােমার মা বেঁচে থাকলে তিনি তােমাকে শেখাতেনএখন আমি শিখাব। 

নবনী কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল নাফরিদা বললেন, মা তুমি কি বলতে চাও বলে ফেল। 

কিছু বলতে চাচ্ছি না। 

কিছু অবশ্যই বলতে চাচ্ছিলে, শেষ মুহূর্তে তােমার কাছে মনে হয়েছে বলা ঠিক হবে না। তুমি বলতে পারআমি যেকোনাে কিছুই সহজভাবে নিতে 

পারি। 

নবনী বলল, ধরুন কোনাে কারণে যদি আপনার ছেলের সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তারপরেও কি শেখাবেন

ফরিদা ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তারপরেও যদি তােমার আমার এখানে আসার মতাে সাহস থাকে তাহলে অবশ্যই শেখাব। 

দরজায় কেউ কড়া নাড়ছেফরিদা বেগমের ঠোটে অস্পষ্ট হাসির রেখাতিনি নবনীর দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বললেনতােমার শশুর চলে এসেছেনআজ মনে হয় স্টেশন পর্যন্ত যেতে পারে নিতার আগেই ফিরে এসেছেনবনী বলল, মা আপনি খুবই ভাগ্যবতী একজন মহিলাফরিদা বললেন, অবশ্যই আমি ভাগ্যবতীবাংলাদেশে প্রথম পাঁচজন ভাগ্যবতী স্ত্রীর তালিকা তৈরি হলে সেখানে আমার নাম থাকবে। 

দরজার কড়া অতি দ্রুত নড়ছেসালেহ সাহেবের গলার স্বরও পাওয়া যাচ্ছেফরিদাফরিদা। 

নবনী দরজা খােলার জন্যে উঠতে যাচ্ছে, ফরিদা বললেন, তুমি বােস মাদরজা খােলার দরকার নাইকিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করুকশাস্তি হােক। 

বিরাটনগর হাই স্কুলের সামনে আজ চাপা উত্তেজনা। 

 গুজব শােনা যাচ্ছে আজ জুম্মঘরের ইমাম সাহেবকে নেংটো করে স্কুলের মাঠে চক্কর দেওয়ানাে হবেগুজবটা কেউ ঠিক বিশ্বাসও করতে পারছে না, আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে নাচেয়ারম্যান সাহেব বিচিত্র সব কাণ্ড করেনতার পক্ষে এই ধরনের শাস্তি দেয়া অসম্ভব নাআবার জুম্মাঘরের ইমাম সাহেবের মতাে মানুষকে নেংটো করে কানে ধরে চক্কর দেওয়ানাে হবে এটাও বিশ্বাসযােগ্য না। 

স্কুল ঘরের সামনে কয়েকটা চেয়ার এবং দুটা বেঞ্চ রাখা হয়েছেমাঝখানের চেয়ারে চেয়ারম্যান সাহেব পা তুলে বসেছেনতার পরনে ধবধবে সাদা সিল্কের লুঙ্গিগায়ে পাঞ্জাবিপাঞ্জাবিও ধবধবে সাদাতবে সিল্কের না বলে চকচক করছে নাচেয়ারম্যান সাহেবের মুখ ভর্তি পানপান খেলেই তার মুখ হাসিহাসি হয়ে যায়তার মুখ হাসিহাসিচেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে আছেন হাই স্কুলের হেডমাস্টার বাবু ঈশ্বরচন্দ্র এম..বি.টি,হেডমাস্টার সাহেবের সঙ্গে স্কুলের কয়েকজন শিক্ষকও আছেনশিক্ষকরা সবাই চুপচাপতারা গত তিন মাসে কোনাে সরকারি ডিএ পাচ্ছেন না

ছাত্র বেতনের আদায় খুবই সামান্যজহির খা সাহেব প্রতি মাসে স্কুলে বেশ কিছু টাকা দেনগত দুমাসে সেই টাকাও দিচ্ছেন না। ঘটনা কী জানা যাচ্ছে নাশিক্ষকরা শংকিতবিরাটনগরের গণ্যমান্যদের মধ্যে সরকার বাড়ির ইরফান সরকার আছেননয়াবাড়ির আজিজ মিয়াও সেজেগুজে উপস্থিত হয়েছেনআরাে কিছু লােকজনের আসার কথা, তারা এখনাে এসে উপস্থিত হন নিআছরের নামাজের পর সবাইকে আসতে বলা হয়েছেআছরের নামাজের সময় মাত্র হয়েছেতবে বাজার থেকে বেশ কিছু লােকজন এসেছেতারা আলাদা বসেছেবাজারের লােকজনদের সম্মানের চোখে দেখা হয় নাগ্রামের সালিশি বৈঠকে তারাও থাকে, তবে আলাদা থাকে। 

চেয়ারম্যান সাহেব নয়াবাড়ির আজিজ মিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, পুকুর কাটাইতেছ শুনলাম। 

আজিজ মিয়া বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, একটা ইচ্ছা আছেছেলে টাকা পাঠায়েছে তার ইচ্ছা বড় একটা পুকুরপাথরের ঘাটলা হইবপুলাপাইন্যা শখ । 

চেয়ারম্যান সাহেব আরাে একটা পান মুখে দিতে দিতে বলল, খারাপ কী

আজিজ মিয়া উত্তেজিত গলায় বলল, ছেলে চিঠিতে লিখেছেআব্বাজান পুকুরে মাছ ছাড়িবেন কিন্তু মাছ বিক্রয় করিবেন নামাছ বড় হউকদেশে ফিরিয়া হুইল বর্শি দিয়া মাছ ধরিব। 

জহির খাঁ পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন, চিঠি মুখস্থ করে বসে আছপুরা চিঠি মুখস্ত, না এই দুই লাইন মুখস্ত

আজিজ মিয়া লজ্জিত মুখে বলল, অনেকবার কইরা এক চিঠি পড়িইয়াদ থাকে। 

তােমার ছেলে ভালাে দেখাইছেআপনাদের দোয়া। 

জহির খাঁ সামান্য গম্ভীর হয়ে গেলেনআজিজ মিয়া বছর সাতেক আগেও হত দরিদ্র ছিলফসল তােলার সময় অন্যের ক্ষেতে কামলা দিততার ছেলেকীভাবে কীভাবে কুয়েত চলে গেলতারপর টাকা পাঠাতে শুরু করলআজিজ মিয়ার বাড়িতে টিনের ঘর উঠল। সেই টিনের ঘরের পাশে উঠল পাকা বাড়িআজিজ মিয়া জমি কেনা শুরু করল। বাজারে ঘর নিলএখন জানা গেল পুকুর কাটা হবে

জহির খাঁর কানে এসেছে যে আজিজ মিয়া বলে বেড়াচ্ছে এমন পুসকুনি দিব যে চেয়ারম্যান সাহেবের পুসকুনিরে আমার পুসকুনির সামনে মনে হইব ব্যাঙের ছাতাঅতি অপমানসূচক কথাজহির খাঁ বিশ্বাস করেন না আজিজ মিয়া ধরনের কথা বলতে পারেতবে পুরােপুরি অবিশ্বাসও করা যায় নাছােটলােকের যদি হঠাৎ পয়সা হয় তাহলে পয়সার গরমে পাছা গরম হয়ে যায়। মাথা গরম লােক অনেক উল্টাপাল্টা কথা বলে সেইসব কথার মাপ থাকেপাহা গরম লােকের কথার কোনাে মাপ থাকে না। 

আজিজ মিয়া তৃপ্তির সঙ্গে বলল, ছেলেটা লােক মারফত আমারে আর তার মারে মক্কা শরিফ থাইক্যা কাফনের কাপড় কিন্যা পাঠাইছে। বড়ই আনন্দের ব্যাপার! এই কাপড় কাবা শরীফ ছুঁয়াইয়া আনাইছে। 

ভালাে তাে। 

আবার চিঠিতে লিখেছে হজ্জ কইরা যাইতে সে ব্যবস্থা করবেযাও, হজ্জ কইরা আস। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *