নবনী তার শাশুড়ির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ফরিদা তাঁর পুত্রবধূর দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সুপারি কাটতে কাটতে বললেন– চট করে কোনাে সিদ্ধান্ত নিও না মা।
নবনী বলল, আমি কোনাে সিদ্ধান্ত নেই নি। বলেই তার মনে হলো সে ভুল কথা বলেছে। সিদ্ধান্ত সে নিয়েছে। কঠিন সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্তের কথা কাউকে জানাতে ইচ্ছা করছে না।
ফরিদা শান্তগলায় বললেন, মাগাে আমি তােমার শ্বশুরের মতাে বােকা মানুষ । আমার অনেক বুদ্ধি। তুমি যে একটা কিছু ঠিক করেছ তা আমি জানি। তােমার মাছ হয়ে গেছে। মাছের ডেগচিটা নামাও।
নবনী চুলা থেকে হাড়ি নামাল। ফরিদা বললেন, তরকারির রঙ ভালাে হয়েছে। এখানে যে সব হলুদ পাওয়া যায় তাতে তরকারিতে রঙ হয় না। পাটনাইয়া হলুদে ভালাে রঙ হয়। লবণ মনে হয় সামান্য বেশি হয়েছে। সুরুয়া কেমন ছাড়াছাড়া লাগছে। একটু লবণ চেখে দেখতাে।
নবনী লবণ চেখে বিস্মিত গলায় বলল, আপনি এত কিছু শিখেছেন কোথায় ?
আমার মার কাছে শিখেছি। তােমার মা বেঁচে থাকলে তিনি তােমাকে শেখাতেন। এখন আমি শিখাব।
নবনী কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। ফরিদা বললেন, মা তুমি কি বলতে চাও বলে ফেল।
কিছু বলতে চাচ্ছি না।
কিছু অবশ্যই বলতে চাচ্ছিলে, শেষ মুহূর্তে তােমার কাছে মনে হয়েছে বলা ঠিক হবে না। তুমি বলতে পার— আমি যে–কোনাে কিছুই সহজভাবে নিতে
পারি।
নবনী বলল, ধরুন কোনাে কারণে যদি আপনার ছেলের সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তারপরেও কি শেখাবেন ?
ফরিদা ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তারপরেও যদি তােমার আমার এখানে আসার মতাে সাহস থাকে তাহলে অবশ্যই শেখাব।
দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে। ফরিদা বেগমের ঠোটে অস্পষ্ট হাসির রেখা। তিনি নবনীর দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বললেন– তােমার শশুর চলে এসেছেন। আজ মনে হয় স্টেশন পর্যন্ত যেতে পারে নি। তার আগেই ফিরে এসেছে। নবনী বলল, মা আপনি খুবই ভাগ্যবতী একজন মহিলা। ফরিদা বললেন, অবশ্যই আমি ভাগ্যবতী। বাংলাদেশে প্রথম পাঁচজন ভাগ্যবতী স্ত্রীর তালিকা তৈরি হলে সেখানে আমার নাম থাকবে।
দরজার কড়া অতি দ্রুত নড়ছে। সালেহ সাহেবের গলার স্বরও পাওয়া যাচ্ছে– ফরিদা। ফরিদা।
নবনী দরজা খােলার জন্যে উঠতে যাচ্ছে, ফরিদা বললেন, তুমি বােস মা। দরজা খােলার দরকার নাই। কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করুক। শাস্তি হােক।
বিরাটনগর হাই স্কুলের সামনে আজ চাপা উত্তেজনা।
গুজব শােনা যাচ্ছে আজ জুম্মঘরের ইমাম সাহেবকে নেংটো করে স্কুলের মাঠে চক্কর দেওয়ানাে হবে। গুজবটা কেউ ঠিক বিশ্বাসও করতে পারছে না, আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না। চেয়ারম্যান সাহেব বিচিত্র সব কাণ্ড করেন। তার পক্ষে এই ধরনের শাস্তি দেয়া অসম্ভব না। আবার জুম্মাঘরের ইমাম সাহেবের মতাে মানুষকে নেংটো করে কানে ধরে চক্কর দেওয়ানাে হবে এটাও বিশ্বাসযােগ্য না।
স্কুল ঘরের সামনে কয়েকটা চেয়ার এবং দু’টা বেঞ্চ রাখা হয়েছে। মাঝখানের চেয়ারে চেয়ারম্যান সাহেব পা তুলে বসেছেন। তার পরনে ধবধবে সাদা সিল্কের লুঙ্গি। গায়ে পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবিও ধবধবে সাদা। তবে সিল্কের না বলে চকচক করছে না। চেয়ারম্যান সাহেবের মুখ ভর্তি পান। পান খেলেই তার মুখ হাসিহাসি হয়ে যায়। তার মুখ হাসিহাসি। চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে আছেন হাই স্কুলের হেডমাস্টার বাবু ঈশ্বরচন্দ্র এম.এ.বি.টি,। হেডমাস্টার সাহেবের সঙ্গে স্কুলের কয়েকজন শিক্ষকও আছেন। শিক্ষকরা সবাই চুপচাপ। তারা গত তিন মাসে কোনাে সরকারি ডিএ পাচ্ছেন না।
ছাত্র বেতনের আদায় খুবই সামান্য। জহির খা সাহেব প্রতি মাসে স্কুলে বেশ কিছু টাকা দেন। গত দু’মাসে সেই টাকাও দিচ্ছেন না। ঘটনা কী জানা যাচ্ছে না। শিক্ষকরা শংকিত। বিরাটনগরের গণ্যমান্যদের মধ্যে সরকার বাড়ির ইরফান সরকার আছেন। নয়াবাড়ির আজিজ মিয়াও সেজেগুজে উপস্থিত হয়েছেন। আরাে কিছু লােকজনের আসার কথা, তারা এখনাে এসে উপস্থিত হন নি। আছরের নামাজের পর সবাইকে আসতে বলা হয়েছে। আছরের নামাজের সময় মাত্র হয়েছে। তবে বাজার থেকে বেশ কিছু লােকজন এসেছে। তারা আলাদা বসেছে। বাজারের লােকজনদের সম্মানের চোখে দেখা হয় না। গ্রামের সালিশি বৈঠকে তারাও থাকে, তবে আলাদা থাকে।
চেয়ারম্যান সাহেব নয়াবাড়ির আজিজ মিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, পুকুর কাটাইতেছ শুনলাম।
আজিজ মিয়া বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, একটা ইচ্ছা আছে। ছেলে টাকা পাঠায়েছে তার ইচ্ছা বড় একটা পুকুর। পাথরের ঘাটলা হইব। পুলাপাইন্যা শখ ।
চেয়ারম্যান সাহেব আরাে একটা পান মুখে দিতে দিতে বলল, খারাপ কী ?
আজিজ মিয়া উত্তেজিত গলায় বলল, ছেলে চিঠিতে লিখেছে—আব্বাজান পুকুরে মাছ ছাড়িবেন কিন্তু মাছ বিক্রয় করিবেন না। মাছ বড় হউক। দেশে ফিরিয়া হুইল বর্শি দিয়া মাছ ধরিব।
জহির খাঁ পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন, চিঠি মুখস্থ করে বসে আছ। পুরা চিঠি মুখস্ত, না এই দুই লাইন মুখস্ত ?
আজিজ মিয়া লজ্জিত মুখে বলল, অনেকবার কইরা এক চিঠি পড়ি—ইয়াদ থাকে।
তােমার ছেলে ভালাে দেখাইছে। আপনাদের দোয়া।
জহির খাঁ সামান্য গম্ভীর হয়ে গেলেন। আজিজ মিয়া বছর সাতেক আগেও হত দরিদ্র ছিল। ফসল তােলার সময় অন্যের ক্ষেতে কামলা দিত। তার ছেলে। কীভাবে কীভাবে কুয়েত চলে গেল। তারপর টাকা পাঠাতে শুরু করল। আজিজ মিয়ার বাড়িতে টিনের ঘর উঠল। সেই টিনের ঘরের পাশে উঠল পাকা বাড়ি। আজিজ মিয়া জমি কেনা শুরু করল। বাজারে ঘর নিল। এখন জানা গেল পুকুর কাটা হবে।
জহির খাঁর কানে এসেছে যে আজিজ মিয়া বলে বেড়াচ্ছে এমন পুসকুনি দিব যে চেয়ারম্যান সাহেবের পুসকুনিরে আমার পুসকুনির সামনে মনে হইব ব্যাঙের ছাতা। অতি অপমানসূচক কথা। জহির খাঁ বিশ্বাস করেন না আজিজ মিয়া এ ধরনের কথা বলতে পারে। তবে পুরােপুরি অবিশ্বাসও করা যায় না। ছােটলােকের যদি হঠাৎ পয়সা হয় তাহলে পয়সার গরমে পাছা গরম হয়ে যায়। মাথা গরম লােক অনেক উল্টাপাল্টা কথা বলে সেইসব কথার মাপ থাকে। পাহা গরম লােকের কথার কোনাে মাপ থাকে না।
আজিজ মিয়া তৃপ্তির সঙ্গে বলল, ছেলেটা লােক মারফত আমারে আর তার মারে মক্কা শরিফ থাইক্যা কাফনের কাপড় কিন্যা পাঠাইছে। বড়ই আনন্দের ব্যাপার! এই কাপড় কাবা শরীফ ছুঁয়াইয়া আনাইছে।
ভালাে তাে।
আবার চিঠিতে লিখেছে হজ্জ কইরা যাইতে । সে ব্যবস্থা করবে। যাও, হজ্জ কইরা আস।