ইচ্ছা আছে কিন্তু নানান ঝামেলায় জড়াইয়া পড়ছি—বাজারে আরেকটা নয়া ঘর নিছি।
বাজারে ঘর নিয়েছ ? জ্বি, দলিল রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে। ভালাে তাে।
জহির খাঁ পানের পিক ফেললেন। তার কপালে সামান্য ভাঁজ পড়ল— বিরাটনগরে অনেক কিছুই ঘটছে যার খোজ তিনি রাখেন না। বাজারে ঘর রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে সেই খবরও তিনি পান নি এটা অবিশ্বাস্য ঘটনা। আজিজ মিয়া তলে তক্টে সুড়ং কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। লােকটা অতি বুদ্ধিমান। ছােটলােকের হাতে হঠাৎ পয়সা এলে নানান আলামত দেখা যায়। এরা তখন বড় কাৰ্প মাছ ছাড়া ভাত খেতে পারে না। আড়ং–এ ষাড়ের লড়াইয়ের জন্যে আঁড় কিনে ফেলে। সপ্তাহে দুই দিন যায় নেত্রকোনা ছবি দেখার জন্যে। আজিজ মিয়া তার কিছুই করছে না— জমি কিনছে, বাজারে ঘর রাখছে। তিনি খবর পেয়েছেন আজিজ মিয়া ব্যবসা ভালােই বুঝে। সরিষার ব্যবসা করে এই বৎসর অনেক টাকা কামিয়েছে।
স্কুলের দপ্তরি নাশতা নিয়ে এল। ধামাভর্তি মাখানাে মুড়ি। পেঁপে। ঈশ্বর বাবু বিনীত গলায় বললেন, চেয়ারম্যান সাব নাশতা করেন। চা আসতেছে। গুড়ের রং চা করতে বলেছি। গুড়ের চা আপনার পছন্দ।
জহির খা হাই তুলতে তুলতে বললেন, তােমরা খাও। আমার মুখে পান। | ঈশ্বর বাবু নিচু গলায় বললেন— ভালাে নাশতার আয়ােজন করার ইচ্ছা ছিল। স্কুল ফান্ডের অবস্থা শােচনীয়। ক্লাসটেনে ছাত্র মাত্র সাতজন।।
জহির খা গম্ভীর গলায় বললেন, ছাত্র কম কেন? পড়াশােনা ভালাে হয় ? | ঈশ্বরচন্দ্র হতাশ গলায় বললেন– যে সব স্কুলে সেন্টার পায় সেখানে ছাত্র হয়। নকলের সুবিধা হয় কি–না সেটা সবেই আগে দেখে। খুবই দুর্দশায় আছি। অঞ্চলের বিশিষ্ট গণ্যমান্যরা যদি না দেখে তাহলে স্কুল উঠায়ে দিতে হবে।
দাও উঠায়ে দাও। সবকিছুর জন্ম মৃত্যু আছে। স্কুলেরও আছে। আফসােস কইরা তাে লাভ নাই। আগে রাজা বাদশা ছিল, তারা হাতি পুষত। স্কুল কলেজ এইগুলা হইল হাতি। এখন রাজা বাদশা নাই– হাতিও থাকব না। সােজা হিসাব।
আজিজ মিয়া অতি দ্রুত মাথা নাড়তে নাড়তে বলল অবশ্যই অবশ্যই। স্কুলের শিক্ষকরা আহত চোখে তাকিয়ে রইল আজিজ মিয়ার দিকে।
জুম্মঘরের ইমাম সাহেবকে আসতে দেখা গেল। চেয়ারম্যান সাহেব তার মনযােগ সেই দিকে দিলেন। একসঙ্গে অনেক কিছু নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে নাই। চিন্তা ভাবনা হলাে পুতির মালার মতাে। একেকটা চিন্তা একেকটা পুতি। আর সুতাটা হলাে চিন্তার লাইন। সব পুতি এক লাইনে বাধতে হয়। এই কাজ সবাই পারে না । ইমাম সাহেবের কাছে গত রাতে তিনি লােক পাঠিয়েছিলেন। লােক মারফত তিনি একটা প্রস্তাব দিয়েছেন। ইমাম যদি অপরাধ স্বীকার করে তাহলে তিনি তাকে নেংটা করে ঘুরাবেন না। দোষ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করলে ইমামের চাকরি বহাল থাকার সম্ভাবনা আছে। দোষ স্বীকার না করলে শাস্তি হবে।
ইমাম সাহেবের চোখ রক্তবর্ণ। তিনি গত কয়েক রাত ধরে ঘুমাচ্ছেন না তা তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। ঠিকমতো হেঁটে আসতেও পারছেন না। মাতালের মতাে হেলে দুলে এগুচ্ছেন। জুম্মার নামাজের দিন তিনি যে পােশাক পরেন আজও তাই পরেছেন কালাে আচকান, মাথায় সাদা পাগড়ি। সাদা পাগড়ির সঙ্গে কালাে আচকান খুব মানিয়েছে, তাকে সুফি সুফি লাগছে। আজ তিনি চোখে সুরমাও পরেছেন। অন্য যে–কোনাে সালিশির দিনে ইমাম সাহেব আসা মাত্র তাঁকে চেয়ার দেয়া হয়। আজ দেয়া হলাে না। তিনি জহির খাঁর সামনে। দাড়িয়ে রইলেন। তার চোখে মুখে দিশাহারা ভাব।
ইমাম সাহেবের নাম ইয়াকুব। উলা পাস। বয়স পঞ্চাশের ওপরে। তিনি পাঁচ বছর হলাে বিরাটনগরে আছেন। তার বাড়ি মধুপুর। স্ত্রী এবং দুই কন্যা মধুপুরেই থাকে। তিনি মাঝে মধ্যে মধুপুর তাদের দেখতে যান। বছর দুই আগে ইমাম সাহেবের স্ত্রী তার দুই কন্যাকে নিয়ে এখানেও বেড়াতে এসেছিলেন–– এক সপ্তাহ ছিলেন। গ্রামের মানুষজন তখন তার দুই কন্যার রূপ দেখে মােহিত হয়েছিল। বড় মেয়েটির নাম সকিনা, ছােটটির নাম জরিনা। গ্রামের মানুষজন এখনাে কোনাে রূপবতী মেয়ে দেখলে বলে— ইমাম সাহেবের বড় মেয়ে সকিনার মতাে সুন্দর।
সকিনার বিয়ে ঠিক হয়েছে। পান–চিনি হয়ে গেছে। কার্তিক মাসের নয় তারিখ বিবাহ। ছেলে সরকারি কলেজে অংকের লেকচারার। ইমাম সাহেব
কন্যার বিবাহ উপলক্ষে এক মাসের ছুটি নিয়েছেন। দেশে রওনা হবার আগে এমন বিপত্তি।
চারদিকে গুনগুন হচ্ছিল। ঈশ্বর বাবু উঠে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় বললেন সাইলেন্স। পিনড্রপ সাইলেন্স। গুনগুনানি বন্ধ হলাে। জহির খার পাঞ্জাবিতে পানের পিক লেগে গেছে। তিনি খুবই বিরক্ত চোখে পানের পিকের দিকে তাকিয়ে আছেন। ইমাম সাহেব ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন, চেয়ারম্যান সাব আসসালামু আলায়কুম। | সালাম দিলে নিতে হয়। এটাই নিয়ম।
জহির খা নিয়মের ব্যতিক্রম করলেন। সালাম নিলেন না। শব্দ করে মেঝেতে পানের পিক ফেললেন। গলা খাকারি দিয়ে শুকনাে গলায় বললেন— আপনি চিন্তা ভাবনা কিছু করেছেন? অপরাধ স্বীকার করলে ভিন্ন বিবেচনা ।
ইমাম সাহেব কাপা কাঁপা গলায় বললেন, আমি কোনাে অপরাধ করি নাই। আল্লা সাক্ষি আমার দুই কান্দের দুই ফেরেশতা সাক্ষি আমি নিরপরাধ ।।
জহির খাঁ বিরক্ত মুখে বললেন, আপনের দুই কান্দের দুই ফিরিশতা তাে সাক্ষি দিবে না। এদের কথা খামাখা বইল্যা তাে লাভ নাই। আপনে বিরাট অন্যায় করেছেন। এই অঞ্চলের নাম বিরাটনগর। এইখানে যা হয় সবই বিরাট। মানুষ যখন অন্যায় করে ছােট অন্যায় করতে পারে না। বিরাট অন্যায় করে। আপনি দোষ স্বীকার না করলে যে শাস্তির কথা বলেছিলাম সেই শাস্তি দিব। আপনে বড় অপমান হবেন।
ইমাম সাহেব কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, আমি কোনাে দোষ করি নাই, কিন্তু তারপরও দোষ স্বীকার করলাম।
প্যাচের কথায় কাজ হবে না ইমাম সাহেব। দোষ করি নাই কিন্তু দোষ স্বীকার করলাম এটা কেমন কথা ? আমি বিবাহ করি নাই কিন্তু সে আমার বিবাহীত স্ত্রী— এইটা কি হয় ? | লােকজন হাে হাে করে হেসে ফেলল। জহির খা সেই হাসিতে যুক্ত হলেন না। তিনি গম্ভীর মুখে বললেন– আপনি যে পাপ করেছেন সেই পাপ ব্যাভিচারের চেয়েও খারাপ।
আমাদের ধর্মে যে ব্যাভিচার করে তার শাস্তি কী জানেন নিশ্চয়ই। গর্ত খুঁড়ে তাকে চুকানাে হয়— তারপরে পাথর ছুঁড়ে মারা হয় । আমি সে রকম কিছু করব না। কাপড় চোপড় খুলে কানে ধরে আপনাকে চক্কর। দেওয়াব। শাস্তি শেষ। এখন শেষবারের মতাে জিজ্ঞেস করতেছি আপনি কি অপরাধ করেছেন?
জ্বি করেছি। আপনি কি সবের কাছে ক্ষমা চান ? জ্বি চাই। তাহলে প্রথম কেন বললেন দোষ করেন নাই ?
আমি দোষ করি নাই এইজন্যে বলেছি দোষ করি নাই। এখন কেন বলতেছেন দোষ করছেন? অপমানের হাত থেকে বাচার জন্যে বলতেছি।
অর্থাৎ আপনি স্বীকার করেন না যে দোষ করেছেন ? শেষ জবাব দেন। আমি আর ছওয়াল জবাব করতে পারব না। হ্যা কিংবা না বলেন। দোষ। করেছেন ?
জ্বি না। দোষ তাহলে করেন নাই ? ইমাম সাহেব হড়বড় করে বললেন দোষ করেছি।
জহির খা কঠিন গলায় বললেন— আপনে তাে একেকবার একেক কথা বলতেছেন।
জনাব আমার মাথাটা আওলায়ে গেছে।