আমি কী বলতেছি কী বলতেছি কিছুই বুঝতেছি না।
জহির খা শান্ত গলায় বললেন, ঠিক আছে আপনারে বুঝাইবার ব্যবস্থা করতেছি। সবেই চট কইরা বুঝে না। কেউ তাড়াতাড়ি বুঝে আবার কেউ আছে বুইঝাও বুঝে না।
ইমাম সাহেব মাথার পাগড়ি খুলে হাতে নিয়েছেন। গরমে তার মাথার সব চুল ভিজে গেছে। চুল থেকে ঘামের ফোটা কপাল বেয়ে নামছে। তার ঠোট নড়ছে। মনে হচ্ছে তিনি দ্রুত কোনাে সূরা পাঠ করছেন।
রাত আটটার মতাে বাজে। আনিস বিছানায় শুয়ে আছে। বিকেল থেকেই তার গা ম্যাজ ম্যাজ করছিল, এখন শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। ডাক্তাররা নিজেদের অসুখ বিসুখের ব্যাপারে উদাসীন হয়। আনিস তার ব্যতিক্রম না। থার্মোমিটারে সে জ্বর দেখে নি। দু‘টা এনালজেসিক ট্যাবলেট খেয়ে জ্বর কমানাের চেষ্টাও কারে নি। হাত পা এলিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। তার সামান্য দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে রাতের খাবার নিয়ে। তার রান্না বান্না করে দেয় সুজাত মিয়া। বয়স দশ
এগারাে। তার পায়ে সমস্যা আছে। একটা পা বড়, একটা ছােট। হাঁটে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। পরশু সকাল থেকে সুজাত নিখোজ। কোথায় গেছে কাউকে কিছু বলে যায় নি। ছেলেটি অতি ভদ্র, অতি বিনয়ী, কাজ কর্মে দক্ষ। তার একটাই সমস্যা মাঝে মাঝে কাউকে কিছু না বলে নিখোঁজ হয়ে যায়। আবার ফিরে এসে কাজকর্ম শুরু করে দেয়। ভাবটা এ রকম যেন কিছুই হয় নি। সে কোথাও যায় নি। এখানেই ছিল।
আনিসের ঘরে হারিকেন জ্বলছে। বিরাটনগরে পল্লী বিদ্যুৎ এসেছে। ডাক্তারের কোয়ার্টারে পল্লী বিদ্যুতের লাইন আছে। ইলেকট্রিকের তারে কী সমস্যা হয়েছেবাতি জ্বলছে না। তার ঠিক করার জন্যে ইলেকট্রিশিয়ান আনার জন্যে খবর পাঠাতে হবে নেত্রকোনায় । আলসেমির জন্যে খবর পাঠানাে হচ্ছে
আনিস রােজ রাতে ভাবে কালই লােক পাঠাবে। সকালে মনে থাকে না। কাল অবশ্যই লােক পাঠাতে হবে। নবনী চিঠি লিখেছে সে আসবে। নবনী শীতের দিনেও এসি ছাড়া ঘুমুতে পারে না। ফ্যান তাে লাগবেই। আশ্বিন মাসে দিনে রােদের তাপ বেশি। রাতটা অবশ্যি ঠাণ্ডা— তারপরেও ফ্যান লাগবে। নবনীর এবারের চিঠিটা নিয়েও আনিস সামান্য চিন্তিত। চিঠির কথা কেমন যেন এলােমেলাে! তার কি কোনাে সমস্যা যাচ্ছে? সমস্যার ব্যাপারটা লেখা নেই। লেখা থাকলে ভালাে হতাে আনিস চিন্তা করতে পারত। প্রায় রাতেই তার কোনাে কাজ থাকে না। তখন কোনাে কিছু নিয়ে ভাবতে ভালাে লাগে।
আনিস বালিশের নিচ থেকে নবনীর চিঠি বের করল। এই চিঠি এর মধ্যেই কয়েকবার পড়া হয়েছে। আরাে একবার পড়লে ক্ষতি কিছু নেই।
ডাক্তার সাহেব,
কেমন আছ তুমি ? জঙ্গলে দিনকাল কেমন কাটছে ? অসহ্য বােধ হওয়া শুরু হয় নি ? আমি যখন ছােটবেলায় গ্রামের বাড়িতে বাবার সঙ্গে বেড়াতে যেতাম প্রথম দিন খুব ভালাে লাগত। দ্বিতীয় দিনে ভালাে লাগাটা কমে যেত। তৃতীয় দিন থেকে অসহ্য লাগা শুরু হতাে। তুমি কীভাবে বৎসর পার করে দিচ্ছ ভাবতে অবাক লাগছে।
আমি ভেবে দেখলাম—তুমি তেল আমি জল। তােমার পছন্দ এক রকম। আমার অন্য রকম। বিবাহ নামক ঝাকুনি যন্ত্রের মাধ্যমে তেল জল মিশে যাচ্ছে। আবার ঝাঁকুনি বন্ধ হলেই তেল আলাদা, জল আলাদা। আমাদের সার্বক্ষণিক
সুখে থাকার জন্যে প্রবল ঝাঁকুনি যন্ত্র দরকার। সে রকম যন্ত্র আবিষ্কৃত হয় নি বলে আমি ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তায় আছি।
তােমার এখানে তিন দিনের জন্যে আসব। প্রথম দিন আমার খুবই ভালাে লাগবে। দ্বিতীয় দিন ভালাে লাগাটা একটু কমবে। তৃতীয় দিনে অসহ্য বােধ হতে থাকলে তখন চলে আসব। কিছু মানুষ আছে অসহনীয় অবস্থা সহনীয় করার জন্যে চেষ্টা চালায়। আমার এবং তােমার, আমাদের দু’জনেরই দুর্ভাগ্য আমি সে রকম না। আমি কেন এ রকম হয়েছি সেটা নিয়ে ভেবেছি। উত্তর পাই নি।
তােমাকে জানানাে হয় নি ইদানিং আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাওয়া–আসা করছি। ভদ্রলােক আমাদের আত্মীয় এবং আমাকে ছােটবেলা থেকেই খুব স্নেহ করেন। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাবার উদ্দেশ্য হলাে তিনি যেন রাতে ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্ন দেখার হাত থেকে আমাকে বাচান। একবারতাে আমি তােমাকে লিখেছিলাম যে আমি দুঃস্বপ্ন দেখি। সেই দুঃস্বপ্নগুলাে কত ভয়ঙ্কর তা লেখা হয় নি। রাতে দেখা ভয়ের স্বপ্নগুলাে যখন দিনে মনে করি বা কাউকে বলতে যাই তখন খুবই হাস্যকর মনে হয়। গত বৃহস্পতিবার রাতে কী স্বপ্নে দেখেছি শােন– দেখলাম আমি পুরনাে ধরনের রেলিং দেয়া খাটে শুয়ে আছি।
খাটের। চারদিকে রেলিং ধরে আট ন‘জন বােরকাপরা মহিলা দাড়িয়ে আছেন। এবং সবাই হাত বাড়িয়ে আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছেন। আমি নিশ্চিত যে তােমার কাছে স্বপ্নটা মােটেই ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে না। এখন আমার কাছেও মনে হচ্ছে না। কিন্তু স্বপ্নটা দেখার সময় কী যে ভয় পেয়েছিলাম! আমি সাইকিয়াট্রিস্ট চাচার পরামর্শ মতাে একটা খাতা বানিয়েছি। সেই খাতার নাম দিয়েছি স্বপ্ন–খাতা । আমি এই খাতায় স্বপ্নগুলাে লিখে রাখছি। তােমার এখানে আসার সময়। খাতাটা নিয়ে আসব। তুমি পড়ে দেখ। আমি নিশ্চিত তুমি মজা পাবে।
সাইকিয়াট্রিস্ট চাচা আমাকে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে কী সিদ্ধান্তে এসেছেন শুনতে চাও ? তার সিদ্ধান্ত হলাে আমি
নাকি মানসিকভাবে বিয়েটা মেনে নিতে পারছি না। তােমার সঙ্গে বিয়ে আমার মনের ওপর প্রবল চাপ ফেলেছে। এই মানসিক চাপই স্বপ্ন হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এটা সাইকিয়াট্রিস্টের সিদ্ধান্ত। তােমার সিদ্ধান্ত কী ? ভালাে থেকো ।
নবনী
আনিসের শরীর কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। জ্বর কি বেড়েছে ? ঘরে থার্মোমিটার নেই। ক্ষিধে লেগেছে, কিন্তু খেতে ইচ্ছা করছে না। দুটা বিপরীতমুখী ব্যাপার একসঙ্গে কী করে ঘটে ? শরীর যন্ত্র নষ্ট হলে এরকম হয়। জলাতংকের রােগীর তৃষ্ণায় বুক ফাটে কিন্তু পানি খেতে পারে না। না উদাহরণটা ঠিক হলাে না । জলাতংকের রােগীর তৃষ্ণা হয়, পানিও খেতে চায় খিচুনির জন্যে খেতে পারে না।
মন যন্ত্র নষ্ট হলেও বিপরীতমুখী ব্যাপারগুলাে দেখা যায়। পাশাপাশি দুটি নদী। একটি অন্যটির গায়ের ওপর দিয়ে বইছে। একটির পানি যাচ্ছে সাগরের দিকে। অন্যটির পানি সাগর থেকে উঠে রওনা হয়েছে পর্বতমালার দিকে।
নবনীর মনে কি এরকম দুটি ধারা বইছে? সে দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে কেন? আনিস কি তার জীবনে বড় ধরনের কোনাে আশাভঙ্গের ব্যাপার ঘটিয়েছে ?
নবনীর ব্যাপারে আনিসের মনে আশাভঙ্গের কিছু ঘটে নি। সে জানে নবনী চমৎকার একটি মেয়ে। তার একটাই সমস্যা সে ভয়াবহ নিঃসঙ্গ। আনিস সেই নিঃসঙ্গতা দূর করতে পারে নি। বিরাটনগর ছেড়ে সে যদি ঢাকায় গিয়ে নবনীর সঙ্গে বাস করতেও থাকে তাতেও নবনীর নিঃসঙ্গতা দূর হবে না। কিছু কিছু মানুষ বিচিত্র ধরনের নিঃসঙ্গতা নিয়ে পৃথিবীতে আসে। কারাের সাধ্য নেই সেই নিঃসঙ্গতা দূর করে। সেই সব মানুষরা তাদের নিঃসঙ্গতা দূর করার চেষ্টা নিজেরাই করে। তা করতে গিয়ে কেউ বড় লেখক হয়, কেউ হয় চিত্রকর, বিজ্ঞানী।