আবার কেউ কেউ হয়তাে তার মতাে ডাক্তার হয়। চারপাশের মানুষদের নিয়ে অসম্ভব ব্যস্ত থেকে নিজের নিঃসঙ্গতা ভুলে থাকতে চায়।
আনিস নবনীর নিঃসঙ্গতা জানে। নবনী কি আনিসের নিঃসঙ্গতা জানে ?
দরজায় শব্দ হচ্ছে। ভয়ে ভয়ে কেউ একজন কড়া নাড়ছে। কড়া নাড়ার শব্দ থেকে মনে হয় সুজাত ফিরে এসেছে। আনিস উঠে দরজা খুলল।
সুজাত মিয়া না, মতি দাড়িয়ে আছে। তার পরনে নতুন শার্ট, নতুন লুঙ্গি। পায়ে নতুন রাবারের জুতা ! যে ছাতা হাতে সে দাড়িয়ে আছে ছাতাটাও নতুন। আনিসের সাইকেল বিক্রি করে সে ভালাে দাম পেয়েছে। আট শ‘ টাকা। আট শ’র মধ্যে ছয় শ’ নগদ পেয়েছে। দু‘শ’ টাকা এখনাে বাকি আছে। বাকি দু’শ” টাকা আদায় করতে কষ্ট হবে। শেষ পর্যন্ত আদায় হয় কি–না সেই বিষয়েও তার ক্ষীণ সন্দেহ আছে। মতির খরচের হাত ভালাে। ছয় শ টাকার প্রায় সবটাই একদিনে শেষ হয়েছে। নিজের জামা–কাপড় ছাড়াও সে দুটা টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি কিনেছে। একটা মর্জিনার জন্যে, আরেকটা বাতাসীর জন্যে।
বাতাসী মেয়েটা বাজারে নতুন এসেছে। বাতাসীর গলার স্বর অতি মধুর। এমন মধুর স্বরে সে এর আগে কোনাে মেয়েকে কথা বলতে শােনে নি। বাতাসীর আরাে একটি ব্যাপারে সে মুগ্ধ। সেটা হলো বাতাসীর গায়ের গন্ধ। অবিকল তেজপাতার গন্ধ। মানুষের গায়ে নানা রকম গন্ধ থাকে। তেজপাতার গন্ধও যে থাকে এটা সে কল্পনাও করে নি। মর্জিনার গায়ের গন্ধ টকটক। খারাপ টক গন্ধও ভালাে লাগে। তবে তেজপাতার গন্ধ অন্য জিনিস। | মতি বাতাসীর কাছে নিজের পরিচয় দিয়েছে বিরাটনগর হাই স্কুলের শিক্ষক। এতে কয়েকটা উপকার হয়েছে।
বাতাসী তাকে আলাদা খাতির করছে। স্যার’ ডাকছে। মতির দিক দিয়ে সামান্য সমস্যা হচ্ছে— কথাবার্তা শিক্ষকদের মতাে বলতে হচ্ছে। শুদ্ধ ভাষা বলতে হচ্ছে। মতি এখন সরাসরি বাতাসীর কাছ থেকে এসেছে। শাড়ি দিতে গিয়েছিল। ইচ্ছা ছিল রাতটা থেকে যাবে। বাতাসী অন্য মানুষ ঘরে নিয়ে নিয়েছে বলে সেটা সম্ভব হয় নি। তবে খুব আফসােস করেছে। দুঃখ দুঃখ গলায় বলেছে— আপনে আইজ আসবেন আগে কইবেন না ? মতি বলেছে— আগে থেকে কিছু বলা যায় না। মন উদাস হইলেই শুধু তােমার কাছে আসি। মানুষের মন কখন উদাস হইব কখন হইব
এইটা বলা বেজায় কঠিন। মানুষের মন তাে কাঠাল না যে জ্যৈষ্ঠ মাসে পাকব। মানুষের মন যে–কোনাে সময় পাকতে পারে।
বাতাসী মুগ্ধ গলায় বলেছে—ইস্! আপনি এত সুন্দর কইরা ক্যামনে কথা কন?
মতি বলেছে, আমরা শিক্ষক মানুষ, আমরার কথার এইটাই ধারা। এই নাও শাড়ি। রঙ পছন্দ হইছে ? | বাতাসী হতভম্ব গলায় বলেছে আমার জন্যে শাড়ি আনছেন ? কী। আচানক কথা! আফনে মানুষটা অত ভালা কেন হইছেন ?
বাতাসীর আনন্দ এবং বিস্ময় দেখে মতির বড় ভালাে লেগেছে। মর্জিনার ভেতর এই জিনিস নেই। সে আনন্দিতও হয় না, বিস্মিতও হয় না। শুধু খাবার দেখলে তার চোখ চকচক করে। একটা শাড়ি পেলে সে যত খুশি হয় তারচে অনেক বেশি খুশি হয় আধা কেজি গরম জিলাপি পেলে।
আনিস বলল, মতি কী খবর? | মতি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, খবর মাশাল্লাহ ভালাে। কয়েক দিন বাইরে কাজকর্মে ছিলাম। গৌরীপুর গিয়েছিলাম। আইজ সন্ধ্যায় ফিরছি। ইস্টিশনে নাইমা শুনলাম আপনার সাইকেল চুরি গেছে। মনটা এমন খারাপ হইছে? ভাবলাম দেখা কইরা যাই।
আনিস ক্লান্ত গলায় বলল, আমার সাইকেল চুরির খবর কি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে ? | কী বলেন— এইটা একটা ঘটনা না ? তবে চিন্তা কইরেন না— গৌরীপুরের এক পীর সাহেব আছেন, চাউল পড়া দেন। সেই চাউল পড়া খাওয়াইয়া দিয়া সাইকেল চোর বাইর করা এক ঘণ্টার মামলা।
চাল পড়া দিয়ে সাইকেল চোর ধরা যায় ?
অবশ্যই। পীর সাহেবের চাউল পড়া খাইয়া যদি কেউ মিথ্যা কথা বলে সাথে সাথে রক্তবমি । আমার নিজের চউক্ষে দেখা।
আনিস বলল, তুমি কি বসবে না চলে যাবে ? আমার শরীরটা ভালাে না। আমি শুয়ে পড়ব।
আপনার যদি অসুবিধা না হয় দুই চাইর মিনিট বসি। আপনার এইখান থাইকা যাব ইমাম সাহেবের কাছে। উনি চইলা যাবেন— দেখা কইরা আসি যত খারাপ লােকই হউক এতদিন মানুষটা গ্রামে ছিল। তার পেছনে কয়েকবার নামাজও পড়েছি। ডাক্তার সাহেবের কি শরীর বেশি খারাপ?
মনে হয় বেশিই খারাপ। কেঁপে জ্বর আসছে।
মতি হাই তুলতে তুলতে বলল, আমরার ইমাম সাহেবেরও শুনেছি বেজায় জ্বর। জ্বরের মধ্যে উল্টা পাল্টা কথা বলতেছে। আপনার কাছে কেউ খবর নিয়া আসে নাই ?
না তাে! একটা চক্করের পরেই ঠাশ কইরা মাথা ঘুইরা পইড়া গেল। আনিস অবাক হয়ে বলল, তােমার কথা বুঝলাম না— কীসের চক্কর ?
মতি তার চেয়েও অবাক হয়ে বলল, ইমাম সাবরে যে আইজ লেংটা কইরা চক্কর দেয়া হইছে আপনে জানেন না ?
জানি না। বাদ আছর চক্কর দেয়ানি হইল। বিরাট জনতা। মনে হইতেছিল ষাঁড়ের আড়ং।
আনিস হতাশ গলায় বলল, চেয়ারম্যান সাহেব শেষ পর্যন্ত এই কাজটা করলেন ?
মতি বলল, করব না আপনে কী কন? আমরার চেয়ারম্যান সাব এক কথার মানুষ। বাক্কা বেড়ার চাক্কা। হে যদি বলে আমি বাঘের দুধ খামু তাইলে আপনে নিশ্চিন্ত থাকবেন বাঘের দুধ আসতাছে। সুন্দরবন থাইক্যা বাঘ আইব, হেই বাঘ পানানি হইব হেই দুধ জামবাটির এক বাটি চেয়ারম্যান সাব নিয়া খাইব।
মতি তুমি বুঝতে পারছ না কাজটা খুবই অন্যায় হয়েছে।
আপনের কাছে অন্যায়, কিন্তু গ্রামের আর দশটা লােকের কাছে ন্যায়। যেমন ধরেন আপনের সাইকেল চুরি হইছে। আপনার কাছে মনে হইছে কাজটা অন্যায় কিন্তু যে চুরি করছে তার কাছে কাজটা ন্যায়।
আনিস শার্ট গায়ে দিল। লুঙ্গি বদলে প্যান্ট পরতে শুরু করল। মতি অবাক হয়ে বলল, শইল খারাপ নিয়া যান কই ?
ইমাম সাহেবকে দেখে আসি। চলেন যাই। ওষুধের বাক্স সাথে নেন। শুনছি ইমাম সাহেবের অবস্থা ভালাে । ক্ষণে ক্ষণে বমি হইতেছে।
আনিসের খুব খারাপ লাগছে। শুধু খারাপ না রাগও লাগছে। বিরাটনগরে কী হচ্ছে না–হচ্ছে এইসব নিয়ে তার কখনাে মাথাব্যথা ছিল না। যা ইচ্ছা হােক। সে ডাক্তার মানুষ, সে রােগের নিদান দেবে। এর বেশি কিছু না। সে রােগ চিনবে, যে মানুষটাকে রােগে ধরেছে তাকে তার চেনার দরকার নেই। বেচারা ইমাম সাহেবের জন্যে তার এই মুহূর্তে যে মায়াটা হচ্ছে তার কারণটা আনিসের কাছে স্পষ্ট না। ইমাম সাহেব তার খুব যে পরিচিত কেউ তা না। ভাসা ভাসা পরিচয়। হঠাৎ দেখা হলে অল্প কিছু কথা।
এই মানুষটা মসজিদ এবং মসজিদের পাশে ছােট্ট চালাঘর নিয়ে একা থাকেন। ভদ্রলােকের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বাতিক আছে। সারাক্ষণই তাকে দেখা যায় হয় মসজিদ পরিষ্কার করছেন নয়তাে নিজের বাড়ি পরিষ্কার করছেন। উঠান ঝাঁট দিচ্ছেন, বাড়ির সামনের আগাছা তুলছেন। তিনি মসজিদের চার কোণায় চারটা কৃষ্ণচূড়ার গাছ লাগিয়েছেন। এই
গাছ চারটার প্রতি তার মমতা অসীম। কারাে সঙ্গে কথা হলেই, কৃষ্ণচূড়া গাছের প্রসঙ্গ চলে আসে।
নবনী যখন বিরাটনগরে এসেছিল তখন ইমাম সাহেব বেশ কিছু পাকা তেতুল নিয়ে নবনীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তার বাড়ির দক্ষিণদিকে তেতুলগাছে খুব তেতুল হয়। ইমাম সাহেব বিনীত ভঙ্গিতে নবনীকে বলেছিলেন– আপনার স্বামীর এই অঞ্চলে ভালাে চিকিৎসক হিসেবে খুবই সুনাম।