তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(১৪) হুমায়ূন আহমেদ

আবার কেউ কেউ হয়তাে তার মতাে ডাক্তার হয়চারপাশের মানুষদের নিয়ে অসম্ভব ব্যস্ত থেকে নিজের নিঃসঙ্গতা ভুলে থাকতে চায়তেঁতুল বনে জোছনা

আনিস নবনীর নিঃসঙ্গতা জানেনবনী কি আনিসের নিঃসঙ্গতা জানে

দরজায় শব্দ হচ্ছেভয়ে ভয়ে কেউ একজন কড়া নাড়ছেকড়া নাড়ার শব্দ থেকে মনে হয় সুজাত ফিরে এসেছেআনিস উঠে দরজা খুলল। 

সুজাত মিয়া না, মতি দাড়িয়ে আছেতার পরনে নতুন শার্ট, নতুন লুঙ্গিপায়ে নতুন রাবারের জুতা ! যে ছাতা হাতে সে দাড়িয়ে আছে ছাতাটাও নতুন। আনিসের সাইকেল বিক্রি করে সে ভালাে দাম পেয়েছেআট টাকাআট র মধ্যে ছয় নগদ পেয়েছে। দুশ’ টাকা এখনাে বাকি আছেবাকি দুটাকা আদায় করতে কষ্ট হবেশেষ পর্যন্ত আদায় হয় কিনা সেই বিষয়েও তার ক্ষীণ সন্দেহ আছেমতির খরচের হাত ভালােছয় টাকার প্রায় সবটাই একদিনে শেষ হয়েছেনিজের জামাকাপড় ছাড়াও সে দুটা টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি কিনেছেএকটা মর্জিনার জন্যে, আরেকটা বাতাসীর জন্যে। 

বাতাসী মেয়েটা বাজারে নতুন এসেছেবাতাসীর গলার স্বর অতি মধুরএমন মধুর স্বরে সে এর আগে কোনাে মেয়েকে কথা বলতে শােনে নিবাতাসীর আরাে একটি ব্যাপারে সে মুগ্ধসেটা হলো বাতাসীর গায়ের গন্ধঅবিকল তেজপাতার গন্ধমানুষের গায়ে নানা রকম গন্ধ থাকেতেজপাতার গন্ধও যে থাকে এটা সে কল্পনাও করে নিমর্জিনার গায়ের গন্ধ টকটকখারাপ  টক গন্ধও ভালাে লাগেতবে তেজপাতার গন্ধ অন্য জিনিস। | মতি বাতাসীর কাছে নিজের পরিচয় দিয়েছে বিরাটনগর হাই স্কুলের শিক্ষকএতে কয়েকটা উপকার হয়েছে

বাতাসী তাকে আলাদা খাতির করছেস্যারডাকছেমতির দিক দিয়ে সামান্য সমস্যা হচ্ছেকথাবার্তা শিক্ষকদের মতাে বলতে হচ্ছেশুদ্ধ ভাষা বলতে হচ্ছে। মতি এখন সরাসরি বাতাসীর কাছ থেকে এসেছেশাড়ি দিতে গিয়েছিল। ইচ্ছা ছিল রাতটা থেকে যাবেবাতাসী অন্য মানুষ ঘরে নিয়ে নিয়েছে বলে সেটা সম্ভব হয় নিতবে খুব আফসােস করেছেদুঃখ দুঃখ গলায় বলেছেআপনে আইজ আসবেন আগে কইবেন না ? মতি বলেছেআগে থেকে কিছু বলা যায় নামন উদাস হইলেই শুধু তােমার কাছে আসি। মানুষের মন কখন উদাস হইব কখন হইব 

এইটা বলা বেজায় কঠিনমানুষের মন তাে কাঠাল না যে জ্যৈষ্ঠ মাসে পাকবমানুষের মন যেকোনাে সময় পাকতে পারে। 

বাতাসী মুগ্ধ গলায় বলেছেইস্! আপনি এত সুন্দর কইরা ক্যামনে কথা কন

মতি বলেছে, আমরা শিক্ষক মানুষ, আমরার কথার এইটাই ধারা। এই নাও শাড়ি। রঙ পছন্দ হইছে ? | বাতাসী হতভম্ব গলায় বলেছে আমার জন্যে শাড়ি আনছেন ? কী। আচানক কথা! আফনে মানুষটা অত ভালা কেন হইছেন

বাতাসীর আনন্দ এবং বিস্ময় দেখে মতির বড় ভালাে লেগেছেমর্জিনার ভেতর এই জিনিস নেইসে আনন্দিতও হয় না, বিস্মিতও হয় নাশুধু খাবার দেখলে তার চোখ চকচক করেএকটা শাড়ি পেলে সে যত খুশি হয় তারচে অনেক বেশি খুশি হয় আধা কেজি গরম জিলাপি পেলে। 

আনিস বলল, মতি কী খবর? | মতি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, খবর মাশাল্লাহ ভালােকয়েক দিন বাইরে কাজকর্মে ছিলামগৌরীপুর গিয়েছিলামআইজ সন্ধ্যায় ফিরছিইস্টিশনে নাইমা শুনলাম আপনার সাইকেল চুরি গেছেমনটা এমন খারাপ হইছে? ভাবলাম দেখা কইরা যাই। 

আনিস ক্লান্ত গলায় বলল, আমার সাইকেল চুরির খবর কি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে ? | কী বলেনএইটা একটা ঘটনা না ? তবে চিন্তা কইরেন নাগৌরীপুরের এক পীর সাহেব আছেন, চাউল পড়া দেন। সেই চাউল পড়া খাওয়াইয়া দিয়া সাইকেল চোর বাইর করা এক ঘণ্টার মামলা। 

চাল পড়া দিয়ে সাইকেল চোর ধরা যায়

অবশ্যইপীর সাহেবের চাউল পড়া খাইয়া যদি কেউ মিথ্যা কথা বলে সাথে সাথে রক্তবমি আমার নিজের চউক্ষে দেখা। 

আনিস বলল, তুমি কি বসবে না চলে যাবে ? আমার শরীরটা ভালাে নাআমি শুয়ে পড়ব। 

আপনার যদি অসুবিধা না হয় দুই চাইর মিনিট বসিআপনার এইখান থাইকা যাব ইমাম সাহেবের কাছেউনি চইলা যাবেনদেখা কইরা আসি যত খারাপ লােকই হউক এতদিন মানুষটা গ্রামে ছিলতার পেছনে কয়েকবার নামাজও পড়েছিডাক্তার সাহেবের কি শরীর বেশি খারাপ

মনে হয় বেশিই খারাপকেঁপে জ্বর আসছে। 

মতি হাই তুলতে তুলতে বলল, আমরার ইমাম সাহেবেরও শুনেছি বেজায় জ্বরজ্বরের মধ্যে উল্টা পাল্টা কথা বলতেছেআপনার কাছে কেউ খবর নিয়া আসে নাই

না তাে! একটা চক্করের পরেই ঠাশ কইরা মাথা ঘুইরা পইড়া গেলআনিস অবাক হয়ে বলল, তােমার কথা বুঝলাম নাকীসের চক্কর

মতি তার চেয়েও অবাক হয়ে বলল, ইমাম সাবরে যে আইজ লেংটা কইরা চক্কর দেয়া হইছে আপনে জানেন না

 জানি নাবাদ আছর চক্কর দেয়ানি হইলবিরাট জনতামনে হইতেছিল ষাঁড়ের আড়ং। 

আনিস হতাশ গলায় বলল, চেয়ারম্যান সাহেব শেষ পর্যন্ত এই কাজটা করলেন

মতি বলল, করব না আপনে কী কন? আমরার চেয়ারম্যান সাব এক কথার মানুষবাক্কা বেড়ার চাক্কাহে যদি বলে আমি বাঘের দুধ খামু তাইলে আপনে নিশ্চিন্ত থাকবেন বাঘের দুধ আসতাছেসুন্দরবন থাইক্যা বাঘ আইব, হেই বাঘ পানানি হইব হেই দুধ জামবাটির এক বাটি চেয়ারম্যান সাব নিয়া খাইব। 

মতি তুমি বুঝতে পারছ না কাজটা খুবই অন্যায় হয়েছে। 

আপনের কাছে অন্যায়, কিন্তু গ্রামের আর দশটা লােকের কাছে ন্যায়যেমন ধরেন আপনের সাইকেল চুরি হইছেআপনার কাছে মনে হইছে কাজটা অন্যায় কিন্তু যে চুরি করছে তার কাছে কাজটা ন্যায়। 

আনিস শার্ট গায়ে দিল। লুঙ্গি বদলে প্যান্ট পরতে শুরু করলমতি অবাক হয়ে বলল, শইল খারাপ নিয়া যান কই

ইমাম সাহেবকে দেখে আসিচলেন যাইওষুধের বাক্স সাথে নেনশুনছি ইমাম সাহেবের অবস্থা ভালাে ক্ষণে ক্ষণে বমি হইতেছে। 

আনিসের খুব খারাপ লাগছেশুধু খারাপ না রাগও লাগছেবিরাটনগরে কী হচ্ছে নাহচ্ছে এইসব নিয়ে তার কখনাে মাথাব্যথা ছিল নাযা ইচ্ছা হােকসে ডাক্তার মানুষ, সে রােগের নিদান দেবেএর বেশি কিছু নাসে রােগ চিনবে, যে মানুষটাকে রােগে ধরেছে তাকে তার চেনার দরকার নেইবেচারা ইমাম সাহেবের জন্যে তার এই মুহূর্তে যে মায়াটা হচ্ছে তার কারণটা আনিসের কাছে স্পষ্ট নাইমাম সাহেব তার খুব যে পরিচিত কেউ তা নাভাসা ভাসা পরিচয়হঠাৎ দেখা হলে অল্প কিছু কথা

এই মানুষটা মসজিদ এবং মসজিদের পাশে ছােট্ট চালাঘর নিয়ে একা থাকেনভদ্রলােকের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বাতিক আছেসারাক্ষণই তাকে দেখা যায় হয় মসজিদ পরিষ্কার করছেন নয়তাে নিজের বাড়ি পরিষ্কার করছেনউঠান ঝাঁট দিচ্ছেন, বাড়ির সামনের আগাছা তুলছেনতিনি মসজিদের চার কোণায় চারটা কৃষ্ণচূড়ার গাছ লাগিয়েছেনএই 

গাছ চারটার প্রতি তার মমতা অসীমকারাে সঙ্গে কথা হলেই, কৃষ্ণচূড়া গাছের প্রসঙ্গ চলে আসে। 

নবনী যখন বিরাটনগরে এসেছিল তখন ইমাম সাহেব বেশ কিছু পাকা তেতুল নিয়ে নবনীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেনতার বাড়ির দক্ষিণদিকে তেতুলগাছে খুব তেতুল হয়ইমাম সাহেব বিনীত ভঙ্গিতে নবনীকে বলেছিলেনআপনার স্বামীর এই অঞ্চলে ভালাে চিকিৎসক হিসেবে খুবই সুনাম

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *