উনাকে কিছু উপহার দিব এই সামর্থ আমার নাই। আপনার জন্যে কিছু পাকা তেতুল আনলাম। আমার গাছে হয়েছে। নবনী বলেছিল— গাছ থেকে পেড়ে এনেছেন ?
জ্বি। গাছে কি এখনাে তেতুল ঝুলছে ?
জ্বি।
এইগুলাে আপনি নিয়ে যান। আমি গাছে উঠে নিজের হাতে পাকা তেতুল পাড়ব।
ইমাম সাহেব খুবই লজ্জিত গলায় বলেছেন— এটা সম্ভব না। মসজিদের কাছে গাছ। সেই গাছে মেয়েছেলে উঠে তেতুল পাড়বে— এটা ঠিক না।
নবনী তেজি গলায় বলেছিল, ঠিক না কেন? আল্লাহ রাগ করবেন ? তার উত্তরে ইমাম সাহেব বলেছেন, আল্লাহপাক এত সহজে রাগ করেন । কিন্তু মানুষ রাগ করে। আমরা এমন যে মানুষের রাগটাকেই বেশি ভয় পাই।
ইমাম সাহেবের ঘরে হারিকেন জ্বলছে। তিনি মেঝেতে পাটির ওপর কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে আছেন। শীতল পাটি বমিতে মাখামাখি। তিনি বমির মধ্যেই শুয়ে আছেন। কিছুক্ষণ পর পর কেঁপে কেঁপে উঠছেন। তার মনে হয় এজমা আছে। যতবারই নিঃশ্বাস নিচ্ছেন বুকের ভেতর থেকে শো শো শব্দ আসছে। ঘরে কটু গন্ধ।
মতি বলল, ইমাম সাব জাগনা আছেন ? ডাক্তার সাব আসছেন।
ইমাম সাহেব মাথা তুলে তাকালেন। আবার মাথা নামিয়ে ফেললেন। তাকে দেখে মনে হলাে না তিনি কাউকে চিনতে পেরেছেন।
আনিস বলল, মতি উনাকে গােসল দেয়া দরকার। গােসল করাতে পারবে?
মতি বলল, আপনে বললে পারব।
আনিস বলল, বালতিতে করে পানি আন। সাবান আন। দুজনে মিলে গােসল দিয়ে দেই।
মতি বলল, আপনার এত ঠেকা কী ডাক্তার সাব! ডাক্তার বিরক্ত গলায় বলল, সে একজন রােগী। এই জন্যেই আমার ঠেকা।
মতি ডাক্তারকে হাত দিতে দিল না। নিজেই সাবান দিয়ে ডলে গােসল দিল। শরীর মুছে শুকনাে কাপড় পরিয়ে ধরাধরি করে বিছানায় শুইয়ে দিল। ইমাম সাহেবের গায়ে জ্বর নেই। জ্বর ছাড়াই তিনি কাঁপছেন। আনিস বলল, আপনি রাতে কিছু খেয়েছেন ?
ইমাম সাহেব হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, জ্বি না। আপনার খাবার কে বেঁধে দেয় ? আমি নিজে রাব্ধি ডাক্তার সাব।
আমি আপনার জন্যে এক গ্লাস দুধ পাঠিয়ে দিচ্ছি। খেয়ে শুয়ে থাকুন। দুটা ট্যাবলেট পাঠাব। দুধ খাওয়ার পরে খাবেন। ঘুমের ওষুধ। ভালাে ঘুম হবে।
ইমাম সাহেব কিছু বললেন না। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন। ডাক্তার দ্রুত চিন্তা করছে– ঘুমের ওষুধ ছাড়াও কি আরাে কিছু দেয়া দরকার। মানুষটার স্নায়ুর ওপর দিয়ে একটা ঝড়ের মতাে গিয়েছে। উত্তেজিত স্নায়ু ঠিক করতে হলে কী সিডেটিভ দিতে হবে ? মানুষটা একা থাকে একজন কেউ সঙ্গে থাকলে ভালাে হতাে। কথাবার্তা বলতে পারত। মানুষের সঙ্গ মাঝে মাঝে ওষুধের চেয়েও অনেক বেশি কার্যকর হয়।
ডাক্তার সাব আপনার অনেক মেহেরবাণী । মেহেরবানির কিছু না আপনি বিশ্রাম করুন।
ইমাম সাহেব হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, যে অপরাধের জন্যে আমার শাস্তি হয়েছে সেই অপরাধ আমি করি নাই। তবে নিশ্চয়ই কোনাে অপরাধ করেছি। যে কারণে আল্লাহপাকের নির্দেশে আমার শাস্তি হয়েছে। উনার অনুমতি ছাড়া কিছুই হয় না।
ডাক্তার বলল, আপনি কথা বলবেন না। বিশ্রাম করুন। আমি ওষুধ পাঠাচ্ছি।
ইমাম সাহেব চোখ বন্ধ করে ফেললেন। বিড়বিড় করে নিজের মনেই বললেন, ডাক্তার সাব আপনার মেহেরবানি।
ফেরার পথে মতি তিক্ত গলায় বলল, কেমন মানুষ দেখছেন ডাক্তার সাব ? মুখে একবার বলল না ধন্যবাদ। বমি সাফ করা আর ও সাফ করা একই। বমি পেটে আর কিছুক্ষণ থাকলেই গু হইয়া যায়— কথা সত্য কিনা বলেন ডাক্তার সাব। আনিস জবাব দিল না। ইমাম সাহেবের বাড়ি গ্রামের শেষ মাথায়। আনিসকে শরীরে জ্বর নিয়ে অনেকখানি হাঁটতে হয়েছে। বেশ খারাপ লাগছে। অসহ্য লাগছে মতির বকবকানি। আনিস মতিকে চলে যেতে বলতে পারছে না। কারণ মতিকে দিয়ে ওষুধ পাঠাতে হবে।
গরম কেমন পড়ছে দেখছেন ডাক্তার সাব ?
এখন আশ্বিন মাস— কেঁথা–শীত পড়নের কথা। পড়ছে গরম। দুনিয়া উলট পার্ট হওয়া শুরু হইতেছে। কেয়ামত মনে হয় কাছাইয়া পড়ছে। কী কন ?
হতে পারে।
মতি আগ্রহের সঙ্গে বলল, কেয়ামতের আগে আগে মাটির তল থাইক্যা এক জন্তু বাইর হইব। হে মানুষের মতাে কথা বলব। এই জন্তুটা দেখার বড় শখ ছিল। দশ পনরাে বছরের মধ্যে কিয়ামত হইলে জন্তুটা দেখতে পারতাম। অন্তুর সাথে দুই চাইরটা কথা বলতে পারতাম। ডাক্তার সাব আপনের কি মনে হয় দশ বছরের মধ্যে কিয়ামত হইতে পারে ?
জানি না মতি।
জন্তুটা কোন ভাষায় কথা বলব কে জানে! চাইনীজ ভাষায় কথা বললে আমরা বাঙালিরা কিছুই বুঝব না।
মতি, কথা বলা একটু বন্ধ রাখ। মাথা ধরেছে।
আমার নিজেরাে মাথা ধরছে ডাক্তার সাব এই জন্যেই কথা বেশি বলতেছি। আমি একটা জিনিস পরীক্ষা কইরা বাইর করছি— মাথায় যদি খুব যন্ত্রণা হয় তাইলে কথা বললে যন্ত্রণা কমে। আর কথা না বইল্যা ঘরের চিপাত বইস্যা। থাকলে মাথা ধরা বেজায় বাড়ে।
এক গ্লাস দুধ, দুটা বিসকিট আর ওষুধ নিয়ে মতি রওনা হলাে ইমাম সাহেবের বাড়ির দিকে। পথে কিছুক্ষণ দেরি হলাে— ইস্টিশনের চায়ের দোকানটা ভােলা, মতি এক কাপ চা খেল । চা খাওয়া মানেই গল্পগুজব। গল্পগুজবেও কিছু সময় গেল। সেখান থেকে গেল বাতাসীর ঘরে। জেনে যাওয়া–– ঐ লােকটা এখনাে তার ঘরে আছে কি–না। থাকলেও কিছু যায় আসে।
না—না থাকলেও না। লােকটা তাে আর বিনা পয়সায় থাকছে না। পয়সা দিয়ে থাকছে। লোকটা যদি চলে গিয়ে থাকে তাহলে বাতাসীর সঙ্গে এক কাপ চা খাওয়া যাবে। এই ভেবে সে পুরনাে কোকের বােতল ভর্তি করে এক বােতল চা সঙ্গে নিয়ে মিল। বাতাসীর ঘরে লােক থাকলে কোকের বোতল নিয়ে ইমাম সাহেবের কাছে যাবে। চা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে তাতে অসুবিধা নাই। ঠাণ্ডা চা খেতে মতির খারাপ লাগে না। বরং ঠাণ্ডা চা খেতেই তার বেশি ভালাে লাগে।
এত সব করতে মতির অনেক দেরি হয়ে গেল। সে ইমাম সাহেবের বাড়ি পৌছাল রাত একটায়। আকাশে তখন কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ। আবছা আবছা সব কিছু দেখা যায়। মতি হতভম্ব হয়ে দেখল ইমাম সাহেবের বাড়ির ডান দিকের তেতুল গাছের নিচে কী যেন দাঁড়িয়ে আছে। মতি বলল— কেড়া গাে ?
কেউ জবাব দিল না। মতি বলল— কেডা? আপনে কে ? এই প্রশ্নেরও জবাব পাওয়া গেল না।
মতি এগিয়ে গেল। তার জন্যে বড় ধরনের চমক অপেক্ষা করছিল। তেতুল গাছের নিচে কেউ দাঁড়িয়ে ছিল না।