তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(১৭) হুমায়ূন আহমেদ

পথে কিছুক্ষণ দেরি হলােইস্টিশনের চায়ের দোকানটা ভােলা, মতি এক কাপ চা খেল চা খাওয়া মানেই গল্পগুজবগল্পগুজবেও কিছু সময় গেলসেখান থেকে গেল বাতাসীর ঘরেজেনে যাওয়ালােকটা এখনাে তার ঘরে আছে কিনাথাকলেও কিছু যায় আসেতেঁতুল বনে জোছনা

না—না থাকলেও নালােকটা তাে আর বিনা পয়সায় থাকছে নাপয়সা দিয়ে থাকছেলোকটা যদি চলে গিয়ে থাকে তাহলে বাতাসীর সঙ্গে এক কাপ চা খাওয়া যাবেএই ভেবে সে পুরনাে কোকের বােতল ভর্তি করে এক বােতল চা সঙ্গে নিয়ে মিলবাতাসীর ঘরে লােক থাকলে কোকের বোতল নিয়ে ইমাম সাহেবের কাছে যাবেচা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে তাতে অসুবিধা নাইঠাণ্ডা চা খেতে মতির খারাপ লাগে নাবরং ঠাণ্ডা চা খেতেই তার বেশি ভালাে লাগে। 

এত সব করতে মতির অনেক দেরি হয়ে গেলসে ইমাম সাহেবের বাড়ি পৌছাল রাত একটায়আকাশে তখন কৃষ্ণপক্ষের চাঁদআবছা আবছা সব কিছু দেখা যায়মতি হতভম্ব হয়ে দেখল ইমাম সাহেবের বাড়ির ডান দিকের তেতুল গাছের নিচে কী যেন দাঁড়িয়ে আছেমতি বললকেড়া গাে

কেউ জবাব দিল নামতি বললকেডা? আপনে কে ? এই প্রশ্নেরও জবাব পাওয়া গেল না। 

মতি এগিয়ে গেলতার জন্যে বড় ধরনের চমক অপেক্ষা করছিলতেতুল গাছের নিচে কেউ দাঁড়িয়ে ছিল নাগাছের ডাল থেকে ঝুলছিলেন ইমাম সাহেবমতি অতি দ্রুত দা দিয়ে দড়ি কেটে তাকে নামালইমাম সাহেব বিড় বিড় করে কী যেন বললেন, ঠিক বুঝা গেল নামনে হলাে পানি খেতে চাইছেনমতি ছুটে গেল পানি আনতে তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইমাম সাহেব মারা গেলেন। 

নিস্তরঙ্গ দিঘিতে ছােট্ট ঢিল পড়লেও অনেকক্ষণ ঢেউ ওঠেসেই অর্থে ইমাম সাহেবের মৃত্যুতে বিরাটনগরে যে ঢেউ ওঠার কথা সেই ঢেউ উঠল নাদিনই কাকতালীয়ভাবে যােগাযােগ মন্ত্রী চলে এলেনবিরাটনগররােয়াইলবাজার সড়কে মগরা নদীতে পুল হবে, তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনআগে কয়েকবার তারিখ দিয়েও মন্ত্রী আসতে পারেন নিএবারে তাই হুট করে চলে এসেছেন। 

মন্ত্রীর আগমন বিশাল ঘটনাসেই আগমন যদি হেলিকপ্টারের মতাে বাহনে হয় তাহলে তাে কথাই নেই। বিরাটনগরে যে আলােড়ন উঠল তার তুলনা নেইবিশাল এক পক্ষী পাখা ঘুরাতে ঘুরাতে নামছেতার শব্দে পৃথিবীকাপছেবিরাটনগরের লােকজনের জন্যে তুলনাহীন অভিজ্ঞতামন্ত্রীর হেলিকপ্টার দুপুর বারটায় এসে পৌছলতিনি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে বিরাটনগর হাইস্কুলের মাঠে এক ভাষণ দিলেনজনতা মন্ত্রমুগ্ধের মতাে ভাষণ শুনল। যােগাযােগ মন্ত্রীর যােগাযােগ ছাড়া অন্য কোনাে বিষয়ে কথা বলার কথা 

, যেহেতু স্কুলের মাঠে ভাষণের ব্যবস্থা সেহেতু তিনি শিক্ষার গুরুত্ব এবং প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কেও কিছু কথা বললেন এবং স্কুল ফান্ডে নগদ দশ হাজার টাকা ব্যক্তিগত তহবিল থেকে দান করলেন | গ্রামের মানুষজন তালি দিতে দিতে হাত ব্যথা করে ফেলল। 

 বক্তৃতা পর্বের শেষে চায়ের ব্যবস্থা। সেই ব্যবস্থা চেয়ারম্যান জহির খার বাড়িতে | জহির খাঁ অতি অল্প সময়ের নােটিশে চা পানের বিপুল আয়ােজন করে ফেললেনএমন ব্যবস্থা যে মন্ত্রী পর্যন্ত বলতে বাধ্য হলেনপ্রত্যন্ত গ্রামেও দেখি ভালাে ব্যবস্থা করেছেন! আমি তাে রকম আশাই করি নিমন্ত্রী আশা করেন নি এ রকম আরেকটি কাজ জহির খা করলেন গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে মন্ত্রীকে সােনার চেঁকি উপহার দিলেনমন্ত্রীর প্রথমবার আসার তারিখেই জহির খা ঢাকা থেকে পাচ ভরি সােনার চেঁকি বানিয়ে এনেছিলেনসেটা শুধু যে কাজে লাগল তা নাঅনেকখানি কাজে লাগলমন্ত্রী তিনবার বললেনবাহু 

জিনিসটা সুন্দর তােশুধু যে সুন্দর তানা, চেঁকি শাশ্বত বাংলার প্রতীকসাধারণত মন্ত্রী শ্রেণীর কাউকে কোনাে উপহার দিলে সেই উপহার বেশিক্ষণ হাতে রাখা নিয়ম নাছবি তােলা হয়ে গেলেই উপহার অন্য কারাের হাতে তুলে দেয়া হয়সােনার টেকির ক্ষেত্রে সে রকম হলাে নাফটোগ্রাফারের ছবি ভােলার পরও মন্ত্রী উপহার হাতে বসে রইলেন। হেলিকপ্টারে ওঠার সময়ও তার হাতে উপহারটা দেখা গেল| হেলিকপ্টারের উত্তেজনার পাশে ইমাম সাহেবের মৃত্যু তেমন কিছু নাপর পর দুটি উত্তেজনা মানুষ নিতে পারে নাবড় ধরনের একটি উত্তেজনাতেই মানুষ ঝিমিয়ে পড়ে

রকম ঝিমিয়ে পড়া অবস্থায় ইমাম সাহেবের লাশ নিয়ে নাটক শুরু হলােমন্ত্রী চলে যাবার পর রােয়াইল বাজার থানার ওসি কিছু হম্বিতম্বি করলেন। তিনি ঘােষণা করলেন, ডেডবডি দেখে তার মনে হচ্ছে না আত্মহত্যাকেউ খুন করে ঝুলিয়ে রেখেছেকঠিন তদন্ত হবেতদন্তে রুই কাতলা বের হয়ে পড়তে পারেপ্রয়ােজনে আসল খবর বের করার জন্যে থানায় নিয়ে ট্রিটমেন্ট দেয়া হবেহম্বিতম্বিতে তেমন কাজ হলাে নাজহির খা ওসিকে ডেকে বললেন, খামাখা প্যাচাল করবা নাসুরতহাল টাল কী করতে হয় ব্যবস্থা করডেডবডি মধুপুর পাঠায়ে দিতে হবে। 

ওসি সাহেব ধমক খেয়ে মিইয়ে গেলেনধমক এমন লােকের কাছ থেকে এসেছে যার বাড়িতে মন্ত্রী কিছুক্ষণ আগে খাওয়া দাওয়া করেছেনহেলিকপ্টারে ওঠার আগে আগে কোলাকুলি করেছেনযে সব মৃত্যু অর্থকরী না, পুলিশ সেসব মৃত্যুর বিষয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে

পুলিশ উৎসাহ হারিয়ে ফেললওসি সাহেব বিমর্ষ মুখে বললেনসুরতহালের জন্যে ডেডবডি নেয়ার ব্যবস্থা করছিথানা থেকে ভ্যানগাড়ি আসবেআত্মীয়স্বজন কেউ যেন যায়সুরতহালের ফিসআছেহাজার দুই টাকা যেন সাথে নেয়। 

পুলিশের ভ্যান সে রাতে এসে পৌছাল না

 মতি সারারাত ইমাম সাহেবের পাশে রইলরাত নটা দশটা পর্যন্ত তার সঙ্গে লােকজন ছিলএকে একে সবাই বিদায় হয়ে গেলমরা মানুষ ফেলে রেখে গেলে শিয়ালকুকুর খেয়ে ফেলবেমতির বিরক্তির সীমা রইল না

অন্যদের মতাে সেও কেন চলে গেল না? রকম বােকামিটা করল কীভাবে ? তার একমাত্র ভরসা সঙ্গে গাঁজা ভরা সিগারেট আছেগাঁজার ধোঁয়ায় টান দিয়ে যেকোনাে পরিস্থিতি পার করে দেয়া যায়সমস্যা একটাই খালিপেটে থাকলে চলবে নাপেট ভর্তি থাকতে হবে। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *