পথে কিছুক্ষণ দেরি হলাে— ইস্টিশনের চায়ের দোকানটা ভােলা, মতি এক কাপ চা খেল । চা খাওয়া মানেই গল্পগুজব। গল্পগুজবেও কিছু সময় গেল। সেখান থেকে গেল বাতাসীর ঘরে। জেনে যাওয়া–– ঐ লােকটা এখনাে তার ঘরে আছে কি–না। থাকলেও কিছু যায় আসে।
না—না থাকলেও না। লােকটা তাে আর বিনা পয়সায় থাকছে না। পয়সা দিয়ে থাকছে। লোকটা যদি চলে গিয়ে থাকে তাহলে বাতাসীর সঙ্গে এক কাপ চা খাওয়া যাবে। এই ভেবে সে পুরনাে কোকের বােতল ভর্তি করে এক বােতল চা সঙ্গে নিয়ে মিল। বাতাসীর ঘরে লােক থাকলে কোকের বোতল নিয়ে ইমাম সাহেবের কাছে যাবে। চা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে তাতে অসুবিধা নাই। ঠাণ্ডা চা খেতে মতির খারাপ লাগে না। বরং ঠাণ্ডা চা খেতেই তার বেশি ভালাে লাগে।
এত সব করতে মতির অনেক দেরি হয়ে গেল। সে ইমাম সাহেবের বাড়ি পৌছাল রাত একটায়। আকাশে তখন কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ। আবছা আবছা সব কিছু দেখা যায়। মতি হতভম্ব হয়ে দেখল ইমাম সাহেবের বাড়ির ডান দিকের তেতুল গাছের নিচে কী যেন দাঁড়িয়ে আছে। মতি বলল— কেড়া গাে ?
কেউ জবাব দিল না। মতি বলল— কেডা? আপনে কে ? এই প্রশ্নেরও জবাব পাওয়া গেল না।
মতি এগিয়ে গেল। তার জন্যে বড় ধরনের চমক অপেক্ষা করছিল। তেতুল গাছের নিচে কেউ দাঁড়িয়ে ছিল না। গাছের ডাল থেকে ঝুলছিলেন ইমাম সাহেব। মতি অতি দ্রুত দা দিয়ে দড়ি কেটে তাকে নামাল। ইমাম সাহেব বিড় বিড় করে কী যেন বললেন, ঠিক বুঝা গেল না। মনে হলাে পানি খেতে চাইছেন। মতি ছুটে গেল পানি আনতে তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইমাম সাহেব মারা গেলেন।
নিস্তরঙ্গ দিঘিতে ছােট্ট ঢিল পড়লেও অনেকক্ষণ ঢেউ ওঠে। সেই অর্থে ইমাম সাহেবের মৃত্যুতে বিরাটনগরে যে ঢেউ ওঠার কথা সেই ঢেউ উঠল না। ঐ দিনই কাকতালীয়ভাবে যােগাযােগ মন্ত্রী চলে এলেন। বিরাটনগর–রােয়াইলবাজার সড়কে মগরা নদীতে পুল হবে, তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন। আগে কয়েকবার তারিখ দিয়েও মন্ত্রী আসতে পারেন নি। এবারে তাই হুট করে চলে এসেছেন।
মন্ত্রীর আগমন বিশাল ঘটনা। সেই আগমন যদি হেলিকপ্টারের মতাে বাহনে হয় তাহলে তাে কথাই নেই। বিরাটনগরে যে আলােড়ন উঠল তার তুলনা নেই। বিশাল এক পক্ষী পাখা ঘুরাতে ঘুরাতে নামছে। তার শব্দে পৃথিবী। কাপছে। বিরাটনগরের লােকজনের জন্যে তুলনাহীন অভিজ্ঞতা। মন্ত্রীর হেলিকপ্টার দুপুর বারটায় এসে পৌছল। তিনি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে বিরাটনগর হাইস্কুলের মাঠে এক ভাষণ দিলেন। জনতা মন্ত্রমুগ্ধের মতাে ভাষণ শুনল। যােগাযােগ মন্ত্রীর যােগাযােগ ছাড়া অন্য কোনাে বিষয়ে কথা বলার কথা
, যেহেতু স্কুলের মাঠে ভাষণের ব্যবস্থা সেহেতু তিনি শিক্ষার গুরুত্ব এবং প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কেও কিছু কথা বললেন এবং স্কুল ফান্ডে নগদ দশ হাজার টাকা ব্যক্তিগত তহবিল থেকে দান করলেন | গ্রামের মানুষজন তালি দিতে দিতে হাত ব্যথা করে ফেলল।
বক্তৃতা পর্বের শেষে চায়ের ব্যবস্থা। সেই ব্যবস্থা চেয়ারম্যান জহির খার বাড়িতে | জহির খাঁ অতি অল্প সময়ের নােটিশে চা পানের বিপুল আয়ােজন করে ফেললেন। এমন ব্যবস্থা যে মন্ত্রী পর্যন্ত বলতে বাধ্য হলেন— প্রত্যন্ত গ্রামেও দেখি ভালাে ব্যবস্থা করেছেন! আমি তাে এ রকম আশাই করি নি। মন্ত্রী আশা করেন নি এ রকম আরেকটি কাজ জহির খা করলেন গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে মন্ত্রীকে সােনার চেঁকি উপহার দিলেন। মন্ত্রীর প্রথমবার আসার তারিখেই জহির খা ঢাকা থেকে পাচ ভরি সােনার চেঁকি বানিয়ে এনেছিলেন। সেটা শুধু যে কাজে লাগল তা না। অনেকখানি কাজে লাগল। মন্ত্রী তিনবার বললেন– বাহু
জিনিসটা সুন্দর তাে। শুধু যে সুন্দর তা–না, চেঁকি শাশ্বত বাংলার প্রতীক। সাধারণত মন্ত্রী শ্রেণীর কাউকে কোনাে উপহার দিলে সেই উপহার বেশিক্ষণ হাতে রাখা নিয়ম না। ছবি তােলা হয়ে গেলেই উপহার অন্য কারাের হাতে তুলে দেয়া হয়। সােনার টেকির ক্ষেত্রে সে রকম হলাে না। ফটোগ্রাফারের ছবি ভােলার পরও মন্ত্রী উপহার হাতে বসে রইলেন। হেলিকপ্টারে ওঠার সময়ও তার হাতে উপহারটা দেখা গেল। | হেলিকপ্টারের উত্তেজনার পাশে ইমাম সাহেবের মৃত্যু তেমন কিছু না। পর পর দুটি উত্তেজনা মানুষ নিতে পারে না। বড় ধরনের একটি উত্তেজনাতেই মানুষ ঝিমিয়ে পড়ে।
এ রকম ঝিমিয়ে পড়া অবস্থায় ইমাম সাহেবের লাশ নিয়ে নাটক শুরু হলাে। মন্ত্রী চলে যাবার পর রােয়াইল বাজার থানার ওসি কিছু হম্বিতম্বি করলেন। তিনি ঘােষণা করলেন, ডেডবডি দেখে তার মনে হচ্ছে না আত্মহত্যা। কেউ খুন করে ঝুলিয়ে রেখেছে। কঠিন তদন্ত হবে। তদন্তে রুই কাতলা বের হয়ে পড়তে পারে। প্রয়ােজনে আসল খবর বের করার জন্যে থানায় নিয়ে ট্রিটমেন্ট দেয়া হবে। হম্বিতম্বিতে তেমন কাজ হলাে না। জহির খা ওসিকে ডেকে বললেন, খামাখা প্যাচাল করবা না। সুরতহাল টাল কী করতে হয় ব্যবস্থা কর। ডেডবডি মধুপুর পাঠায়ে দিতে হবে।
ওসি সাহেব ধমক খেয়ে মিইয়ে গেলেন। ধমক এমন লােকের কাছ থেকে এসেছে যার বাড়িতে মন্ত্রী কিছুক্ষণ আগে খাওয়া দাওয়া করেছেন। হেলিকপ্টারে ওঠার আগে আগে কোলাকুলি করেছেন। যে সব মৃত্যু অর্থকরী না, পুলিশ সেসব মৃত্যুর বিষয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।
পুলিশ উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। ওসি সাহেব বিমর্ষ মুখে বললেন— সুরতহালের জন্যে ডেডবডি নেয়ার ব্যবস্থা করছি। থানা থেকে ভ্যানগাড়ি আসবে। আত্মীয়স্বজন কেউ যেন যায়। সুরতহালের ফিস। আছে। হাজার দুই টাকা যেন সাথে নেয়।
পুলিশের ভ্যান সে রাতে এসে পৌছাল না।
মতি সারারাত ইমাম সাহেবের পাশে রইল। রাত নটা দশটা পর্যন্ত তার সঙ্গে লােকজন ছিল— একে একে সবাই বিদায় হয়ে গেল। মরা মানুষ ফেলে রেখে গেলে শিয়াল–কুকুর খেয়ে ফেলবে। মতির বিরক্তির সীমা রইল না।
অন্যদের মতাে সেও কেন চলে গেল না? এ রকম বােকামিটা করল কীভাবে ? তার একমাত্র ভরসা সঙ্গে গাঁজা ভরা সিগারেট আছে। গাঁজার ধোঁয়ায় টান দিয়ে যে–কোনাে পরিস্থিতি পার করে দেয়া যায়। সমস্যা একটাই খালিপেটে থাকলে চলবে না। পেট ভর্তি থাকতে হবে।