ইমাম সাহেবের লাশ তার ঘরের চৌকির ওপর রাখা আছে। কম্বল দিয়ে লাশটা ঢাকা। গন্ধ সহজে বের হবে না। মতি বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়েছে। শিয়াল কুকুরের ঘরে ঢােকার পথ বন্ধ। সে বসে আছে উঠানে। উঠানের দু’মাথায় দু’টা হারিকেন জ্বালিয়েছে। অগ্নিবন্ধন। জিন, ভূতের দুই দিক থেকেই আসা বন্ধ। মতি এক ফাকে ইমাম সাহেবের রান্নাঘরও দেখে এসেছে। চাল আছে, ডাল আছে, পিয়াজ রসুন আছে।
তেলের শিশিতে তেলও আছে। ক্ষিধাটা ভালােমতাে লাগলে চাল ডাল মিশিয়ে খিচুড়ি বসিয়ে দিতে হবে। পেট ভরা থাকলে ভয় কম লাগে।
সঙ্গে গাঁজার সিগারেট আছে ছয়টা। একেকটার দাম পড়েছে দশ টাকা করে। ছটা স্বাট টাকা। মতি মুলামুলি করে পঞ্চাশ টাকায় কিনেছে। এইসব হলাে আরাম করে খাওয়ার জিনিস। তার এমনই কপাল মরা লাশের পাশে বসে সব কটা পুরিয়া শেষ করতে হবে। বেহুদা পঞ্চাশ টাকা চলে গেল। | প্রথম গাঁজার পুরিয়া খেয়ে মতির দুঃখবােধ কেটে গেল। মায়াবােধ প্রবল হলাে। তার কাছে মনে হলাে— ইমাম সাহেব আহারে বেচারা! মরে পড়ে আছে। নিকট–আত্মীয় পর–আত্মীয় কেউ নেই।
ইমাম সাহেবের মতাে একজন নামাজি ভালাে মানুষের পাশে কে আছে। আছে মতির মতাে দুষ্টলােক। যে ঈদের নামাজ ছাড়া অন্য কোনাে নামাজে সামিল হয় না। মাঝে মধ্যে তওবা করে পাপমুক্ত অবশ্যি হয়। সে অবশ্যি বুঝে, তওবাটা করে সে আল্লাহপাককে কঁকি দেয়ার চেষ্টা করছে। মতির ধারণা আল্লাহপাকও ব্যাপারটা বুঝেন, তবে বুঝেও চুপ করে থাকেন। এই জন্যেই তিনি রহমানুর রহিম।
মৃত্যুর পর মতির কঠিন শাস্তি হবে এটা সে জানে। যে পড়ে থাকে বাজারের মেয়েছেলের বাড়িতে তাকে আল্লাহপাক আদর করে বলবেন– ‘ওরে মতি যা বেহেশতে ঢােক। তাম্বুর নিচে হুরপরী আছে। যারে যারে পছন্দ হয় সাথে নিয়া সরুবান তহুরা খা। যত ইচ্ছা খা। তা হবে না। আগুনে তাকে পুড়তেই হবে। দু একটা ভালাে কাজ সে যে করে নাই তা–না । করেছে। তবে খারাপ কাজের তুলনায় ভালাে কাজ এতই নগণ্য যে দোজখের আগুন থেকে সেই পুণ্য তার একটা কেনি আংগুলও বাঁচাতে পারবে না।
এই যে ইমাম সাহেবকে সে পাহারা দিচ্ছে এটা তাে একটা ভালাে কাজ। কারণ লােকটা ভালাে। চেয়ারম্যান সাব লােকটাকে কানে ধরে চক্কর দেয়ায়েছেন— অন্যায় করেছেন। নির্দোষ লােকের শাস্তি হয়েছে। দোষীও হইতে পারে। মানুষ চেনা বড় কঠিন।
সবাই তাকে ভালাে মানুষ জানে, আসলে সে বিরাট চোর। মরজিনার নাকফুল চুরি করে কুড়ি টাকায় বেচেছিল । অবশ্য এই টাকাটা সে জরিনার পেছনেই খরচ করেছে। আধা কেজি গরম জিলাপি কিনে খাইয়েছে। নিজে একটাও খায় নি।
হাসানকে জিজ্ঞেস করলে জানা যায়।
হাসান নিশ্চয়ই মিথ্যা কথা বলবে না। তবে হাসানকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে না। যদি হাসান বলে ঘটনা সত্য তখন কী হবে? মৃত মানুষের খারাপ কিছু নিয়ে আলােচনা করতে নাই। মৃত মানুষকে নিয়ে ভালাে ভালাে কথা বলতে হয়। এটাই নিয়ম। মতি মরে গেলে কেউ কি তাকে নিয়ে একটা ভালাে কথা বলবে। মনে হয় না ।
মতি দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরলি। জিনিস খারাপ দেয় নাই— এক নম্বরি জিনিসই দিয়েছে। মনে ফুর্তির ভাব আসি আসি করছে— হয়তাে এসেও যাবে। জম্পেশ খিদে জানান দিচ্ছে। এক ফাকে খিচুড়ি বসায়ে দিতে হবে। ডিম পাওয়া গেলে ভালাে হতাে। একটা দুটা খিচুড়ির মধ্যে ছেড়ে দিলে স্বাদ যা হয় তার কোনাে তুলনা নাই। তেতুল গাছের নিচে খচমচ শব্দ হচ্ছে। মতি কৌতুহলী হয়ে তাকাচ্ছে। সাধারণ অবস্থায় থাকলে ভয় লাগত। এখন সে সাধারণ অবস্থায় না। শিয়াল–টিয়াল হবে।
মরা মানুষের গন্ধ পেয়ে উকি ঝুকি মারছে। হাতের কাছে একটা লাঠি রাখা দরকার । শিয়ালের পাল মরা মানুষ একবার খেতে শুরু করলে আধাপাগল হয়ে যায়, তখন জীবিত মানুষ খেতে চায়। ঘরের ভেতরও খচমচ শব্দ হচ্ছে। বেড়া ভেঙে কোনাে শিয়াল কি ভিতরে ঢুকে পড়েছে ? ঢুকে পড়লে কিছু করার নাই। খাওয়া দাওয়া করে যা থাকে তাই কবরে ঢুকিয়ে দিতে হবে। মতি আরেকটা সিগারেট ধরাল।
মৌতাতটা মােটামুটি জমছে। মনে ফুর্তির ভাব চলে এসেছে। এটা কিছুতেই নষ্ট হতে দেয়া যাবে না। মতি গুনগুন করে গান। গাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। এই পরিস্থিতিতে ধর্মীয় গান গাইতে পারলে ভালাে হতাে। চলাে যাই মদিনা ধরনের গান। সে রকম গান একটাও মনে পড়ছে
সে মাথা দুলাতে দুলাতে সিনেমার গান শুরু করল। এই সিনেমাটা সে মর্জিনাকে নিয়ে নেত্রকোনার হলে দেখে এসেছে। খুবই ট্রাজেডি সিনেমা। মতি উদাস গলায় গাইছে—
হাত খালি গলা খালি। কন্যার নাকে নাক ফুল সেই ফুল পানিতে ফেইল্যা কন্যা করল ভুল।
আবারাে খচখচ শব্দ হচ্ছে। মতির হাসি পেয়ে গেল— আজ মনে হয় খচখচানির রাত । এবারের খচখচানিটা অন্য রকম। চারপেয়ে জন্তুর খচখচানি না, দু পেয়ে মানুষের শুকনাে পাতার ওপর দিয়ে হেঁটে আসার শব্দ। মতি বলল, কে ? বলেই দেখল ডাক্তার সাহেব। গলায় মাফলার পেঁচিয়েছেন বলে মানুষটাকে অন্যরকম লাগছে। দেখে মজা লাগছে। গাঁজার কারণে এটা ঘটছে। এক নম্বরি গাঁজার এই গুণ যা দেখা যায় ভালাে লাগে। ডাক্তার সাহেব যদি মাফলার ছাড়া আসত তাহলেও দেখতে ভালাে লাগত।
মতি নাকি ?
জ্বে ডাক্তার সাব। কী কর ? মরা পাহারা দেই।
গাঁজা খাচ্ছ না–কি ? বিশ্রী গন্ধ আসছে। তােমার গাঁজার অভ্যাসও আছে তা তাে জানতাম না।
মতি জবাব দিল না। লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করল। ডাক্তার সাহেবকে দেখে তার ভালাে লাগছে। খাঁটি সােনা মানুষ বলেই এত রাতে খোঁজ নিতে এসেছে। এই মানুষটার সাইকেল চুরি করাটা খুবই অন্যায় হয়েছে। মতি ঠিক করে ফেলল অন্য কোনাে জায়গা থেকে একটা ভালাে সাইকেল চুরি করে ডাক্তারকে দিয়ে আসবে। তার ডাবল পাপ হবে। হলেও কিছু করার নেই। সাইকেলের অভাবে লােকটার কষ্ট হচ্ছে। সবচে‘ ভালাে হয় যদি পুরনাে সাইকেল জোগাড় করা যায়।
ডেডবডি থানায় নিয়ে যাবার কথা ছিল। নেয় নি ? জ্বে না। ইমাম সাহেবের আত্মীয়স্বজনকে খবর দেয়া হয়েছে ?
জ্বে না। কেউ তারার ঠিকানাই জানে না। শুধু জানে বাড়ি মধুপুর । ভালাে সমস্যা হলাে তাে।
আনিস বারান্দায় উঠে এল। তার মন বেশ খারাপ হয়েছে। একটা মানুষ মারা গেছে। অথচ তার আশেপাশে কেউ নেই। একজন শুধু উঠানে বসে গাঁজা টানছে। মানুষ এত নিষ্ঠুর হবে কেন ? না-কি সমস্যাটা ইমাম সাহেবের ? বিদেশী মানুষ দীর্ঘদিন এখানে থেকেও কারাে সঙ্গে মিশ খাওয়াতে পারেন নি।
আনিস বলল, তুমি একা বসে আছ। আর কেউ নেই এটা কেমন কথা!
মতি বলল, সবেই ভয় খাইছে। ফাঁসের মরা। আর জায়গাটাও গেরামের বাইরে পড়ছে। তারপরে ধরেন পুলিশের ঝামেলা আছে।
খাওয়া দাওয়া করেছ মতি ?
জ্বে না। তােমার খাবার ব্যবস্থা তাে করা দরকার।
চিন্তা কইরেন না ডাক্তার সাব। ইমাম সাহেবের পাকের ঘরে চাইল ডাইল সবই আছে।