খিচুড়ি বসায়ে দেব ।
তাহলে এক কাজ কর রান্না শুরু কর। আর আমি ইমাম সাহেবের ঘর। খুঁজে দেখি চিঠিপত্র থেকে ঠিকানা পাওয়া যায় কিনা। কেউ কি খুঁজে দেখেছে ?
বলতে পারি না। সবেই ছিল মন্ত্রী নিয়া ব্যস্ত।
ডাক্তার হারিকেন হাতে ঘরে ঢুকে পড়ল। চৌকিতে কালাে কম্বলে একটা মানুষ পুরােপুরি ঢাকা। তার শরীর নষ্ট হতে শুরু করেছে। তীব্র না হলেও ভােতা ধরনের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। মেডিকেল কলেজে আনিসের এক মেডিসিনের প্রফেসর জোবেদ আলি হঠাৎ হঠাৎ বিষয়ের বাইরে কথা বলতেন। গন্ধ বিষয়ে একবার দীর্ঘ এক বক্তৃতা দিলেন যে বক্তৃতা সিলেবাসে নেই– বাবারা শােন, ডাক্তার হবার আগে নাক তৈরি কর। গন্ধ নিতে শেখ। সব কিছুর গন্ধ আছে।
জীবন্ত মানুষের গন্ধ আছে। আবার মৃত মানুষেরও গন্ধ আছে। অসুখের গন্ধ আছে। টাইফয়েড রােগীর গা থেকে এক রকম গন্ধ বের হয় আবার কালাজ্বর রােগীর গা থেকে অন্য রকম গন্ধ বের হয়। রােগের ডায়াগনােসিসে এখন গন্ধ ব্যবহার করা না। কিন্তু আমি লিখে দিচ্ছি গন্ধ–নির্ভর ডায়াগনােসিস শুরু হবে। প্রাচীন ভারতের দুই মহান চিকিৎসক চরক এবং শুশ্রুত দুজনই রোগের ডায়াগনােসিসে গন্ধের গুরুত্ব দিয়েছেন। ভারতের ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ও দাবি করতেন তিনি রােগের গন্ধ পেতেন।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(১৯) হুমায়ূন আহমেদ
জোবেদ আলি স্যারের মাথা কিঞ্চিৎ খারাপ ছিল। একদিন ভালােমানুষের মতাে ক্লাস নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে একগাদা ডরমিকম ট্যাবলেট খেয়ে মারা গেলেন। মৃত্যুর আগে নােট লিখে গেলেন। নােটটা অন্যদের মতাে।
তিনি অন্যদের মতাে লিখলেন না— আমার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী না। তিনি লিখলেন— ‘আমার মৃত্যুর জন্যে সবাই দায়ী। আমি নিজেও দায়ী।
ইমাম সাহেব কি এরকম কোনাে কিছু লিখে রেখে গেছেন। তার স্ত্রীর কাছে কোনাে চিঠি ? তার দুই কন্যার কাছে আবেগের কিছু লাইন।
ঘরে আসবাবপত্র খুবই অল্প। টেবিলের ওপর কিছু হাদিসের বই— মেশকাত শরীফ, বােখারি শরীফ। টেবিলের ড্রয়ারে কিছু চিঠি পাওয়া গেল। সবই ইমাম সাহেবের বড় মেয়ে সকিনার লেখা। কোনাে চিঠিতেই ঠিকানা নেই। অন্যের চিঠি পড়ার মানসিকতা আনিসের নেই— তারপরেও একটা চিঠি পড়ে ফেলল। সকিনা তার বাবাকে লিখেছে—
আপনি শরীরের দিকে খিয়াল রাখিবেন। আপনার জন্য সবসময় আমার মন কাঁদে। প্রতি রাতে আজেবাজে খােয়াব দেখি। বাবাগাে আমি আপনার পায়ে ধরি আপনি নিজের প্রতি যত্ন নেন। আপনার বুকে ব্যথা হয়— কেন আপনি | ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেন না ?.... আনিস ছােট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। ইমাম সাহেবের সঙ্গে তার অনেকবারই দেখা হয়েছে। তিনি তার বুকের ব্যথার কথা কখনাে বলেন নি। মৃত্যু এক দিক দিয়ে ভালাে যাবতীয় যন্ত্রণার অবসান। এই মানুষটা এখন আর বুকের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে না।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(১৯) হুমায়ূন আহমেদ
মতিকে একা রেখে আনিস তার বাসার দিকে রওনা হলাে। রাত অনেক হয়ে গেছে তারপরেও তাকে জহির খাঁ সাহেবের বাড়িতে যেতে হবে। তিনি জরুরি খবর পাঠিয়েছেন। আনিস মনে মনে আশা করছে সে গিয়ে দেখবে— জহির খাঁ বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। মানুষটার সঙ্গে এই মুহূর্তে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
জহির খা জেগেই ছিলেন। তার চক্ষু রক্তবর্ণ । প্রচুর মদ্যপান করলে তার চোখ রক্তবর্ণ হয়ে যায়। আজ সারাদিন নানা উত্তেজনার ভেতর দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে। এখন উত্তেজনা কমানোের ব্যবস্থা নিয়েছেন। ডাক্তারকে দেখে তিনি আনন্দিত গলায় বললেন– তুমি ছিলা কোথায় ? বাসা তালা বন্ধ। তিনবার তােমার কাছে লােক পাঠায়েছি।
আনিস কিছু বলল না। সে ইমাম সাহেবের বাড়িতে গিয়েছিল এই কথাটা তার বলতে ইচ্ছা করছে না।
এখন আবার তােমার খোঁজে বদিরে পাঠায়েছি।
ডেকেছেন কী জন্যে ? শরীর খারাপ ?
শরীর কিঞ্চিৎ খারাপ কিন্তু তার জন্যে তােমাকে ডাকি নাই— গল্পগুজব করার জন্যে ডেকেছি। বস।
আনিস বসল। জহির খা পানের বাটা থেকে পান নিয়ে মুখে দিতে দিতে বললেন— আজকে দিনটা যে পার করতে পারছি তার জন্যে আল্লার দরবারে শুকরিয়া। সকাল সাতটার সময় টিএনও সাহেব এসে বললেন মন্ত্রী আসবে। আপনার বাড়িতে একটু চায়ের এন্তেজাম করতে হবে। দেখ অবস্থা। এদিকে একজন আবার ফাঁসিতে ঝুলে পড়েছে। ফাঁসিতে কারা ঝুলে ? মেয়েছেলে ঝুলে । বিবাহ হয় নাই পেটে সন্তান চলে এসেছে। তখন ফাঁসিতে ঝুললেও একটা কথা। আর তুই এক বুড়া— অন্যায় করেছিস, শাস্তি হয়েছে; ফুরায়ে গেছে। তার জন্যে ফাস নিতে হবে। ডাক্তার কি লাল পানি একটু খেয়ে দেখবে? নার্ভ ঠাণ্ডা করে। হালকা করে দেই। বরফ দিয়ে খাও ভালাে লাগবে।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(১৯) হুমায়ূন আহমেদ
জ্বি না। আপনি খান।
আমি তাে খাচ্ছিই। এক পেগ করে খাই— মুখটা যখন পানশে হয়ে যায় তখন একটা পান খাই। মুখ ঠিক করি। তারপর আবার একটু। শােন ডাক্তার, তুমি হেনার ব্যাপারে কী করলা ?
কোন ব্যাপারে কথা বলছেন? তােমারে বললাম না, হেনার জন্যে পাত্র দেখ। খরচ আমার। ছবিও তাে তুলে পাঠায়েছি। ছবি পাও নাই ?
ছবি পেয়েছি। পাত্রের সন্ধান কর। পাত্র যদি ক্যাশ টাকা চায় তাও দিব।
আনিস চুপ করে রইল। জহির খা গলা উঁচিয়ে বললেন– হেনা কই ? আমাদের খাওন দাও।
আনিস বলল, আমি এখন খাব না। জহির খাঁ বললেন, খাবে না কেন? খেয়ে এসেছ ?
জ্বি না। সারাদিন বাইরে ঘােরাঘুরি করেছি।
গােসল করে তারপর খাব। আমি নােংরা শরীরে কিছু খেতে পারি না।
আমার এখানে গােসল কর। গরম পানি করে দিবে। সাবান দিয়ে ডলা দিয়ে গােসল কর। আমার ধােয়া লুঙ্গি আছে। অসুবিধা কিছু নাই।
তার দরকার নেই। আচ্ছা খাবার দিতে বলুন, গােসল পরে করব।
জহির খা রাগী গলায় বললেন, গােসল পরে কেন করবা । এখনই করবা। হেনারে বলতেছি সে গরম পানি করে দিবে—শরীরে সাবান ডলে দিবে । তুমি তাে বাইরের কেউ না। তুমি আমার নিজের লােক।
আনিস হতভম্ব হয়ে গেল। নেশাগ্রস্ত মানুষের কোনাে কথা ধরতে নেই। তারা কী বলছে না–বলছে তার ওপর তাদের কোনাে নিয়ন্ত্রণ থাকে না— তারপরেও জহির খাঁ এইসব কী বলছেন ? হেনা কেন গায়ে সাবান ডলে দেবে ?
জহির খা মুখের পান ফেলে দিয়ে তার বাঁ পাশে রাখা গ্লাস এক চুমুকে শেষ করে মুখে আরেকটা পান নিয়ে ঝুঁকে এসে বললেন— একা একা গােসলের সমস্যা জান ? পিঠে সাবান দেওয়া যায় না। পিঠে সাবান দেবার জন্যে লােক লাগে। এতে দোষের কিছু নাই।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(১৯) হুমায়ূন আহমেদ
আনিস শান্ত গলায় বলল, আমি গোসল করব না। আপনি খাবার দিতে বলুন।
জহির খা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হেনাকে ডেকে খাবার দিতে বললেন।
হেনা মেয়েটাকে আজ আরাে সুন্দর লাগছে। সে আজ শাড়ি পরে নি, জরি দেওয়া ঘাঘড়া জাতীয় পােশাক পরেছে।