সন্ধ্যা তখনাে মিলায় নি।
আকাশ মেঘশূন্য, পরিষ্কার। হঠাৎ কী যেন হয়ে গেল। প্রথমে কয়েকবার কামানদাগার মতাে গুম গুম শব্দ, তারপর কাক ডাকতে শুরু করল।
গাছের সব পাখি এক সঙ্গে আকাশে উড়ে গেল। এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেল বিরাটনগর গ্রামের ওপর দিয়ে। ঝড়ের স্থায়িত্ব দু’তিন মিনিট–– এর মধ্যেই গ্রাম লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। প্রকৃতি নানান রকম খেলা খেলে। সে বিরাটনগর নিয়ে মজার কোনাে খেলা খেলল। এই খেলার উদ্দেশ্য মানুষকে ভয় দেখানাে না– বিস্মিত করা। যে কারণে কালিমন্দিরের সঙ্গে লাগােয়া পাঁচ শ’ বছরের পুরনাে বট গাছ উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল অথচ তার পাশেই রইসুদ্দিনের খড়ের চালা স্পর্শও করল না।
রইসুদ্দিন উঠোনে ধান সিদ্ধ দিচ্ছিল। সে চোখ বড় বড় করে দেখল তার মাথার ওপর দিয়ে আলিশান একটা বট গাছ উড়ে যাচ্ছে। গাছ না, যেন পাখি। শান্ত ভঙ্গিতে উড়ছে।
গ্রামের একটা মানুষও মারা পড়ল না কিন্তু শত শত পাখি মারা পড়ল । বিরাটনগরের সব কটা পুকুরের মাছ এক সঙ্গে ভেসে উঠল। মরে ভেসে ওঠা , জীবিত অবস্থায় ভেসে ওঠা। যেন দেখতে এসেছে— ঘটনা কী? ঝড় থেমে যাবার পরও সেইসব মাছ ডুবল না, ভেসেই রইল। প্রকৃতির এই খেলা দেখে মাছেরাও যেন অভিভূত। বিরাটনগরের মানুষজনের প্রাথমিক ধাক্কা কাটতেই তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ল মাছ মারার সরঞ্জামের খোজে। অদ্ভুত ঘটনার ব্যাখ্যা পরে খোজা যাবে— আপাতত মাছ মারা যাক। বিরাটনগরে শুরু হলাে মাছ মারা উৎসব।
আজকের মাছ মারা অন্যদিনের মতাে না। খালি হাতে পুকুরে নেমে পড়লেই হবে। মাছগুলোর স্বভাবে আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এদের গায়ে হাত রাখার পরও এরা নড়ছে না। পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে না।
মতি মিয়া বড় বাড়ির পুকুরের সামনে কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে বসে রইল । তার মাথা ঝিম ঝিম করছে, এ–কী কাণ্ড! বাপের জন্মে সে এমন জিনিস দেখে নাই। লােকগুলাের কাণ্ড দেখেও সে বিস্মিত কতবড় একটা ঘটনা ঘটেছে, এটা নিয়ে তােরা চিন্তা কর। মাছ মারা বড় হয়ে গেল ? কে জানে হয়তাে কেয়ামত শুরু হয়েছে। আছরের ওয়াক্তে কেয়ামত হওয়ার কথা। ঘটনাটা তাে বলতে গেলে আছর ওয়াক্তেই ঘটেছে। এই সময় সূর্য পশ্চিম দিকে ডুবতে গিয়েও ডুববে না। উল্টা দিকে ঘােরা শুরু করবে। আর কোনােদিন মাগরেবের ওয়াক্ত আসবে না। মূখ গ্রামবাসী মাছ মারা বন্ধ করে সূর্যের দিকে তাকিয়ে দেখ ঠিকমতাে ডুবে কি ডুবে না। সূর্য না ডুবলে খবর আছে।
মতি পুকুর পাড় থেকে ওঠে গেল। তার বুক ধড়ফড় করছে। বড়ই অশান্তি লাগছে। ঝড়ের সময় কী কী ঘটনা ঘটেছে ভালােমতাে জানা দরকার। জুম্মাঘরের টিউবকল থেকে লাল পানি বের হচ্ছে বলে শুনেছে— এটাও দেখা দরকার। কালিমন্দিরের বটগাছ উপড়ে কোথায় নিয়ে ফেলেছে— এই খোজটা বের করতে হবে। এতবড় একটা বটগাছ উড়ে আর কতদূর যাবে ? খালপাড়ের সুলেমান নাকি আল্লাহর নামে কীরা কেটে বলেছে— বটগাছ যখন উড়িয়ে নিয়ে যায় তখন বটগাছে তরুণী একটা মেয়ে পা ভাঁজ করে বসে ছিল। মেয়েটার গায়ে কোনাে কাপড় ছিল না। তার জন্য মেয়েটার কোনাে লজ্জা শরমও ছিল না। মুখে ছিল হাসি। সুলেমানের কথা বিশ্বাস করার কোনাে কারণ নেই। কিছু কিছু লােকের জন্মই হয়েছে মিথ্যা কথা বলার জন্যে। সুলেমান তাদের একজন। তারপরেও সে কী বলতে চায় এটা শােনা দরকার। কঠিন মিথ্যাবাদীও মনের ভুলে দু‘একটা সত্য কথা বলে ফেলে। কে জানে সুলেমানের এই কথাটা হয়তাে সত্যি।
মরা পাখিগুলাে দেখে মতির খুব মায়া লাগছে। ঝড় তুফানের খবর পাখিরা আগে পায়। পাখিদের উচিত ছিল উড়ে পাশের যে–কোনাে একটা গ্রামে চলে যাওয়া। পাশের গ্রামগুলােতে কিছুই হয় নি। গাছের একটা পাতাও নড়ে নি। এটাও একটা আচানক ঘটনা। মতি একটা মরা ডাহুক পাখির পাশে বসে পড়ল। ডাহুক পাখির মাংস অতি স্বাদু। ঝড়ে যে পাখি মারা গেছে তার। মাংস খাওয়া ঠিক কি–না কে জানে? মরা মাছ খাওয়া যায়, কিন্তু মরা পাখি কি খাওয়া যায় ? যে–কোনাে পাখি মরার সময় পা দুটা আকাশের দিকে তুলে রাখে। এটাই নিয়ম। কিন্তু এই পাখিগুলাে কুঁকড়ে মুকড়ে পড়ে আছে।
নিয়মমতাে মরতেও পারে নাই। এটাও একটা আফসােস।
মতি, কী কর ?
বিরাটনগর কম্যুনিটি হেলথ কমপ্লেক্সের ডাক্তার সাহেব সাইকেল হাতে ধরে হেঁটে হেঁটে আসছেন। ডাক্তার সাহেবকে দেখে মতির বুক ধড়াস করে উঠল। গলা খানিকটা শুকিয়ে গেল। এম্নিতে এই ডাক্তার অতি ভালাে মানুষ। অতি সজ্জন। নিজ থেকে আগবাড়িয়ে সবার সঙ্গে কথা বলে। ডাক্তার হিসেবে এক নম্বরেরও ওপরে। কোনাে রােগীর বাড়িতে গিয়ে একবার শুধু যদি সাইকেলের ঘণ্টা দেয় তাহলেই ঘটনা ঘটে যায়। ঘণ্টার শব্দ শুনে রুগি বিছানায় উঠে বসে বলে, মুরগির সালুন দিয়ে ভাত খাব ।
আগের যে দুজন ডাক্তার ছিল তারা দুজনই ছিল খচ্চর ধরনের। এর মধ্যে দ্বিতীয় জন ছিল খচ্চরেরও নিচে। তাকে সালাম দিলে সালামও নিত না। সালামের জবাবে মাটির দিকে তাকিয়ে ঘোঁৎ করে একটা শব্দ করত। মানুষ হয়ে জন্তুর মতাে। শব্দ করবে কেন ? তুই কি জন্তু ?
বর্তমান ডাক্তার সাহেবের নাম আনিসুর রহমান ঠাকুর। মুসলমানের নামের শেষে ঠাকুর থাকবে কেন এটা জিজ্ঞেস করা দরকার। মতি ঠিক করে রেখেছে কোনাে এক সময় জিজ্ঞেস করবে। এই ডাক্তার সাহেব এত ভালাে যে মতি নিশ্চিত ইনি বেশি দিন বিরাটনগরে থাকবেন না। বিরাটনগর এমন একটা জায়গা যেখানে ভালাে মানুষ বেশিদিন টিকে না। ডাক্তার সাহেব অতিরিক্ত ভালাে মানুষ। এমন ভালাে মানুষকে দেখে কারােরই বুক ধড়াস করার কথা না কিন্তু মতির বুক কাঁপছে।
কারণ, সে গত বুধবার সন্ধ্যাকালে ডাক্তার সাহেবের দুটা শার্ট আর একটা লুঙ্গি চুরি করেছে। ডাক্তার সাহেবের কাজের ছেলে সুজাত মিয়া কাপড় ধুয়ে রােদে শুকাতে দিয়েছিল। সন্ধ্যা পার হবার পরেও সেই বদছেলে কাপড় ঘরে তুলল না। কাজেই মতি কাপড় ভাজ করে তার চাদরের নিচে নিয়ে নিল। কাজটা অন্যায় আবার ঠিক অন্যায়ও না। কাপড় মতি না নিলে অন্য কেউ নিয়ে নিত। বিরাটনগর চোরের জায়গা। সমস্যা হলাে ডাক্তার সাহেবের কাপড় এখন পরা যাবে না। দেখেই সবাই চিনে ফেলবে।
ডাক্তার সাহেব বদলি হয়ে গেলে সে পরবে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে, ডাক্তার সাহেব যাবার সময় পেয়ার করে তাকে দিয়ে গেছেন। অবিশ্বাস করার মতাে কথা না। ডাক্তার সাহেবের অন্তরে মায়া মহব্বত আছে। পেয়ার করে তিনি মতিকে নিজের কিছু ব্যবহারী কাপড় দিতেই পারেন। ডাক্তার সাহেবের দ্রুত বদলি হয়ে যাওয়াটা মতির জন্যে মঙ্গলজনক।
মতি হাত কচলে খুবই বিনীত ভঙ্গিতে বলল, ডাক্তার সাব কেমন আছেন ? ভালাে আছি। কেমন প্রলয় ঘটনা ঘটেছে দেখলেন, আর একটু হলে কিয়ামত হয়ে
বাপের জন্মে এই জিনিস দেখি নাই। বটগাছ উড়ায়ে নিয়ে গেছে। বটগাছের কাছে ইয়াছিন মিয়া বইস্যা হুক্কা টানতেছিল। তার কল্কির আগুন পর্যন্ত নিভে নাই। সে এমন ভয় খাইছে। কাপড় নষ্ট করে ফেলেছে। ছােট নষ্ট , বড় নষ্ট। লুঙ্গি বরবাদ কেমন আচানক ঘটনা বলেন দেখি ?
খুব আচানক না। টর্নেডােতে এমন হয় ।
কী কন আপনে ? | টর্নেডাের ঠিক মাঝখানে থাকে টর্নেডাের চোখ।