তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(১) হুমায়ূন আহমেদ

সন্ধ্যা তখনাে মিলায় নি। 

আকাশ মেঘশূন্য, পরিষ্কারহঠাৎ কী যেন হয়ে গেলপ্রথমে কয়েকবার কামানদাগার মতাে গুম গুম শব্দ, তারপর কাক ডাকতে শুরু করলতেঁতুল বনে জোছনা

গাছের সব পাখি এক সঙ্গে আকাশে উড়ে গেলএর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেল বিরাটনগর গ্রামের ওপর দিয়েঝড়ের স্থায়িত্ব দুতিন মিনিটএর মধ্যেই গ্রাম লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলপ্রকৃতি নানান রকম খেলা খেলেসে বিরাটনগর নিয়ে মজার কোনাে খেলা খেললএই খেলার উদ্দেশ্য মানুষকে ভয় দেখানাে নাবিস্মিত করাযে কারণে কালিমন্দিরের সঙ্গে লাগােয়া পাঁচ বছরের পুরনাে বট গাছ উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল অথচ তার পাশেই রইসুদ্দিনের খড়ের চালা স্পর্শও করল না। 

রইসুদ্দিন উঠোনে ধান সিদ্ধ দিচ্ছিলসে চোখ বড় বড় করে দেখল তার মাথার ওপর দিয়ে আলিশান একটা বট গাছ উড়ে যাচ্ছেগাছ না, যেন পাখিশান্ত ভঙ্গিতে উড়ছে। 

গ্রামের একটা মানুষও মারা পড়ল না কিন্তু শত শত পাখি মারা পড়ল বিরাটনগরের সব কটা পুকুরের মাছ এক সঙ্গে ভেসে উঠলমরে ভেসে ওঠা , জীবিত অবস্থায় ভেসে ওঠাযেন দেখতে এসেছেঘটনা কী? ঝড় থেমে যাবার পরও সেইসব মাছ ডুবল না, ভেসেই রইলপ্রকৃতির এই খেলা দেখে মাছেরাও যেন অভিভূতবিরাটনগরের মানুষজনের প্রাথমিক ধাক্কা কাটতেই তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ল মাছ মারার সরঞ্জামের খোজেঅদ্ভুত ঘটনার ব্যাখ্যা পরে খোজা যাবেআপাতত মাছ মারা যাকবিরাটনগরে শুরু হলাে মাছ মারা উৎসব। 

আজকের মাছ মারা অন্যদিনের মতাে নাখালি হাতে পুকুরে নেমে পড়লেই হবেমাছগুলোর স্বভাবে আমূল পরিবর্তন হয়েছেএদের গায়ে হাত রাখার পরও এরা নড়ছে নাপালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে না। 

মতি মিয়া বড় বাড়ির পুকুরের সামনে কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে বসে রইল তার মাথা ঝিম ঝিম করছে, কী কাণ্ড! বাপের জন্মে সে এমন জিনিস দেখে নাই। লােকগুলাের কাণ্ড দেখেও সে বিস্মিত কতবড় একটা ঘটনা ঘটেছে, এটা নিয়ে তােরা চিন্তা করমাছ মারা বড় হয়ে গেল ? কে জানে হয়তাে কেয়ামত শুরু হয়েছে। আছরের ওয়াক্তে কেয়ামত হওয়ার কথাঘটনাটা তাে বলতে গেলে আছর ওয়াক্তেই ঘটেছেএই সময় সূর্য পশ্চিম দিকে ডুবতে গিয়েও ডুববে নাউল্টা দিকে ঘােরা শুরু করবেআর কোনােদিন মাগরেবের ওয়াক্ত আসবে নামূখ গ্রামবাসী মাছ মারা বন্ধ করে সূর্যের দিকে তাকিয়ে দেখ ঠিকমতাে ডুবে কি ডুবে নাসূর্য না ডুবলে খবর আছে। 

মতি পুকুর পাড় থেকে ওঠে গেলতার বুক ধড়ফড় করছেবড়ই অশান্তি লাগছেঝড়ের সময় কী কী ঘটনা ঘটেছে ভালােমতাে জানা দরকারজুম্মাঘরের টিউবকল থেকে লাল পানি বের হচ্ছে বলে শুনেছেএটাও দেখা দরকারকালিমন্দিরের বটগাছ উপড়ে কোথায় নিয়ে ফেলেছেএই খোজটা বের করতে হবেএতবড় একটা বটগাছ উড়ে আর কতদূর যাবে ? খালপাড়ের সুলেমান নাকি আল্লাহর নামে কীরা কেটে বলেছেবটগাছ যখন উড়িয়ে নিয়ে যায় তখন বটগাছে তরুণী একটা মেয়ে পা ভাঁজ করে বসে ছিলমেয়েটার গায়ে কোনাে কাপড় ছিল নাতার জন্য মেয়েটার কোনাে লজ্জা শরমও ছিল নামুখে ছিল হাসিসুলেমানের কথা বিশ্বাস করার কোনাে কারণ নেইকিছু কিছু লােকের জন্মই হয়েছে মিথ্যা কথা বলার জন্যেসুলেমান তাদের একজনতারপরেও সে কী বলতে চায় এটা শােনা দরকারকঠিন মিথ্যাবাদীও মনের ভুলে দুএকটা সত্য কথা বলে ফেলে। কে জানে সুলেমানের এই কথাটা হয়তাে সত্যি। 

মরা পাখিগুলাে দেখে মতির খুব মায়া লাগছেঝড় তুফানের খবর পাখিরা আগে পায়পাখিদের উচিত ছিল উড়ে পাশের যেকোনাে একটা গ্রামে চলে যাওয়াপাশের গ্রামগুলােতে কিছুই হয় নিগাছের একটা পাতাও নড়ে নিএটাও একটা আচানক ঘটনামতি একটা মরা ডাহুক পাখির পাশে বসে পড়লডাহুক পাখির মাংস অতি স্বাদুঝড়ে যে পাখি মারা গেছে তারমাংস খাওয়া ঠিক কিনা কে জানে? মরা মাছ খাওয়া যায়, কিন্তু মরা পাখি কি খাওয়া যায় ? যেকোনাে পাখি মরার সময় পা দুটা আকাশের দিকে তুলে রাখেএটাই নিয়মকিন্তু এই পাখিগুলাে কুঁকড়ে মুকড়ে পড়ে আছে। 

নিয়মমতাে মরতেও পারে নাইএটাও একটা আফসােস। 

মতি, কী কর

বিরাটনগর কম্যুনিটি হেলথ কমপ্লেক্সের ডাক্তার সাহেব সাইকেল হাতে ধরে হেঁটে হেঁটে আসছেনডাক্তার সাহেবকে দেখে মতির বুক ধড়াস করে উঠলগলা খানিকটা শুকিয়ে গেল। এম্নিতে এই ডাক্তার অতি ভালাে মানুষঅতি সজ্জননিজ থেকে আগবাড়িয়ে সবার সঙ্গে কথা বলেডাক্তার হিসেবে এক নম্বরেরও ওপরেকোনাে রােগীর বাড়িতে গিয়ে একবার শুধু যদি সাইকেলের ঘণ্টা দেয় তাহলেই ঘটনা ঘটে যায়ঘণ্টার শব্দ শুনে রুগি বিছানায় উঠে বসে বলে, মুরগির সালুন দিয়ে ভাত খাব

আগের যে দুজন ডাক্তার ছিল তারা দুজনই ছিল খচ্চর ধরনেরএর মধ্যে দ্বিতীয় জন ছিল খচ্চরেরও নিচেতাকে সালাম দিলে সালামও নিত নাসালামের জবাবে মাটির দিকে তাকিয়ে ঘোঁৎ করে একটা শব্দ করতমানুষ হয়ে জন্তুর মতােশব্দ করবে কেন ? তুই কি জন্তু

বর্তমান ডাক্তার সাহেবের নাম আনিসুর রহমান ঠাকুরমুসলমানের নামের শেষে ঠাকুর থাকবে কেন এটা জিজ্ঞেস করা দরকারমতি ঠিক করে রেখেছে কোনাে এক সময় জিজ্ঞেস করবেএই ডাক্তার সাহেব এত ভালাে যে মতি নিশ্চিত ইনি বেশি দিন বিরাটনগরে থাকবেন নাবিরাটনগর এমন একটা জায়গা যেখানে ভালাে মানুষ বেশিদিন টিকে নাডাক্তার সাহেব অতিরিক্ত ভালাে মানুষএমন ভালাে মানুষকে দেখে কারােরই বুক ধড়াস করার কথা না কিন্তু মতির বুক কাঁপছে

কারণ, সে গত বুধবার সন্ধ্যাকালে ডাক্তার সাহেবের দুটা শার্ট আর একটা লুঙ্গি চুরি করেছেডাক্তার সাহেবের কাজের ছেলে সুজাত মিয়া কাপড় ধুয়ে রােদে শুকাতে দিয়েছিলসন্ধ্যা পার হবার পরেও সেই বদছেলে কাপড় ঘরে তুলল না। কাজেই মতি কাপড় ভাজ করে তার চাদরের নিচে নিয়ে নিলকাজটা অন্যায় আবার ঠিক অন্যায়ও নাকাপড় মতি না নিলে অন্য কেউ নিয়ে নিতবিরাটনগর চোরের জায়গাসমস্যা হলাে ডাক্তার সাহেবের কাপড় এখন পরা যাবে নাদেখেই সবাই চিনে ফেলবে

ডাক্তার সাহেব বদলি হয়ে গেলে সে পরবেকেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে, ডাক্তার সাহেব যাবার সময় পেয়ার করে তাকে দিয়ে গেছেনঅবিশ্বাস করার মতাে কথা নাডাক্তার সাহেবের অন্তরে মায়া মহব্বত আছেপেয়ার করে তিনি মতিকে নিজের কিছু ব্যবহারী কাপড় দিতেই পারেনডাক্তার সাহেবের দ্রুত বদলি হয়ে যাওয়াটা মতির জন্যে মঙ্গলজনক। 

মতি হাত কচলে খুবই বিনীত ভঙ্গিতে বলল, ডাক্তার সাব কেমন আছেন ? ভালাে আছিকেমন প্রলয় ঘটনা ঘটেছে দেখলেন, আর একটু হলে কিয়ামত হয়ে 

বাপের জন্মে এই জিনিস দেখি নাইবটগাছ উড়ায়ে নিয়ে গেছেবটগাছের কাছে ইয়াছিন মিয়া বইস্যা হুক্কা টানতেছিলতার কল্কির আগুন পর্যন্ত নিভে নাইসে এমন ভয় খাইছেকাপড় নষ্ট করে ফেলেছেছােট নষ্ট , বড় নষ্টলুঙ্গি বরবাদ কেমন আচানক ঘটনা বলেন দেখি

খুব আচানক নাটর্নেডােতে এমন হয় । 

কী কন আপনে ? | টর্নেডাের ঠিক মাঝখানে থাকে টর্নেডাের চোখ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *