তারপর?
আমি আজ নাস্তার টেবিলে খুবই ভদ্র ভাষায় বললাম, বই যে পড়ছ—কাহন শব্দের অর্থ জান?
সে বই থেকে চোখ না তুলে বলল, না।
আমি সামান্য রাগ করে বললাম, একটা বই পড়ছ, তার নামের অর্থ জানার ইচ্ছা হলাে না ?
সে বই থেকে চোখ না তুলে বলল, পড়ার সময় বিরক্ত করবে না।
আমি বললাম, ঘরে চারটা ডিকশনারি। একটা ডিকশনারি দেখলেওতাে অর্থটা জানতে পারতে। সে বই নিয়ে গটগট করে শােবার ঘরে চলে গেল।
নবনী বলল, আপনিও উনার পেছনে পেছনে শােবার ঘরে গেলেন ?
অবশ্যই। তাকে গিয়ে খুবই দ্রভাবে বললাম, নামের অর্থ জানলে বইটা পড়ে আরাম পাবে। তুমি একটা ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিচ্ছ, সেই ছেলের
- াম জানবে না এটা কেমন কথা!
তােমার শাশুড়ি থমথমে গলায় বলল, বই পড়া আর মেয়ে বিয়ে দেয়া এক হলাে ?
আমি বললাম, অবশ্যই এক।
তখন সে খটাস করে বই বন্ধ করে রাগে ফোঁসফোস করতে করতে বলল— এল কাহনের অর্থ কী আমাকে বল। অর্থ জেনে তারপর পড়ব।
আমি তােমার শাশুড়ির ভাবভঙ্গি দেখে একটু টেনশানে পড়ে গেলাম। তার নেচারতাে জানি। লােকজন তিলকে তাল করে। তােমার শাশুড়ি তিলকে বড় সাইজের কাঁঠাল করে। ভালাে কথা মা, তুমি কি কাহন শব্দের অর্থটা জান ?
জ্বি না। কাহনের অর্থ কি কাহিনী ? সাত কাহন হলাে সাত কাহিনী ।
কাহন হলাে সংখ্যাবাচক। ঐ যে—
চার কড়ায় এক গণ্ডা দুই গণ্ডায় এক পন
যােল পনে এক কাহন। কাজেই এক কাহন হলাে একশ বত্রিশ। এক কাহন আম মানে একশ বত্রিশটা আম। সাত কাহন মানে হলাে নয়শ চব্বিশ ।
নবনী হাসি মুখে বলল, বই এর নাম নয়শ চব্বিশ ?
হ্যা তাই। এটা তােমার শাশুড়িকে বললাম। বলার পর সে যে কী করল তুমি বিশ্বাস করবে না। কোনাে সুস্থ মস্তিষ্কের মহিলা এই কাজটা করতে পারে
সে বলল, কাহন নামের অর্থ জানার পর বইটা পড়তে ভালাে লাগছে না । এই বলে জানালা দিয়ে বইটা ফেলে দিল। বই পড়ল নর্দমায়। ঘটনার এই হলাে সারমর্ম। মা আমি ঠিক করেছি, তােমার শাশুড়ির সঙ্গে এক ছাদের নিচে আমি আর বাস করব না। স্বামী–স্ত্রীর একজন যদি উত্তর মেরু হয় এবং আরেকজন যদি হয় দক্ষিণ মেরু তাহলেও এক ছাদের নিচে থাকা যায়। কিন্তু আমাদের অবস্থাটা দেখ আমি হলাম দক্ষিণ মেরু; তােমার শাশুড়ি উত্তর মেরুও না, এক্কেবারে মঙ্গল গ্রহ। আমাদের এক ঘরে থাকা সম্ভবই না।
আপনি যাবেন কোথায় ? | তােমার কি ধারণা আমার থাকার জায়গার অভাব? থাকার জায়গার আমার অভাব নাই। সুটকেস, বিছানা গুছিয়ে রেখেছি। তােমার সঙ্গে দেখা হয়েছে— ভালােই হয়েছে। তুমি আনিসকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিও। প্রয়ােজন বােধে টেলিগ্রামও করতে পার।
নবনী আতঙ্কিত গলায় বলল, আপনি সত্যিই সত্যিই চলে যাবেন না–কি ?
সালেহ সাহেব থমথমে গলায় বললেন, অবশই চলে যাব। তুমি মা আমাকে চিন নাই। আমি দুই কথার মানুষও না, তিন কথার মানুষও না। আমি এক কথার মানুষ। আমি ঐ Old vixen এর সঙ্গে বাস করব না । vixen মানে জানতাে মা ? vixen মানে হলাে মহিলা শিয়াল। আমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি চলে যাব, তখন অবশ্যই চলে যাব ।।
কখন যাবেন ?
এখনই যাব, আবার কখন ? পঞ্জিকা দেখে ঘর থেকে বের হবার দরকার নেই। সুতা কেটে গেলে ঘর থেকে বের হতে হয়। সুতা তাে কাটা হয়ে গেছে।
বাবা একটা কাজ করলে কেমন হয় ? দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে যান।
আমি আপনাদের জন্য বিরাট একটা রুই মাছ এনেছি।
সালেহ সাহেব পুত্রবধুর দিকে তাকিয়ে ছােটখাট একটা ধমক দিলেন। তারপর নিজের মনে বিড় বিড় করে বললেন, বাংলায় একটা প্রবচন আছে—
মরিচ জব্দ শিলে
বউ জব্দ কিলে বলেই ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন— বিরাট ভুল হয়ে গেছে। বিয়ের পর পর যদি এই প্রবচন অনুযায়ী কাজ করতাম তােমার শাশুড়ি জব্দ থাকত।
নবনী হেসে ফেলল । সালেহ সাহেব অগ্নিদৃষ্টিতে পুত্রবধুর দিকে তাকালেন। এবং হন্তদন্ত ভঙ্গিতে বের হয়ে গেলেন। তিনি সিঁড়ি ভেঙে নামছেন, তার ধুপধাপ শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
নবনী তার শাশুড়ির কাছে ছুটে গেল ।
নবনীর শাশুড়ি ফরিদা বেগম নিরুদ্বিগ্ন গলায় বললেন, মা তুমি দুঃশ্চিন্তা কারাে না । তােমার শ্বশুর এর আগে খুব কম করে হলেও তিনশবার ঘর থেকে বের হয়েছে। এটা নতুন কিছু না। সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসবে। তোমার শ্বশুরের দৌড় হচ্ছে রেলস্টেশন পর্যন্ত। রাগারাগি করে রেলস্টেশন পর্যন্ত যাবে, তারপর মুখ শুকনা করে ফিরে আসবে। রাগ করে অন্তত একবার সপ্তাহ খানেক বাইরে থেকে এলেও বুঝতাম পুরুষ মানুষের কিছু তার মধ্যে আছে। কিছুই নাই।
নবনী হাসল। শাশুড়িকে তার বেশ পছন্দ। এ বাড়িতে এলেই সে তার শাশুড়ির সঙ্গে গুটুর গুটুর করে গল্প করে।
ফরিদা বললেন, মা তুমি কি আজ দুপুরে আমার সঙ্গে খাবে? নবনী হাসূচক মাথা নাড়ল।
ফরিদা বললেন, তাহলে এক কাজ কর তুমিই মাছটা রান্না কর। বৌমার হাতের রান্না খাই।
নবনী বলল, মা আমি রাঁধতে পারি না। শুধু চা বানাতে পারি। | ফরিদা বললেন— রান্না কোনাে ব্যাপারই না। আমি তােমাকে শিখিয়ে দিচ্ছি ।।
নবনী রান্না চড়িয়েছে। জীবনের প্রথম রান্না। সে ভেতরে ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা বােধ করছে। মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে রান্নাটা যদি সত্যি সত্যি ভালাে হয় তাহলে বাটিতে করে এক বাটি মাছ সে তার বাবার জন্যে নিয়ে।
ফরিদা রান্নাঘরে বসে জাতি দিয়ে সুপুরি কাটছেন। চিকন করে সুপুরি কাটার অস্বাভাবিক দক্ষতা তাঁর আছে। এই বিদ্যাটিও তিনি তাঁর পুত্রবধূকে শেখাতে চান। আজ না, অন্য কোনােদিন। একদিনে অনেক কিছু শেখাতে নেই। ফরিদা সুপুরি কাটা বন্ধ করে হঠাৎ প্রশ্ন করলেন আনিসকে তােমার কেমন লাগে মা?
নবনী কিছু বলল না।
ফরিদা হালকা গলায় বললেন, পৃথিবী উত্তর দক্ষিণে চাপা। আর আমার ছেলেটা উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সব দিকেই চাপা। কিন্তু মা ছেলেটা ভালাে। খুবই ভালাে। কিছু দিন ধৈর্য ধরে যদি তার সঙ্গে থাক তাহলে দেখবে তাকে ভালাে লাগতে শুরু করেছে।