ঘাঘড়ার রং কালাে বলে হেনার গায়ের রং খুব ফুটেছে। লম্বা বেণি করেছে। চোখে কাজল দিয়েছে। গায়ে গয়নাও আছে। প্রথম দিনে গায়ে কোনাে গয়না ছিল না।
জহির খা আনিসের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। নেশাগ্রস্ত মানুষ এমন তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতে পারে না। তাদের চোখের মণি ডাইলেটেড থাকে। আনিসের মনে হলাে প্রচুর মদ্যপান করা সত্ত্বেও এই লােকটি মাতাল না। নিজের ওপর তার পূর্ণ দখল আছে। সে কি আনিসকে নিয়ে কোনাে খেলা খেলছে ? খেলােয়াড় মানুষ চুপ করে থাকতে পারে না। তাকে সব সময় খেলতে হয়। প্রতিপক্ষ না পেলে তারা প্রতিপক্ষ তৈরি করে নেয়।
ডাক্তার!
তুমি আমার দিকে তাকায়ে আছ কেন? কী দেখ ? কিছু দেখি না। ইমামের মৃত্যুর জন্য তুমি কি মনে মনে আমাকে দায়ী করছ ?
প্রত্যক্ষভাবে আপনি দায়ী না। তবে পরােক্ষভাবে আপনার ভূমিকা আছে।
জহির খাঁ সােজা হয়ে বসলেন। শীতল গলায় বললেন— এখন যে কথাটা তুমি বললা— এরকম কথা আর বলবা না। একটা কথা সব সময় খেয়াল রাখবা। আমি দুষ্ট প্রকৃতির লােক এবং রাগী লােক। দুষ্টু লােক সাধারণত রাগী হয় না, তবে আমি রাগী। নাও খাওয়া দাওয়া কর ।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২০) হুমায়ূন আহমেদ
হেনা হাত ধােয়ার পানি এনেছে। আনিস হাত ধােয়ার জন্যে বারান্দায় গেল। হাত ধুতে গিয়ে তার মনে হলাে— প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে।
আনিস একা খাচ্ছে। প্লেটে খাবার তুলে দেয়ার জন্যে হেনা পাশে দাড়িয়ে আছে। সে গায়ে কোনাে সুগন্ধি মেখেছে। খাবারের গন্ধের সঙ্গে এই গন্ধ যাচ্ছে।
আয়ােজন ভালাে। মন্ত্রীর জন্যে করা আয়ােজন খারাপ হবার কথা না। রুই মাছের বড় পেটি। পােলাও। খাসির মাংসের রেজালা। আস্ত মুরগির রােস্ট।
আনিস আরাম করেই খাচ্ছে। মনে হচ্ছে জ্বর নেমে গেছে। জ্বর নেমে গেলে খুব খিদে পায়।
ডাক্তার!
জ্বি।
খানা কেমন হয়েছে ? ভালাে হয়েছে।
গন্যমান্য সবাইরে বলেছিলাম। সবাই এসেছিল, শুধু একজন আসে নাই। বল দেখি কে আসে নাই ?
বলতে পারছি না।
আজিজ মিয়া আসে নাই। খবর নিয়েছি সে গিয়েছে গৌরীপুর। গৌরীপুর কেন গিয়েছে জান?
জ্বি না।
আড়ং–এর জন্যে বঁড় কিনতে গিয়েছে। আমার সাথে পাল্লা দিতে চায় । আমি ষাড় কিনেছি তারও ষাঁড় কিনা লাগবে। দেখি সে কি ষাঁড় কিনে।
জহির খা আরেকটা পান মুখে দিলেন।
ইমাম সাহেবের কবর হলাে তার পরদিন সন্ধ্যায়। কবর ঠিক না, গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দেওয়া। মধ্যনগর গ্রামের হুজুর ফতােয়া দিলেন অপঘাতে মৃত্যুর জানাজার বিধান নাই। লাশ কবরে নামানাের সময় অনেকেই চোখের পানি ফেলে। ইমাম সাহেবের ক্ষেত্রে শুধু মতি ভেউ ভেউ করে কিছুক্ষণ কাঁদল। গাঁজার নেশার কারণে ঘটনাটা ঘটল। ছয় পুরিয়া শেষ হবার পর সে আরাে চারটা পুরিয়া এনেছে। এবারে দাম বেশি পড়েছে। চার পুরিয়ার জন্যে পঞ্চাশ টাকা দিতে হয়েছে। টাকাটা সে পেয়েছে ইমাম সাহেবের ভােষকের নিচে।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২০) হুমায়ূন আহমেদ
ট্রেন দু‘ঘণ্টা লেট।
পৌছার কথা চারটায়, পৌছল ছটায়। নবনীর খুব বিরক্তি লাগছিল। তার ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট। কামরায় আর যারা আছে তাদের মনে হচ্ছে কারােরই টিকিট নেই। একজন আবার উঠেছে ছাগল নিয়ে। ট্রেনের বাথরুমের দরজা বন্ধ হয় না। মাঝে মাঝে এমন শব্দ হয় মনে হয় দরজা ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। যতই সময় যাচ্ছে ততই তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। মেজাজ খারাপের চূড়ান্ত পর্যায়ে ট্রেন থামল। নবনী ট্রেনের জানালা দিয়ে মাথা বের করে হঠাৎ করেই মুগ্ধ হয়ে গেল— কী সুন্দর দিন! পিচকারি ভর্তি হলুদ রঙ কেউ যেন বাতাসে ছিটিয়ে দিচ্ছে।
আকাশের মেঘ সূর্যের আলােকে কিছু একটা করেছে। দিনের শেষে আলাে যেখানেই পড়ছে সােনা রঙ হয়ে যাচ্ছে। রঙের গন্ধ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। নবনীর মন খারাপ হলাে এই ভেবে যে তার সঙ্গে কেউ নেই। কেউ থাকলে কিশােরীদের মতাে চেঁচিয়ে বলতে পারত– দেখ দেখ কী সুন্দর। সুন্দর কিছু দেখলেই অন্যকে দেখাতে ইচ্ছা করে।
আরে আরে আফা না ?
নবনী তাকাল। প্লটফরম থেকে দৌড়ে তার দিকে কে যেন আসছে। গােলগাল মুখ, মাথা পরিষ্কার করে কামানাে। মনে হচ্ছে আজই কামিয়েছে— চকচক করছে। পরনে লুঙ্গি, পায়ে রবারের জুতা। গায়ে ইস্ত্রি করা টি–শার্টে লেখা University of California লােকটি দাঁত বের করে এমনভাবে হাসছে যেন নবনী তার দীর্ঘদিনের পরিচিত, অথচ নবনী আজই মানুষটাকে প্রথম দেখছে।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২০) হুমায়ূন আহমেদ
আফা আমারে চিনেছেন ? আমি মতি। আপনি যান কই ? এখানেই নামব।
নামলে নামেন। জানালা দিয়া বেদিশার মতো চাইয়া আছেন। আমি ভাবি ঘটনা কী? আমরার আফা যায় কই ? ট্রেন ছাইড়া দিব আফা।
আমি কিন্তু তােমাকে চিনতে পারছি না।
মতি আনন্দিত গলায় বলল, মাথা কামাইছি বইল্যা চিনতে পারতেছেন না। মাথায় উকুন হইছিল। মাথা কামাইয়া সােভার পানি দিয়া ধুইয়া উকুনের বংশ শেষ করছি। আফনে মনে হয় এখনাে চিনেন নাই। ইয়াদ কইরা দেখেন প্রথমবার যখন আসছেন ডাক্তার সাবের কাছে আপনেরে কে নিয়া গেছিল
ও আচ্ছা। মনে পড়েছে। তখন তােমার গাল ভর্তি দাড়ি ছিল।
এই তাে চিনেছেন। দাড়িতেও উকুন হয়েছিল । উকুন আমারে ভালাে পায়। নামেন আফা, নামেন। জিনিসপত্র কী আছে দেখায়ে দেন।
মতি লাফ দিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ল। তাড়াহুড়া করার প্রয়ােজন নেই। আজ ট্রেন ফাঁকা। মতি তার অভিজ্ঞতায় দেখেছে ট্রেন যখন ফাকা থাকে যাত্রীরা ধীরে সুস্থে নামে তখনই জিনিসপত্র ফেলে যায়। প্রচণ্ড ভিড়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটে
আফা আপনে যে আসবেন ডাক্তার সাব জানে ? আসব যে জানে। কবে আসব জানে না।
মতি চিন্তিত মুখে বলল, ঘরে বাজার আছে কি–না কে জানে! গিয়া হয়তাে দেখবেন দুইটা আলু একটা পিয়াজ ছাড়া কিছু নাই। মহা চিন্তার বিষয় হইল।
নবনী বলল, মতি তােমাকে চিন্তা করতে হবে না। তুমি দেখে শুনে মালগুলাে নামাও। ঐ প্যাকেটে বই আছে।