প্রচণ্ড ভারি, সাবধানে নামাও।
আফা আপনে নিশ্চিন্ত মনে নিচে গিয়া বসেন। আমার দেখা পাইছেন আর চিন্তা নাই।
নবনী ট্রেন থেকে নামল। পিচকিরি দিয়ে হলুদ রঙ ছােড়ার ব্যাপারটা এখনাে ঘটছে। রঙ আরাে গাঢ় হচ্ছে। তার কাছেই এ রকম লাগছে, না অন্য সবার কাছেই লাগছে সে বুঝতে পারছে না।
ট্রেন থেকে যারা নামছে তাদের কাউকেই মুগ্ধ চোখে এদিক ওদিক তাকাতে দেখা যাচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথ যদি ট্রেনে তার সঙ্গে আসতেন তাহলে কী করতেন ? চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতেন? হাত বাড়িয়ে হলুদ আলাে ছোঁয়ার চেষ্টা করতেন ? প্লটফরমে নেমে স্যুটকেসের ওপর বসে কাগজ কলম নিয়ে গান কিংবা কবিতা লিখতে বসতেন ?
‘আলাে ভাঙ্গার এই আলাে। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই কী সুন্দর! কী সুন্দর!” বলে উচ্ছাস প্রকাশ করতেন না।
এত বড় মানুষদের উচ্ছ্বাস মানায় না। তীব্র উচ্ছ্বাস কিশােরীদের এলাকা
কিশােরীদের এলাকায় কিশােরীদেরই মানায় অন্য কাউকে মানায় না। হাতের তালুতে তেতুলের আচার নিয়ে যখন কোনাে কিশােরী চেটে চেটে খাবে তাকে মানাবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মানাবে না।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২১) হুমায়ূন আহমেদ
আফা দেখেন জিনিস সব নামছে কিনা।
নেমেছে, থ্যাংক য়ু। এখন একটা ভ্যানগাড়ি দেখ । চল রওনা দেই। এর আগের বার তুমিই তাে আমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলে ?
অবশ্যই আমি। হেইবার আফনের পরনে ছিল কচুয়া রঙের শাড়ি, লাল সুতার হিজিবিজি পাইর।
ঠিকই বলেছ, মতি শােন আমরা দেরি করছি কেন? পাঁচ দশ মিনিট বসতে হইব আফা। বসতে হবে কেন ?
সইন্ধা মিলইতাছে তাে, এই সময় যাত্রা নাস্তি। সইন্ধ্যা মিলাউক। ফ্লাস্কটা দেন— গরম পানি আইন্যা দেই। চা বানায়ে খান। আপনের সঙ্গে চায়ের সরঞ্জাম আছে না আফা। গতবার ছিল।
এবারও আছে।
গরম পানি আইন্যা দিতাছি চা খান— এই ফাকে আমি ভ্যানগাড়ি ঠিক করি। দশ মিনিটের মামলা। আফা মাথাত কাপড় দেন— আজান হইতেছে।
নবনী মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে দিল। মতি লােকটাকে তার কাছে খুবই ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। প্রথমবার যখন দেখা হয়েছে তখন এত ইন্টারেস্টিং মনে হয় নি। মনে হলে লােকটার কথা মনে থাকত। কোনাে মানুষই সবসময়। ইন্টারেস্টিং থাকে না। মাঝে মাঝে ইন্টারেস্টিং হয়। আজ এই মুহূর্তে মানুষটাকে ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। সন্ধ্যা মিলাবার পর হয়তাে আর মনে হবে না।
মতি প্রবল উত্তেজনা বােধ করছে। উত্তেজনার কারণ স্পষ্ট না। সে অতি দ্রুত গরম পানি জোগাড় করল। নবনীর সামনে গরম পানি ভর্তি ফ্লাস্ক নামিয়ে ঝড়ের বেগে চলে গেল। খবর পেয়েছে বাজারে গরু জবেহ হয়েছে। ভাগা হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। এক শ টাকা ভাগা। এক ভাগ ডাক্তার সাহেবের জন্যে কিনে নেয়া যায়। এই অঞ্চলে গরুর মাংস সচরাচর পাওয়া যায় না। গরু জবেহ হয় শুধু হাটবার। আজ হাটবার না। ভাগ্যক্রমে পাওয়া গেল। ডাক্তার সাহেবের স্ত্রী এত দিন পর এসেছেন। আলু ভর্তা দিয়ে তিনি যদি রাতে ভাত খান তাতে
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২১) হুমায়ূন আহমেদ
ডাক্তার সাহেবের ইজ্জত রক্ষা হবে না। ডাক্তার সাহেবের ইজ্জত রক্ষার চিন্তায়
মতিকে খুব অস্থির মনে হলো।
নবনী যত্ন করে চা বানাচ্ছে। হ্যান্ডব্যাগ থেকে সুগার কিউব, টি ব্যাগ বের হলাে। ফ্লাঙ্কের লাল মুখটা হলাে চায়ের কাপ। দূর থেকে কয়েকজন আগ্রহ নিয়ে তার চা বানানাে দেখছে। তাদের জন্যে নিশ্চয়ই মজার দৃশ্য। একটা মেয়ে সুটকেসে বসে বেশ আয়েশ করে চা বানাচ্ছে এই দৃশ্য নিশ্চয়ই সচরাচর দেখা যায় না।
নবনী চায়ের কাপে চুমুক দিল। খেতে ভালাে লাগছে। আরেকজন কেউ পাশে থাকলে হয়তােবা আরাে ভালাে লাগত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাশে থাকলে অসাধারণ একটা ব্যাপার হতাে। নবনী তাঁকে কী ডাকত ? গুরুদেব ? না। গুরুদেব মানে অনেক দূরের কেউ। পাশে বসে যিনি চা খাবেন তিনি দূরের কেউ।
নবনী মনে মনে কথা বলা শুরু করল । সময় কাটানাের এটা একটা ভালাে বুদ্ধি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কথােপকথন।
কবি চা খেতে কেমন হয়েছে ? ভালাে। ‘আলাে ভাঙার আলাে’ এটা কবিতা না গান ।
কবিতা। তবে বাণীতে সুরের আশ্রয় হলেই তাে গান। সেই অর্থে গানও বলতে পার।
শুধু প্রথম লাইন লিখলেন ? শেষ তত করলেন না। প্রথম লাইনটা হলাে বীজ। বীজ বপন করা হয়েছে বৃক্ষ আসবে।
লাইনটার মানে বুঝতে পারলাম না— আলাে ভাঙ্গার আলাে–এর মানে কী ?
তােমার মনে যে অর্থ আসে সেটাই মানে। আরাে সহজ করে বুঝিয়ে দেই—যখন আমি কোনাে গান বা কবিতা লিখি তখন সেটা থাকে আমার। শুধুই আমার । যখন তুমি সেটা পড় বা গুনগুন করে গানটা গাও তখন সেটা সম্পূর্ণই তােমার। সন্তান জন্ম দেই আমি কিন্তু দত্তক দিয়ে দেয়া হয় তােমাদের।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২১) হুমায়ূন আহমেদ
কবি আপনাকে কি আরেক কাপ চা বানিয়ে দেব?
প্রথম চায়ের স্মৃতিটি মাথায় রাখতে চাই। দ্বিতীয় কাপ হয়তাে প্রথম বারের মতাে ভালাে হবে না। সুন্দর স্মৃতি থাকা ভালাে না। তুমি যাচ্ছ কোথায় ?
আমার স্বামী গ্রামে ডাক্তারি করেন। আপনি চলুন না আমার সঙ্গে। কয়েকটা দিন থেকে আসবেন। আপনি গ্রামের পােস্ট মাস্টার নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলেন আমার স্বামীকে নিয়েও একটা গল্প লিখতে পারবেন। গল্পটার নাম দেবেন গ্রাম চিকিৎসক।
তোমার নিমন্ত্রণ মনে থাকল। কোনাে এক সময় উপস্থিত হব। আপনাকে ইস্টিশনে একা ফেলে চলে যেতে খুব খারাপ লাগবে।
আমার কোনো সমস্যা হবে না। হাঁটতে হাঁটতে দিনের আলাে কীভাবে নিভে যায়, কী করে নির্জন স্টেশনে আঁধার নামে তাই দেখব। এই দৃশ্য একজীবনে কতবার দেখলাম তারপরেও প্রতিবারই নতুন মনে হয়— যদিও সন্ধ্যা নামিছে মন্দ মন্থরে...।
ইট বিছানাে রাস্তা। মাঝে মাঝে ইট উঠে গেছে। রাস্তা গেছে ডেবে। ভ্যানগাড়িতে খুব ঝাঁকুনি হচ্ছে। ঝাঁকুনির চেয়েও বড় সমস্যা ধূলা উড়ছে। নবনীর ডাস্ট এলার্জি আছে। এলার্জির এটাক হলে হাঁচি উঠতে থাকবে। নবনী শাড়ির আঁচলে নাক মুখ ঢেকে রেখেছে। ইট বিছানাে রাস্তায় এত ধূলা ওড়ার কথা না। কেন উড়ছে কে বলবে! রাস্তার দুপাশে শিমুল গাছের সারি। একেকটা গাছ কাঁটাওয়ালা দৈত্যের মতাে। রাস্তা পাহারা দিতে দৈত্যের সারি নেমেছে।
মতি ভ্যানগাড়ির পেছনে পা ঝুলিয়ে বসেছে। তার হাতে কচুপাতায় মােড়া গরুর গােশত। জিনিসটা সে আড়াল করে রাখছে। অতিথিকে রাতে যে খাবার খাওয়ানাে হবে সেই খাবার সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এটা অতিথির জন্যে
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২১) হুমায়ূন আহমেদ
অপমানসূচক। অতিথি যেন দেখতে না পায়।
মতি মাথা ঘুরিয়ে বলল, আফারে একটু সাবধান কইরা দেই। রাইতে ঘর থাইক্যা বাইর হইবেন না। মনে করবেন কাফু জারি হইছে। যদি বাইর হইতেই হয় হারিকেন হাতে বাইর হইবেন। টর্চ না, হারিকেন।