নবনী বলল, কেন ? রাতে বের হলে সমস্যা কী ? সমস্যা আছে। ইমাম সাব বড় ত্যক্ত করতেছে । মানে কী? পরিষ্কার করে বল। পরিষ্কার করে না বললে বুঝতে পারছি না। ডাক্তার সাব চিঠিতে কিছু লেখে নাই ?
মতি আগ্রহ নিয়ে গল্প শুরু করল। গলা নামিয়ে গােপন খবর ফাঁস করার।
ভঙ্গিতে বলল— এইটা একটা মারাত্মক ইতিহাস। আমরার বিরাটনগরের ইমাম সাব তেতুলগাছে ফাঁস দিয়া মারা গেছিল।
নবনী বিস্মিত হয়ে বলল, কোন ইমাম সাহেব ? খুব সুন্দর চেহারা মাথায় পাগড়ি পরেন ?
জ্বি উনি।
উনাকে তাে চিনি। আমার জন্যে পাকা তেতুল নিয়ে এসেছিলেন। উনি ফাঁস নিয়ে মারা গেছেন ? কেন ? | সেইটা অন্য ইতিহাস, আরেক দিন শুনবেন। বর্তমান ইতিহাসটা শুনেন— ফঁসের মরার জানাজা হয় না, এইটা তাে আপনে জানেন? জানেন না ?
জানি না।
অপঘাতে মৃত্যুর জানাজা হওনের নিয়ম নাই। কবর খুইড়া বিসমিল্লাহ বইল্যা লাশ নামাইয়া দিতে হবে, এইটাই নিয়ম। ইমাম সাবেরে তাই করা হইল। প্রথমে অবশ্যি চেষ্টা করা হয়েছে দেশের বাড়িতে লাশ পাঠাইতে। দেশের বাড়িত ইমাম সাবের মেয়ে আছে, পরিবার আছে। তারার যা ইচ্ছা করব। দেশের বাড়ির ঠিকানা কেউ জানে না। এইদিকে ফাসির মরা সুরতহাল করা লাগে। সব মিলাইয়া বেড়া ছেড়া। লাশ গেল পইচা নাড়ি উল্টাইয়া যাওয়ার মতাে বাস ছুটল। তখন সিদ্ধান্ত হইল জানাজা ছাড়াই তেতুল গাছের নিচে কবর হইব।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২২) হুমায়ূন আহমেদ
তারপর?
কবর হইল— শুরু হইল ইতিহাস। বিরাটনগরের কোনাে মানুষ এখন আর রাইতে একলা বাইর হইতে পারে না। কেউ যদি একলা বাইর হয়— পিছন থাইক্যা ইমাম সাব তারে চিকন গলায় ডাক দেয়।
নবনী অবাক হয়ে বলল, যে মরে গেছে সে পেছন থেকে ডাক দিবে কীভাবে?
এইটাই তাে ইতিহাস। ইমাম সাহেব পিছন থাইক্যা ডাক দিয়া বলে, জনাব আমার জানাজাটা পড়েন। জানাজা ছাড়া কবরে শুইয়া আছি— বড় কষ্ট!
কী বল এইসব
সত্য কথা বলতেছি আফা। যদি মিথ্যা বলি তাইলে যেন আমার মাথাত ঠান্ডা পড়ে। আমার যেন কলেরা হয়। গু মুতের মধ্যে যেন মইরা পইরা থাকি। আমারে এক রাইতে নিয়া পুসকুনিত ফেলছে।
ভ্যানগাড়ির চালক পেছন ফিরে বলল, ঘটনা সত্য। বিরাটনগরের কোনাে মানুষ সইন্ধ্যার পরে ঘর থাইক্যা বাইর হয় না। পিসাব পায়খানাও ঘরের মধ্যে করে।
মতি বলল, হাতে আগুন থাকলে ভয়ের কিছু নাই। আগুন না থাকলে সমস্যা। এরা আগুন ভয় পায়। আগুন হইল ভূতের সাক্ষাত যম।।
নবনী বলল, একটা মানুষ ভূত হয়ে সবাইকে ভয় দেখাচ্ছে ?
মতি বলল, ভয় না আফা, হে চায় তার জানাজা হউক এর বেশি কিছু না। তবে আজিজ মিয়ারে এক রাইতে দৌড়ান দিছে। আজিজ মিয়া দৌড়াইতে দৌড়াইতে পুসকুনির মধ্যে লাফ দিয়া পড়ছে। চিৎকার শুরু করছে মাঝপুকুর থাইক্যা। লােকজন হারিকেন দা বল্লম নিয়া তারে উদ্ধার করছে। এখন আজিজ মিয়া আর গেরামে থাকে না। বাজারে থাকে। বাজারে তার দুইটা দোকান আছে। তার থাকার অসুবিধা নাই। তার মতাে অবস্থা তো অন্য সবের না । বাড়ি ঘর ছাইড়া যাইব কই ?
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২২) হুমায়ূন আহমেদ
আনিস ঘরে ছিল না। কলে গিয়েছে। বাড়িতে আছে সুজাত মিয়া। সে বলতে পারল না ডাক্তার সাহেব কলে কোথায় গিয়েছেন, কখন ফিরবেন।
মতি বলল, আফা কোনাে দুশ্চিন্তা নাই। ডাক্তার সাব না ফিরা পর্যন্ত আমি আছি। ডাক্তার সাবের হাতে আপনেরে সােপার্দ কইরা দিয়া তারপরে বিদায়।
নবনী বলল, তােমার থাকার দরকার নেই। তুমি তােমার কাজে যাও। আমার অসুবিধা হবে না।
আমি পাহারা দেই । বাংলা ঘরের বারান্দাত বইস্যা থাকি । ভয় টয় যদি পান। সময় খারাপ। এখন আবার চলতাছে কৃষ্ণপক্ষ।
কৃষ্ণপক্ষ হােক বা শুক্লপক্ষ হােক তােমাকে পাহারা দিতে হবে না। আমার ভয় কম। তেলাপােকা আর টিকটিকি এই দু’টা জিনিস ছাড়া কোনাে কিছুকেই ভয় পাই না।
মতির মন খারাপ হয়ে গেল।
ভ্যানগাড়ি চলে গেছে। এখন নান্দাইল রােডে যেতে হলে হেঁটে হেঁটে যেতে হবে। তাছাড়া সেখানে গিয়েইবা করবে কী ? বাতাসীর কাছে যাওয়া যাবে না । বাতাসী জেনে গেছে মতি বিরাটনগর হাইস্কুলের শিক্ষক না। এতে সে খুবই রেগেছে। আগে সে মতিকে আপনি আপনি করে বলত। ঘটনা জানার পর
থেকে সে তুই তুকারি’ করছে। এটিও অত্যন্ত অপমানসূচক ব্যাপার। বাতাসী চোখ কপালে তুলে সাপের মতাে হিসহিস শব্দ করতে করতে বলেছে—তুই না কুলি? ইস্টিশনে কুলির কাম করস। আমারে বলছস তুই মাস্টর।
মতি উদাস গলায় বলেছে, তুই তােকারি বন কর। হারামজাদা মিসকুর । তুই ভাবছস কী ?
মতি অতি বিরক্ত হয়ে বলেছে, আমি যেমন কুলি তুইও তেমন বাজারের নটি বেটি। কাটাকাটি।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২২) হুমায়ূন আহমেদ
তুই বাইর হ। বাইর হ কইলাম।। মতি বের হয়ে চলে এসেছে। এরপর আর বাতাসীর ঘরে যাবার প্রশ্ন ওঠে । মতি যা পারে তা হলাে নিজের বাড়িতে গিয়ে শুয়ে থাকতে পারে সেখানেও সমস্যা আছে। তার বাড়ি মসজিদের ইমাম সাহেবের বাড়ির কাছাকাছি। নিশি রাতে ইমাম সাহেব এসে যদি বলেন— মতিরে, আমার জানাজার ব্যবস্থা কর। তখন কী হবে? মতি মন খারাপ করে রাস্তায় নামল।
নবনী সুজাত মিয়াকে গরম পানি করতে বলল। বালিতে শরীর কিচকিচ করছে। গরম পানিতে ভালাে গােসল দিতে হবে। আগের বারে গােসলখানা বলে আলাদা কিছু ছিল না। এখন গােসলখানা বানানাে হয়েছে। চৌবাচ্চা ভর্তি পানি। চৌবাচ্চা ব্যাপারটা ঢাকা শহর থেকে উঠেই গেছে। নবনী অনেক দিন পর চৌবাচ্চা দেখল। চৌবাচ্চা দেখলেই চৌবাচ্চার অঙ্কের কথা মনে পড়ে। একটা নল দিয়ে পানি আসছে, অন্য একটা নল দিয়ে পানি চলে যাচ্ছে। কত সময়ে চৌবাচ্চাটি শূন্য হয়ে যাবে ?
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই বদলায় অঙ্কের ধরনও বদলাবে। একটা সময়ে অঙ্ক বইতে চৌবাচ্চার অঙ্ক বলে কিছু থাকবে না। নতুন ধরনের অঙ্ক থাকবে মােবাইল ফোন নিয়ে অঙ্ক। যদি একটি মােবাইল টেলিফোনে ইনকামিং চার্জ প্রতি মিনিটে দুই টাকা হয় তবে...।‘
নবনীর ভালাে লাগছে। ভ্যানগাড়ির ঝাকুনিতে শরীরের কলকজা নড়ে গিয়েছিল— এখন মনে হচ্ছে জায়গামতাে বসছে। চৌবাচ্চার পানি হিম শীতল,
শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে।
বাড়িঘর সুন্দর করে গােছানাে এটা দেখতেও ভালাে লাগছে। খাটের চাদর টানটান করে বিছানাে। খাটের পাশের টেবিলে টেবিল ল্যাম্প।