এই চোখ যে সব জায়গা দিয়ে যায় তার ব্যাপক ক্ষতি করে কিন্তু আশেপাশে তেমন কিছু হয় না।
পুস্কুনির সব মাছ ভাইস্যা উঠছে— খবর পাইছেন? সেটাই দেখতে এসেছিলাম। ইন্টারেস্টিং তাে বটেই। এই জিনিস আমি নিজেও আগে কখনাে দেখি নি।
মতি গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, এটা আর কিছু না। এটা আল্লাপাকের ঘণ্টা। আল্লাপাক ঘন্টার মধ্যে বাড়ি দিয়া আমাদের বলেছেন— বান্দা, সাবধান হও।
আনিস কিছু বলল না। সাইকেল টেনে এগুতে লাগল। তার পেছনে পেছনে আসছে মতি। এটা মােটামুটি একটা দুর্ঘটনা। মতি কথা না বলে থাকতে পারে না। হড়বড় করে কথা সে বলতেই থাকবে। মতির বয়স ত্রিশ । ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়াশােনা। বিরাটনগরে তার একটা চালাঘর আছে তবু রাতে সে ঘুমায় নান্দাইল রােড ইস্টিশনে। একই সঙ্গে সে নানান কাজকর্ম করে, আবার কিছুই করে না। মাঝে মধ্যে কুলির কাজ করে।
যাত্রীদের মালামাল নামায়। কিছুদিন গ্রামে এসে থাকে। ঘরামীর কাজ করে। শীতের সিজনে মুড়ি লাডু বানিয়ে ট্রেনে করে বিক্রি করতে চলে যায়— গৌরীপুর মােহনগঞ্জ। কিছুদিন হলাে— সে জ্বরের একটা বড়ি বানানাের চেষ্টা করছে। লালু ফকিরের কাছ থেকে ফর্মুলা জোগাড় হয়েছে। ফর্মুলা মতাে বড়ি বানিয়ে রােদে শুকাতে দেবার সময় গণ্ডগােলটা হচ্ছে। একটু শুকালেই বড়ি পাউডারের মতাে হয়ে যাচ্ছে । বড়ির নামও মােটামুটি ঠিক করা—
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২) হুমায়ূন আহমেদ
জ্বরমতি’
নিজের নামটা কায়দা করে বড়ির নামের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়া। যতদিন এই বড়ি থাকবে ততদিন মতির নামও থাকবে। এটা কম কথা না।
বড়ি বানানাে হয়ে গেলে হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে গৌরীপুর, নেত্রকোনা, শ্যামগঞ্জ এই লাইনে বিক্রি করতে হবে। এই অঞ্চলের লােকদের পেটের ব্যথা বেশি— ট্যাবলেটে চোখের নিমিষে উড়ে যাবে। বিজ্ঞাপনের ভাষাও মােটামুটি ঠিকঠাক
আসিয়াছে! আসিয়াছে!! জ্বর নাশক ‘জ্বরমতি’ বড়ি। এক বড়ি যেমন তেমন
দুই বড়িতে কাম ভাই ব্রেদার শুনেন শুনেন।
জ্বরমতির নাম। এই বড়ি স্বপ্নে প্রাপ্ত। বড়ির ক্রয় বিক্রয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
শুধু হাদিয়া বাবদ পাঁচ টাকা। বড়ি সেবনের পরের সাত দিন গােমাংস ভক্ষণ এবং
স্ত্রী সহবাস সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। গ্যারেন্টিসহ চিকিৎসা। বিফলে সম্পূর্ণ মূল্য ফেরত। মতির ইচ্ছা বড়ির বিষয়টা নিয়ে ডাক্তার সাহেবের সাথে কথা বলে। ডাক্তার সাহেব অতি জ্ঞানী মানুষ, তিনি সমস্যার সমাধান জানবেন। বড়িগুলাে পাউডার হয়ে যাচ্ছে কেন এটা তিনি কি আর জানবেন না। ডাক্তার মানুষ তাদের কাজ কারবার হলাে বড়ি নিয়ে।
ডাক্তার সাব।
মতি চিন্তিত মুখে ডাক্তার সাহেবের দিকে তাকাল। সে সামান্য হতাশ বােধ করছে। ডাক্তার সাহেব ‘’ বলা শুরু করেছেন। ডাক্তার সাহেবের এই এক অভ্যাস। একবার ‘হু‘ বলা শুরু করলে— ’ বলতেই থাকেন। যাই
জ্ঞেস করা হােক, উত্তর একটাই— হু‘।
বড়ই আচানক ঝড় হয়েছে। কি বলেন?
পাখি মারা পড়েছে বেশুমার। সব ধরনের পাখি মারা পড়েছে। এর মধ্যে একটা ডাহুক পাখিও দেখলাম।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২) হুমায়ূন আহমেদ
হুঁ।
ডাহুক পাখির মাংস অতি স্বাদু।
আপনি ডাহুক পাখির মাংস কোনােদিন খেয়েছেন? না। খাই নি।
মতি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ডাক্তার সাহেব হুঁ বলা বন্ধ করেছেন। এখন হয়তাে কিছু কথাবার্তা বলবেন।
ডাহুক পাখি বছরে একদিন অন্ধ হয়ে যায় এটা জানেন ?
খুবই আচানক ঘটনা। বছরে একদিন ডাহুক পাখি চোখে দেখে না। ডাহুক পাখি ধরার এই একটাই সুযােগ। ঐ দিনেই ধরা হয়।
ডাক্তার কৌতূহল চোখে তাকাল। একটি বিশেষ শ্রেণীর পাখি বসরে একদিন চোখে দেখে না— এটাতাে বিস্ময়কর ঘটনা। ঘটনার পেছনে কি সত্যতা আছে ? না–কি এটিও অনেক লােকজ বিশ্বাসের মতাে একটি অপরীক্ষিত লােকজ বিশ্বাস ?
ডাক্তার সাব । বল। ঝড়ে যেসব পাখি মারা গেছে সেইগুলা খাওয়া কি জায়েজ আছে? তােমার কথা বুঝতে পারছি না।
ধরেন একটা ডাহুক পাখি গাছের আগায় বসে আছে। ছররা গুলি দিয়া তারে মারলাম। এই পাখি খাওয়া জায়েজ আছে। আবার ধরেন ঝড়ে পাখিটা মারা গেল— সেটা খাওয়া কি জায়েজ আছে?
আমি বলতে পারছি না। তবে আমি কোনাে সমস্যা দেখি না। খাবেন ? ডাক্তার বিস্মিত হয়ে বলল, কী খাব?
মতি ইতস্তত করে বলল, বাঁশ ঝাড়ের নিচে একটা ডাহুক পাখি মরে পড়ে আছে। বেশি করে পিয়াজ রসুন দিয়ে ঝলঝল করে বেঁধে নিয়ে আসি ? খান।
আপনে ডাহুক পাখির মাংস খান নাই। খেলে মজা পাবেন। পাখির মাংস শক্ত হয় । ডাহুক পাখির মাংস মােলায়েম ! হাড্ডি সুদ্দা মুখের মধ্যে গলে যায়। যদি খান— ব্যবস্থা করি।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২) হুমায়ূন আহমেদ
ডাহুক পাখি খাব না।‘ আমার কথায় রাগ হয়েছেন?
রাগ হই নি। রাগ হব কেন ? রাগ হয়ে থাকলে নিজগুণে ক্ষমা করবেন। এতবড় একটা ঝড় নিজের চউক্ষে দেখার পর থাইক্যা মাথা ঠিক নাই। কী বলতে কী বলি।
ডাক্তার জবাব না দিয়ে সাইকেলে উঠে পড়ল। মতি ফিরে চলল বাঁশঝাড়ের কাছে। ডাহুক পাখিটার একটা ব্যবস্থা করতে হয়। নান্দাইল রােড বাজারের একটা মেয়ে মানুষের কাছে তার যাতায়াত আছে। মেয়ে মানুষটার নাম মর্জিনা । এই মেয়ের খাওয়া খাদ্য খুব পছন্দ। সবসময় তার মুখে কিছু না। কিছু আছে। মুখ নড়ছেই— টুকুর টুকুর টুকুর। এক বাটি পাখির মাংস বেঁধে নিয়ে গেলে মর্জিনা বড়ই খুশি হবে । তুফানের গল্পটাও করা দরকার। সামান্য জোড়াতালি দিয়ে সুন্দর করে বলতে হবে । আচানক ঘটনা শুনতে পুরুষ মানুষ তেমন পছন্দ করে না, মেয়ে মানুষ করে। ঝড়ের ঘটনা মতি কীভাবে বলবে মনে মনে গুছাতে শুরু করল
বুঝলি মর্জিনা— আল্লাপাকের কুদরতির শেষ নাই। পরিষ্কার দিন। নীলা আসমান। হঠাৎ বাজ পড়ার মতাে শব্দ। দৌড় দিয়া ঘর থাইক্যা বাইর হইয়া দেখি মাথার ওপর দিয়া উড়াজাহাজের মতাে কী জানি যায় । শোঁ শোঁ বোঁ বোঁ শব্দ। চউখ কচলাইয়া তাকাইলাম না উড়াজাহাজ না, বটগাছ। বিরাট বটগাছ আমার বাড়ির ওপরে দিয়া উড়াল মাইরা যাইতেছে। ঘটনা এইখানে শেষ না । বটগাছে এক মাইয়্যালােক বসা। পানের বাটার মতাে গােল মুখ।
ঠোট টকটকা লাল। মনে হইতাছে এইমাত্র রক্ত খাইয়া আসছে— ঠোটে রক্ত লাইগ্যা আছে। তার পরনে একটা কাপড় দূরের কথা, সুতা পর্যন্ত নাই।
মর্জিনা গল্পটা পুরাে বিশ্বাস করবে। মেয়ে মানুষের যে স্বভাব বিশ্বাস। করলেও ভাব দেখাবে বিশ্বাস করে নাই। মুখ ঝামটা দিয়ে বলবে, আফনে এমন মিছখাের। খালি মিছা কথা। বটগাছের ওপরে নেংটা মেয়েছেলে। ছিঃ।।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(২) হুমায়ূন আহমেদ
মতিকে তখন আল্লাখােদার নামে কীরা কাটতে হবে। এতে কিছু পাপ হবে। কোনাে এক জুম্মাবারে মসজিদে গিয়ে তওবা করে পাপ কাটাতে হবে ।
ডাক্তার সারাগ্রাম ঘুরে এখন দাঁড়িয়ে আছে মগড়া খালের কাছে। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেলেও এই জায়গায় কী করে জানি খানিকটা আলাে আটকে আছে। শীতকালে খালে কোনাে পানি থাকে না। এখন আশ্বিন মাস, পায়ের পাতা ডােবার মতাে পানি আছে। পাহাড়ি নদীর পানির মতাে এই খালের পানি চকচক করছে। মগড়া খাল মূল যে নদী থেকে এসেছে তার পানি ঘােলা অথচ এই খালের পানি সবসময়ই ঝকঝকে পরিষ্কার। দেখলেই আজলা ভর্তি পানি নিয়ে চোখে মুখে দিতে ইচ্ছা করে।