ডাক্তার জংলী কাঠগােলাপ গাছে হেলান দিয়ে সাইকেলটা রাখল। সাইকেলের কেরিয়ারে বাঁধা পেটমােটা চামড়ার ব্যাগ হাতে নিল । মগড়া খালের পাশে সুন্দর বসার ব্যবস্থা আছে। জনৈক বিধুভূষণ চক্রবর্তীর বানানাে গােলাকৃতি ঘর। যে ঘরের মেঝে শ্বেতপাথরে বাঁধানাে।
একসময় মগড়া খাল বিশাল নদী ছিল। তার নাম ছিল হাবলংগ নদী। নদীর তীরে ছিল মহাশ্মশান। দূর দূরান্ত থেকে খাটিয়ায় করে মরা আসত। সেই সময় বিধুভূষণ চক্রবর্তী শশান যাত্রীদের জন্য এই ঘর বানিয়ে দেন। নিজের কর্মকাণ্ডও দেয়ালে লিখে রাখেন—
শ্মশানবন্ধুর কল্যাণ কর্মে অনাথ কাঙাল বিধুভূষণ চক্রবর্তী কর্তৃক বঙ্গতারিখ ১৩২০ সনে নির্মিত। শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ প্রবেশ করিবেক
অন্যথায় মহাপাতকী হইবেন। দেড়শ বছরে হাবলংগ নদী হেজেমেজে হয়ে গেছে মগড়া খাল। শ্মশানবন্ধুদের কল্যাণকর্মে নির্মিত ঘর ধ্বসে গিয়েছে। উত্তরদিকের দেয়াল ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবে শ্বেতপাথরের মেঝে অবিকৃত আছে। জোছনার সময় মেঝে থেকে জোছনা ঠিকরে পড়ে। ডাক্তার লোক লাগিয়ে মেঝে পরিষ্কার করিয়েছে। সে মাঝে মাঝে এখানে এসে বসে, যদিও জায়গাটা বিপজ্জনক। গত বৎসর দু’টা গরু এই জায়গায় সাপের কামড়ে মারা গেছে। তার আগের বছর এক ভিখিরিণী মারা গেছে। ভিখিরিণীর পরিচয় উদ্ধার হয় নি। মনে হয় অনেক দূরের কোনাে গ্রাম থেকে ভিক্ষা করতে করতে এদিকে চলে এসেছিল। দুপুরে ক্লান্ত হয়ে আঁচল পেতে নির্জন শুশনি ঘরে শুয়েছিল। সেখানেই তাকে সাপে কাটল।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৩) হুমায়ূন আহমেদ
ডাক্তার চামড়ার ব্যাগ খুলে পেটমােটা একটা শিশি বের করে শিশির মুখ খুলল। ছড়িয়ে পড়ল কার্বলিক এসিডের কড়া গন্ধ। সে যতক্ষণ এখানে থাকে মুখ খােলা অবস্থায় কার্বলিক এসিডের বােতলটা পাশে থাকে। যে–কোনাে পুরনাে ধ্বংসস্থূপ হলাে গোখরা সাপের আস্তানা। প্রচণ্ড বিষধর সাপ ভীরু প্রকৃতির হয়ে থাকে। তাদের স্বভাব হলাে মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকা। এই ক্ষেত্রে মানুষেরও কিছু করণীয় আছে। মানুষদের উচিত তাদের উপস্থিতি জানান দেয়া।
ডাক্তারের চায়ের পিপাসা পেয়েছে। তার পেটমােটা ব্যাগে চায়ের সব সরঞ্জামই আছে। ফ্লাস্ক ভর্তি ফুটন্ত গরম পানি। টি ব্যাগ, চিনি। আল গ্রে চায়ের একটি টিনের কৌটাও আছে। আল গ্রে চায়ের বিশেষ গন্ধটা নবনীর অতি প্রিয়। এই কৌটার‘ মুখ এখনাে খােলা হয় নি। সামনের সপ্তাহেই নবনীর আসার কথা। তখন খােলা হবে।
চা বানানাের সরঞ্জাম ব্যাগ থেকে বের করা হয়েছে। সন্ধ্যা মিলিয়ে যাবার পরেও জায়গাটা পুরােপুরি অন্ধকার হয় নি। অবশ্যি অন্ধকার হলেও সমস্যা নেই। ব্যাটারিতে চলে এমন একটা ছােট্ট লণ্ঠন ব্যাগে আছে। চা কড়া হয়ে গেছে— তারপরেও চুমুক দিয়ে আনিসের ভালাে লাগল। সে ব্যাগের ভেতর থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। মাস ছয়েক হলাে সে সিগারেট ছাড়ার প্রাণপন চেষ্টা করছে। লাভ হচ্ছে না। সিগারেট খাওয়া বরং বেড়ে গেছে। নবনী এলে সিগারেট খাওয়া পুরােপুরি ছাড়তে হবে। নবনী সিগারেটের গন্ধ একেবারেই সহ্য করতে পারে না।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৩) হুমায়ূন আহমেদ
তার নাকি সিগারেটের প্যাকেট দেখলেই গন্ধে মাথা ধরে, বমি চলে আসে। গত সপ্তাহে নবনীকে চিঠি লেখা হয় নি। নির্জন জায়গায় বসে চট করে কয়েক লাইনের চিঠি লিখে ফেলা যায়। চিঠির সরঞ্জাম— কাগজ, বলপয়েন্ট, খাম, ডাকটিকিট সবই তার মােটা ব্যাগে আছে। চিঠি লিখবে কি লিখবে না— আনিস মনস্থির করতে পারছে না। তার সিগারেট শেষ হয়েছে, সে আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছে। চিঠি লেখার পরিকল্পনা আপাতত বাতিল। তবে চিঠির ব্যাপারটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মস্তিষ্কের একটা অংশ গুটগুট করে চিঠি লেখা শুরু করে দিয়েছে। আনিস এখন যদি সাইকেলে উঠে রওনা দেয় তবু চিঠি লেখা বন্ধ হবে না।
নবনী,
আমাদের এখানে আজ হঠাৎ করে টর্নেডাের মতাে। হলাে । টর্নেডাের স্থায়িত্ব ছিল কম। দুই থেকে আড়াই
মিনিট হবে। তবে এই কিছুক্ষণেই যা ঘটেছে তার নাম লণ্ডভণ্ড। ছবি তুলে রাখলে তুমি দেখতে পেতে। ফিল্ম ছিল
বলে ছবি তােলা হয় নি। এখানের বাজারে ফিল্ম পাওয়া যায় না। ফিল্মের জন্যে লােক পাঠাতে হয় নেত্রকোনায়। তােমার যদি মনে থাকে তাহলে ফিল্ম নিয়ে এসাে। এই অজ অঞ্চলে মাঝে মাঝে সুন্দর সুন্দর ব্যাপার ঘটে যার ছবি তুলতে ইচ্ছে করে।
আমার খবর ভালাে । হাসপাতালে প্রচুর রােগী আসে। তেমন কোনাে কারণ ছাড়াই আমার ধন্বন্তরী ডাক্তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। এরা আমার নাম কি দিয়েছে জান ? আমার নাম দিয়েছে– ‘সাইকেল ডাক্তার‘। একটা সাইকেল নিয়ে ঘােরাফেরা করি এই জন্যেই এই নাম। ভাগ্যিস ঘােড়ার পিঠে চড়ি না। চড়লে এরা নাম দিত ‘ঘােড়া ডাক্তার। আমার বিষয়ে যে মজার ব্যাপারটি ছড়িয়েছে সেটা হলাে— যখন আমি ভিজিটে যাই এবং রােগীর বাড়ির সামনে সাইকেল থেকে নেমে ঘণ্টা দেই ঠিক তখনি সাইকেলের ঘণ্টা শুনে রােগীর রােগ সেরে যায়। ওষুধপত্র কিছুই লাগে না। আমি খুব ভয়ে ভয়ে আছি
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৩) হুমায়ূন আহমেদ
অচিরেই এরা হয়তাে আমাকে সাইকেল ডাক্তার’ ডাকা বন্ধ করে ‘ঘন্টা ডাক্তার’ ডাকা শুরু করবে।
তুমি যে চারটা অর্কিড দিয়ে গিয়েছিলে সেইগুলাে বারান্দার যে জায়গায় ঝুলাতে বলেছ সেখানেই ঝুলানাে হয়েছে। যেভাবে যত্ন করতে বলেছ সেভাবেই যত্ন করছি। তােমার হিসেব মতাে গত মাসেই গাছগুলােতে ফুল আসার কথা। এখনাে কিন্তু আসে নি। হঠাৎ করে অর্কিডের প্রসঙ্গ কেন এল— বলি। পরশু রাতে স্বপ্নে দেখি গাছগুলােতে ফুল ফুটেছে। স্বপ্নের ফুল বাস্তবের ফুলের চেয়েও সুন্দর হয়। স্বপ্নে দেখলাম গাছগুলােতে শুধু যে নীল রঙের ফুল ফুটেছে তা না। ফুলগুলাে চাঁদের জোছনার মতাে চারপাশে আলাে ছড়াচ্ছে। আমি খুবই ব্যস্ত হয়ে এই অপূর্ব দৃশ্য তােমাকে দেখাবার জন্যে ডাকাডাকি করছি। তুমি যে এখানে থাক না
এটা আমার মনে নেই।
আমার চিঠি পড়ে তােমার কি হাসি পাচ্ছে ? মনে হচ্ছে ডাক্তারের ভেতর কাৰ্য ভাব চলে এসেছে ?
কিছুটা যে আসে নি তা–না। রােগ শােক ছাড়াও ইদানীং আমি আরাে অনেক কিছু নিয়ে ভাবি। কিছু কিছু ভাবনা বেশ উদ্ভট।...
হঠাৎ একসঙ্গে ঝিঝি পােকা ডাকতে শুরু করল । লােক বসতির বাইরে যেসব ঝিঝি ডাকে তাদের গলার জোর অনেক বেশি। তারা একসঙ্গে ডাকতে শুরু করে, আবার হঠাৎ করে একসঙ্গে থেমে যায়। একজন শুধু থামে না। সে ডেকে যেতেই থাকে। সে সম্ভবত ঝিঝি পােকাদের লীডার।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৩) হুমায়ূন আহমেদ
আনিস উঠে দাঁড়াল। রাত হয়ে গেছে। কোয়ার্টারে ফেরা দরকার । কৃষ্ণপক্ষ চলছে। অন্ধকারে সাইকেল চালানাে কষ্টকর ব্যাপার। রাস্তাটা খানাখন্দে ভরা। সাইকেল টেনে টেনে নিয়ে যেতে হবে।
কাঠগােলাপের গাছে সাইকেল হেলান দিয়ে রাখা হয়েছিল। সেখানে। শতশত জোনাকি পােকা জ্বলছে— সাইকেল নেই। আনিসের বিস্ময়ের সীমা রইল না। কেউ একজন চুপিচুপি সাইকেল নিয়ে চলে গেছে। সাইকেলটা তার শখের জিনিস ছিল। পােষা কুকুরের ওপর যেমন মায়া পড়ে, সাইকেলের ওপরও সে রকম মায়া পড়ে গেছে। আনিস খুবই অবাক হয়ে লক্ষ করল— তার রাগ লাগছে না। মন খারাপ লাগছে। জোনাকি পােকাগুলাে ঝক বৈঁধে উড়ছে। অতি সুন্দর দৃশ্য। এই দৃশ্যও মন টানছে না। আনিস হাঁটতে শুরু করল। জোনাকি পােকাগুলাে পেছনে পেছনে আসছে।