তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৪) হুমায়ূন আহমেদ

 এরা সরাসরি উড়ছে 

ঢেউএর মতাে ওঠানামা করছেআনিস আরেকটা সিগারেট ধরালসাইকেলের শোেক ভােলার চেষ্টা করতে হবেমাথায় অন্য কোনাে চিন্তা ঢুকাতে হবেজোনাকি পােকা নিয়ে চিন্তা করা যেতে পারেমানুষ কি কখনাে

তেঁতুল বনে জোছনা

জোনাকি পােকা পােষ মানাতে পেরেছে? মানুষের পক্ষে অসম্ভব কিছু নেইপশু, পাখি, মৌমাছি যে পোষ মানাতে পারে জোনাকি পোকা সে পােষ মানাতে কেন পারবে না ? মানুষ বিচিত্র সব জিনিস চেষ্টা করে দেখে এই চেষ্টাটা কেউ কি করে নি ? জোনাকি পােকা পােষ মানানাে গেলে সে কিছু জোনাকি পােষ মানাতােনবনী এবং সে অন্ধকারে বসে গল্প করবে, আর তাদের দুজনের মাঝখানে পাঁচশ জোনাকি জ্বলবে নিভবে। 

তীক্ষ্ণ গলায় হঠাৎ কে যেন কথা বলল। 

কেডা গাে ডাক্তার সাব না

আনিস থমকে দাঁড়ালমনে হচ্ছে ঝােপের মধ্যে কেউ ঘাপটি মেরে বসে আছেভয় দেখানাের জন্যে আচমকা কথা বলে উঠেছে। 

ডাক্তার সাব ডরাইছেন

আমি বদিচেয়ারম্যান সাব আফনেরে বেচায়েন হইয়া খুঁজতেছেআচ্ছা। 

কোনােখানে খুঁইজা পাই নাশেষে মনে হইলআফনে আছেন শ্মশানঘাটায়চইল্যা আসলাম। 

ভালাে করেছ। 

দূর থাইক্যা দেখছি আপনে আসতাছেনতখন ভাবলাম দেখি আমরার ডাক্তার সাবের সাবাস কেমনকড়ই গাছের নিচে লুকাইয়া বইস্যা ছিলাম। 

চেয়ারম্যান সাহেব কেন ডেকেছেন জান? খানা খাইবার জন্যে ডেকেছেনউনি একলা খানা খাইতে পারেন নাআইজ খানার আয়ােজন ভালােখাসি জবেহ হয়েছে। 

তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৪) হুমায়ূন আহমেদ

ঝড় হয়েছে যে এই জন্যে জানের ছদকাচেয়ারম্যান সাব ঝড় তুফান খুব ভয় পায় । 

তুমি ভয় পাও না

আমিও ভয় পাইগরিবের ভয় নিয়া কোনাে আলাপ হয় নাবড়লােকের ভয় নিয়া আলাপ হয়দেন ব্যাগটা আমার হাতে দেন। 

থাক । 

থাকব ক্যানআপনে ব্যাগ নিয়া কষ্ট কইরা হাঁটবেন আর আমি বাবুসাবের মতাে হাত পাও নাচাইয়া হাঁটব এইটা হয় না। 

বদি জোর করে ব্যাগ নিয়ে নিল। 

চেয়ারম্যান সাহেবের নাম জহির উদ্দিন খাঁবয়স ষাটের কাছাকাছিশক্ত সমর্থ চেহারাজীবনের বেশির ভাগ সময় মানুষকে ধমক ধমক দিয়ে পার করেছেন বলে চেহারায় ধমকের স্থায়ী ছাপ পড়ে গেছেশান্ত ভঙ্গিতে যখন। 

বসে থাকেন তখনও মনে হয় সামনের মানুষটাকে ধমকাচ্ছেন। 

লােকজনদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে তার দুটা ঘর আছেএকটা হলো বাংলা ঘর সাধারণ পরিচিতজনরা সেখানে বসেআরেকটা হলাে ভেতর বাড়ির দিকের একটা ঘর যার নাম মাঝলা ঘরমাঝলা ঘর ঘনিষ্ঠ জনদের জন্যে। মাঝলা ঘরে বিরাট খাট পাতা আছেঅতিথিদের খাটে পা তুলে উঠে বসতে হয়তিনি একা কাঠের একটা চেয়ারে বসেনচেয়ারের সামনে জলচৌকিতিনি পা তুলে দেন জলচৌকিতে।। | আনিস ভেবেছিল চেয়ারম্যান সাহেবের মাঝলা ঘরে গিয়ে দেখবে ঘর ভর্তি লােকসব সময় তাই থাকেআজ ঘর ফাকাজহির উদ্দিন খাঁ গম্ভীরমুখে পান চাবাচ্ছেনঠোটের ফাক দিয়ে পানের লাল পিক গড়াচ্ছেচেয়ারের হাতলে রাখা গামছায় পানের পিক মুছছেন। 

তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৪) হুমায়ূন আহমেদ

ডাক্তার আছ কেমন ? জ্বি ভালাে। 

গজব হয়ে গেছিলএমন ঝড় আমি জীবনে দেখি নাইএই যে বুক ধড়ফড় শুরু হয়েছে এখনাে কমে নাইআয়াতুল কুরশি পড়ার চেষ্টা করছিলাম ভয়ের চোটে সূরা ভুলে গেলামযতই চেষ্টা করি মনে আসে নাতুমি আসার আগে আগে মনে পড়েছেতিনবার পড়েছিপা তুলে আরাম করে বস ডাক্তার। 

আনিস পা তুলে বসল। 

একটা বালিশ নিয়ে হেলান দাওতােমাকে আমি অত্যন্ত স্নেহ করি এইটা বােধহয় তুমি জান নাআমার রাগ যেমন বেশি, স্নেহও বেশিফাজিল লােকজন রাগটা দেখে, স্নেহ দেখে নাতােমার মনটা খারাপ কেন

মন খারাপ নাবৌমা আবার কবে আসবে

সামনের সপ্তাহে আসার কথাতার তাে ইউনিভার্সিটি খেলাইচ্ছা থাকলেও ইউনিভার্সিটি ফেলে আসতে পারে না। 

চেয়ারম্যান সাহেব পিক মুছতে মুছতে বললেন, স্ত্রীদের ইউনিভার্সিটি হলাে তাদের স্বামীএর বাইরে কোনাে ইউনিভার্সিটি নাইবৌমাকে আসার জন্যে চিঠি দিয়ে দাওএই বাংলা মাসের একুশ তারিখ ধলা গ্রামে আড়ং হবেড়ের লড়াইশহরের মেয়ে এইসব তাে দেখে নাইদেখলে মজা 

তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৪) হুমায়ূন আহমেদ

পাবে আসতে বলে দাও । 

জ্বি আচ্ছাষাড়ের লড়াই তুমি দেখেছ ? জ্বি না । 

অতি মনােহরএই বৎসর লড়াইআমার নিজের ঘাড় আছেষাঁড়ের নাম জুম্মা খান দেখি জুম্মা কী করে সরবত খাও দিতে বলি। 

জ্বি না সরবত খাব না। 

খাওখেলে ভালাে লাগবেদুধ পেস্তাবাদাম দিয়ে বানানাে সরবতবরফের কুচি দিয়ে ঠাণ্ডা করাবরফ আনায়েছি নেত্রকোনা থেকেবরফ অবশ্যি সরবত বানানাের জন্যে আনি নাইআমি মাঝে মধ্যে সামান্য মদ্যপান করি।তার জন্যে বরফ লাগেতুমি মদ্যপান কর ? 

জ্বি না। 

তােমার আগে যে ডাক্তার ছিলসিদ্দিক নাম সে এই লাইনে ওস্তাদ লােক ছিলপুরা এক বােতল একা খেয়েছেতারপরেও কিছু হয় নাইযাই হােক 

সরবত খাও। 

চেয়ারম্যান সাহেব গলা উঁচিয়ে ডাকলেনসরবত আন। 

সরবত মনে হলাে তৈরিই ছিলচেয়ারম্যান সাহেবের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সরবতের গ্লাস নিয়ে ঘরে সতেরাে আঠারাে বছরের একটা মেয়ে ঢুকলআনিস চমকে উঠল গ্রাম ঘরে এমন রূপবতী মেয়ে সচরাচর দেখা যায় নাঠোট পর্যন্ত লাললিপিস্টিকের লাল না, পানের রসের লালও না। 

এমিতেই লালযেন টোকা দিলেই রক্ত বের হবে। 

চেয়ারম্যান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন— এর নাম হেনা আমার দূর সম্পর্কের ভাইস্তিঅনাথ মেয়েপিতামাতা গত হয়েছেথাকত মামার বাড়িতেতারা খুবই অত্যাচার করতশেষে আমার কাছে এনে রেখেছিমেয়েটাকে ভালাে করে দেখ ডাক্তার

তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৪) হুমায়ূন আহমেদ

আনিস অস্বস্তিতে পড়ে গেলমেয়েটাকে ভালাে করে দেখার কী আছে সে বুঝতে পারছে না। 

মেয়ে সুন্দর কি না বল ? জ্বি সুন্দরভালাে করে দেখেছ তাে

জ্বি। 

সিনেমার কোনাে হিরুইন এই মেয়ের কাছে আনলে মনে হইব বান্দিঠিক বলেছি না

ডাক্তার চুপ করে রইল। 

চেয়ারম্যান সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, এখন এই মেয়ের জন্যে শহর থেকে পাত্র জোগাড় করবাতােমার অবিবাহিত বন্ধু বান্ধব আছে না ? তাদের চিঠি দিবাসঙ্গে কন্যার ছবি দিয়া দিবাময়মনসিংহ শহরে নিয়াস্টুডিওতে হেনার ছবি তুলিয়েছিচেহারা যত সুন্দর ছবি তত সুন্দর হয় নাইছবি তােমার কাছে পাঠায়ে দিব। 

হেনা মূর্তির মতাে দাঁড়িয়ে আছেকী করবে বুঝতে পারছে নাতার ঠোট কাঁপছে, মনে হয় সে কেঁদে ফেলবেজহির উদ্দিন খাঁ হেনার দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে মাছি তাড়াবার মতাে ভঙ্গি করে বললেনযা এখন ঘরে যা। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *