এরা সরাসরি উড়ছে
ঢেউ–এর মতাে ওঠানামা করছে। আনিস আরেকটা সিগারেট ধরাল। সাইকেলের শোেক ভােলার চেষ্টা করতে হবে। মাথায় অন্য কোনাে চিন্তা ঢুকাতে হবে। জোনাকি পােকা নিয়ে চিন্তা করা যেতে পারে। মানুষ কি কখনাে।
জোনাকি পােকা পােষ মানাতে পেরেছে? মানুষের পক্ষে অসম্ভব কিছু নেই। পশু, পাখি, মৌমাছি যে পোষ মানাতে পারে জোনাকি পোকা সে পােষ মানাতে কেন পারবে না ? মানুষ বিচিত্র সব জিনিস চেষ্টা করে দেখে এই চেষ্টাটা কেউ কি করে নি ? জোনাকি পােকা পােষ মানানাে গেলে সে কিছু জোনাকি পােষ মানাতাে। নবনী এবং সে অন্ধকারে বসে গল্প করবে, আর তাদের দুজনের মাঝখানে পাঁচশ জোনাকি জ্বলবে নিভবে।
তীক্ষ্ণ গলায় হঠাৎ কে যেন কথা বলল।
কেডা গাে ডাক্তার সাব না ?
আনিস থমকে দাঁড়াল। মনে হচ্ছে ঝােপের মধ্যে কেউ ঘাপটি মেরে বসে আছে। ভয় দেখানাের জন্যে আচমকা কথা বলে উঠেছে।
ডাক্তার সাব ডরাইছেন ?
আমি বদি। চেয়ারম্যান সাব আফনেরে বেচায়েন হইয়া খুঁজতেছে। ও আচ্ছা।
কোনােখানে খুঁইজা পাই না। শেষে মনে হইল— আফনে আছেন শ্মশানঘাটায়। চইল্যা আসলাম।
ভালাে করেছ।
দূর থাইক্যা দেখছি আপনে আসতাছেন— তখন ভাবলাম দেখি আমরার ডাক্তার সাবের সাবাস কেমন। কড়ই গাছের নিচে লুকাইয়া বইস্যা ছিলাম।
চেয়ারম্যান সাহেব কেন ডেকেছেন জান? খানা খাইবার জন্যে ডেকেছেন। উনি একলা খানা খাইতে পারেন না। আইজ খানার আয়ােজন ভালাে। খাসি জবেহ হয়েছে।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৪) হুমায়ূন আহমেদ
ঝড় হয়েছে যে এই জন্যে জানের ছদকা। চেয়ারম্যান সাব ঝড় তুফান খুব ভয় পায় ।
তুমি ভয় পাও না?
আমিও ভয় পাই। গরিবের ভয় নিয়া কোনাে আলাপ হয় না। বড়লােকের ভয় নিয়া আলাপ হয়। দেন ব্যাগটা আমার হাতে দেন।
থাক ।
থাকব ক্যান। আপনে ব্যাগ নিয়া কষ্ট কইরা হাঁটবেন আর আমি বাবুসাবের মতাে হাত পাও নাচাইয়া হাঁটব এইটা হয় না।
বদি জোর করে ব্যাগ নিয়ে নিল।
চেয়ারম্যান সাহেবের নাম জহির উদ্দিন খাঁ। বয়স ষাটের কাছাকাছি। শক্ত সমর্থ চেহারা। জীবনের বেশির ভাগ সময় মানুষকে ধমক ধমক দিয়ে পার করেছেন বলে চেহারায় ধমকের স্থায়ী ছাপ পড়ে গেছে। শান্ত ভঙ্গিতে যখন।
বসে থাকেন তখনও মনে হয় সামনের মানুষটাকে ধমকাচ্ছেন।
লােকজনদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে তার দু’টা ঘর আছে। একটা হলো বাংলা ঘর সাধারণ পরিচিতজনরা সেখানে বসে। আরেকটা হলাে ভেতর বাড়ির দিকের একটা ঘর যার নাম মাঝলা ঘর। মাঝলা ঘর ঘনিষ্ঠ জনদের জন্যে। মাঝলা ঘরে বিরাট খাট পাতা আছে। অতিথিদের খাটে পা তুলে উঠে বসতে হয়। তিনি একা কাঠের একটা চেয়ারে বসেন। চেয়ারের সামনে জলচৌকি। তিনি পা তুলে দেন জলচৌকিতে।। | আনিস ভেবেছিল চেয়ারম্যান সাহেবের মাঝলা ঘরে গিয়ে দেখবে ঘর ভর্তি লােক। সব সময় তাই থাকে। আজ ঘর ফাকা। জহির উদ্দিন খাঁ গম্ভীর। মুখে পান চাবাচ্ছেন। ঠোটের ফাক দিয়ে পানের লাল পিক গড়াচ্ছে। চেয়ারের হাতলে রাখা গামছায় পানের পিক মুছছেন।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৪) হুমায়ূন আহমেদ
ডাক্তার আছ কেমন ? জ্বি ভালাে।
গজব হয়ে গেছিল— এমন ঝড় আমি জীবনে দেখি নাই। এই যে বুক ধড়ফড় শুরু হয়েছে এখনাে কমে নাই। আয়াতুল কুরশি পড়ার চেষ্টা করছিলাম ভয়ের চোটে সূরা ভুলে গেলাম। যতই চেষ্টা করি মনে আসে না। তুমি আসার আগে আগে মনে পড়েছে। তিনবার পড়েছি। পা তুলে আরাম করে বস ডাক্তার।
আনিস পা তুলে বসল।
একটা বালিশ নিয়ে হেলান দাও। তােমাকে আমি অত্যন্ত স্নেহ করি এইটা বােধহয় তুমি জান না। আমার রাগ যেমন বেশি, স্নেহও বেশি। ফাজিল লােকজন রাগটা দেখে, স্নেহ দেখে না। তােমার মনটা খারাপ কেন ?
মন খারাপ না। বৌমা আবার কবে আসবে ?
সামনের সপ্তাহে আসার কথা। তার তাে ইউনিভার্সিটি খেলা। ইচ্ছা থাকলেও ইউনিভার্সিটি ফেলে আসতে পারে না।
চেয়ারম্যান সাহেব পিক মুছতে মুছতে বললেন, স্ত্রীদের ইউনিভার্সিটি হলাে তাদের স্বামী। এর বাইরে কোনাে ইউনিভার্সিটি নাই। বৌমাকে আসার জন্যে চিঠি দিয়ে দাও। এই বাংলা মাসের একুশ তারিখ ধলা গ্রামে আড়ং হবে—ড়ের লড়াই। শহরের মেয়ে এইসব তাে দেখে নাই। দেখলে মজা
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৪) হুমায়ূন আহমেদ
পাবে । আসতে বলে দাও ।
জ্বি আচ্ছা। ষাড়ের লড়াই তুমি দেখেছ ? জ্বি না ।
অতি মনােহর। এই বৎসর লড়াই–এ আমার নিজের ঘাড় আছে। ষাঁড়ের নাম জুম্মা খান । দেখি জুম্মা কী করে । সরবত খাও দিতে বলি।
জ্বি না সরবত খাব না।
খাও। খেলে ভালাে লাগবে। দুধ পেস্তাবাদাম দিয়ে বানানাে সরবত। বরফের কুচি দিয়ে ঠাণ্ডা করা। বরফ আনায়েছি নেত্রকোনা থেকে। বরফ অবশ্যি সরবত বানানাের জন্যে আনি নাই। আমি মাঝে মধ্যে সামান্য মদ্যপান করি।তার জন্যে বরফ লাগে। তুমি মদ্যপান কর ?
জ্বি না।
তােমার আগে যে ডাক্তার ছিল— সিদ্দিক নাম সে এই লাইনে ওস্তাদ লােক ছিল। পুরা এক বােতল একা খেয়েছে। তারপরেও কিছু হয় নাই। যাই হােক
সরবত খাও।
চেয়ারম্যান সাহেব গলা উঁচিয়ে ডাকলেন— সরবত আন।
সরবত মনে হলাে তৈরিই ছিল। চেয়ারম্যান সাহেবের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সরবতের গ্লাস নিয়ে ঘরে সতেরাে আঠারাে বছরের একটা মেয়ে ঢুকল। আনিস চমকে উঠল । গ্রাম ঘরে এমন রূপবতী মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না। ঠোট পর্যন্ত লাল। লিপিস্টিকের লাল না, পানের রসের লালও না।
এমিতেই লাল। যেন টোকা দিলেই রক্ত বের হবে।
চেয়ারম্যান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন— এর নাম হেনা । আমার দূর সম্পর্কের ভাইস্তি। অনাথ মেয়ে। পিতামাতা গত হয়েছে— থাকত মামার বাড়িতে। তারা খুবই অত্যাচার করত। শেষে আমার কাছে এনে রেখেছি। মেয়েটাকে ভালাে করে দেখ ডাক্তার।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৪) হুমায়ূন আহমেদ
আনিস অস্বস্তিতে পড়ে গেল। মেয়েটাকে ভালাে করে দেখার কী আছে সে বুঝতে পারছে না।
মেয়ে সুন্দর কি না বল ? জ্বি সুন্দর। ভালাে করে দেখেছ তাে ?
জ্বি।
সিনেমার কোনাে হিরুইন এই মেয়ের কাছে আনলে মনে হইব বান্দি। ঠিক বলেছি না ?
ডাক্তার চুপ করে রইল।
চেয়ারম্যান সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, এখন এই মেয়ের জন্যে শহর থেকে পাত্র জোগাড় করবা। তােমার অবিবাহিত বন্ধু বান্ধব আছে না ? তাদের চিঠি দিবা। সঙ্গে কন্যার ছবি দিয়া দিবা। ময়মনসিংহ শহরে নিয়া। স্টুডিওতে হেনার ছবি তুলিয়েছি। চেহারা যত সুন্দর ছবি তত সুন্দর হয় নাই। ছবি তােমার কাছে পাঠায়ে দিব।
হেনা মূর্তির মতাে দাঁড়িয়ে আছে। কী করবে বুঝতে পারছে না। তার ঠোট কাঁপছে, মনে হয় সে কেঁদে ফেলবে। জহির উদ্দিন খাঁ হেনার দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে মাছি তাড়াবার মতাে ভঙ্গি করে বললেন— যা এখন ঘরে যা।