বাংলা ঘরে প্রচুর লােক সমাগম হয়েছে এটা বুঝা যাচ্ছে। জুম্মাঘরের ইমাম সাহেবের সুরেলা গলা শােনা যাচ্ছে, মিলাদ হচ্ছে
বালেগাল উলা বে কামালিহি।
হাসানুদ্দোজা বে জামালিহি চেয়ারম্যান সাহেব আরেকটা পান মুখে দিতে দিতে তিক্ত গলায় বললেন– জুম্মঘরের ইমাম সাহেবের বিষয়ে একটা খুবই খারাপ কথা শুনেছি। সকাল বেলা তিনি দুধ খান। হাসানের ছেলে রােজ সকালে তারে এক পােয়া দুধ দিয়া আসে। ছেলেটার বয়স আট–নয়। গত সোমবারে সে দুধ নিয়া গেছে। ইমাম সাহেব তখন ছেলের হাত ধইরা দরজা লাগায়ে দিল... ঘটনা কি
টল বুঝতে পারছ ডাক্তার ?
আনিস কিছু বলল না। চুপ করে রইল । চেয়ারম্যান সাহেব পানের পিক মুছতে মুছতে বললেন— আমি সন্ধান নিতেছি ঘটনা যদি সত্যি হয় এই ইমামরে আমি নেংটা করাইয়া গ্রামের চারদিকে চক্কর দেওয়াব। এই অঞ্চলে খারাপ লােক আমি একলা থাকব আর কাউরে থাকতে দিব না। ডাক্তার যাও মিলাদে সামিল হও। আমি সামিল হতে পারব না। মদ্যপান করেছি। এই
অবস্থায় মিলাদে যােগ দেয়া যায় না।
ডাক্তার উঠে দাঁড়াল। চেয়ারম্যান সাহেব ইশারা করে আবার তাকে বসতে
বললেন।
ডাক্তার বসল। চেয়ারম্যান সাহেব সামান্য ঝুঁকে এসে বললেন— হেনার বিষয়ে আরাে কিছু কথা আছে। তােমারে পরে বলব।
জ্বি আচ্ছা। আমার কথাবার্তা কি তােমার কাছে আউলা লাগতেছে ? জ্বি না।
ঝড়ের সময় এমন ভয় পাইছি— আধা বােতল খেয়ে ফেলেছি। কাজেই কথা বার্তা আউলা । কিছু মনে নিবা না। আমি যে তােক খারাপ এই খবর কি
তুমি পেয়েছ ?
ডাক্তার চুপ করে রইল। নেশাগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলা সহজ। প্রশ্ন করলে জবাব দিলেও চলে, জবাব না দিলেও চলে। নেশাগ্রস্ত মানুষ নিজের কথাই শুনে। অন্যে কী বলছে, না বলছে তা তার মাথায় ঢােকে না।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৫) হুমায়ূন আহমেদ
আমি লােক খুবই খারাপ বুঝছ ডাক্তার। অত্যধিক খারাপ। এমন সুন্দরী এক মেয়ে নিজের কাছে এনে রেখেছি কেন? মেয়ের উপকারের জন্যে ? এইটা ভাববা না। যা বলার বলেছি এরচে‘ খােলাসা করে বলতে পারব না। তবে আমার মনে স্নেহ মমতা আছে। এই মেয়েরে আমি নিজ খরচায় বিবাহ দিব। গলা-কান–হাতের গয়না দিব।
ডাক্তার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। মাতাল মানুষ কথা বলতেই থাকবে। শেষ পর্যন্ত আলাপ কোন দিকে যাবে কে জানে। ইমাম সাহেব সম্পর্কে যে কথাগুলাে বলা হয়েছে তা মনে হয় মাতাল হবার কারণে বলা। কিছু কিছু মানুষকে দেখলেই মনে হয় মানুষটা ভালাে। ইমাম সাহেব সে রকম একজন। সরল মুখ, সরল কথাবার্তা। একবার আনিস রােগী দেখে ফিরছিল, ইমাম সাহেবের সঙ্গে দেখা হলাে। ইমাম সাহেব বিনয়ের সঙ্গে সালাম করে বললেন, ডাক্তার সাহেবের মনটা মনে হয় খারাপ। কী হয়েছে জনাব ?
আনিস বলল, একজন রােগী দেখে এসেছি। রােগীর অবস্থা ভালাে না। তাকে শহরে নিয়ে যেতে পারলে বাঁচানাের সম্ভাবনা ছিল। এখন সম্ভাবনা নাই বললেই হয়। মনটা এই কারণেই খারাপ।
ইমাম সাহেব বললেন, রােগীর নাম কী ? – আনিস বলল, নাম দিয়ে কী করবেন?
তার জন্যে খাস দিলে আল্লাহপাকের দরবারে দোয়া করব। আপনি রােগীর অবস্থা দেখে মন খারাপ করেছেন। দেখে কষ্ট পেয়েছি। আজ সারারাত ইবাদত বন্দেগী করে রােগীর জন্যে দোয়া করব।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৫) হুমায়ূন আহমেদ
রােগীর নাম সাদেক। পেটে আলসার আছে, পেট ফুটো হয়ে গেছে। রক্ত বমি করছে।
ডাক্তার সাব, আপনি মনটা ঠিক করেন। আমি আল্লাহপাকের দরবারে হাত উঠাইতেছি। সাদেক নামের সেই রােগী বেঁচে গিয়েছিল। আনিস ইমাম সাহেবকে খবরটা দেবার পর তিনি আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন। এই প্রকৃতির মানুষ বড় কোনাে অন্যায় করতে পারে না।
মতি আছে মর্জিনার ঘরে। তার ঘরটা ছােট। ঘর ভর্তি বিরাট এক চৌকি। চৌকিতে শীতল পাটি পাতা আছে। গৃহস্থালীর যাবতীয় সরঞ্জাম চৌকির নিচে চুকানাে। হাঁড়িপাতিল, বালতি, টিনের ট্রাঙ্ক, পানির কলসি। দর্শনীয় বস্তুর মধ্যে আছে দুটা ফুলতােলা ওয়ারের বালিশ। মর্জিনা ময়লা বালিশে ঘুমুতে পারে না । দুটা বালিশই পরিষ্কার ঝকঝক করছে। বালিশের ওয়ারে ফুল হাই তােলা। একটা ফুলের নিচে ইংরেজিতে লেখা MARZINA BEGUM,
চিকর্মে তার দক্ষতা আছে এটা বুঝা যায়। | মতি বালিশে আধশােয়া হয়ে আছে। তার হাতে বিড়ি। সে আয়েশ করে বিড়ি টানছে। মর্জিনা মেঝেতে পিড়ি পেতে খেতে বসেছে। সে যে খুব তৃপ্তি করে খাচ্ছে তা বুঝা যাচ্ছে। মতি বলল, পাখির সালুন কেমন হইছে কিছুতে বলা না।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৫) হুমায়ূন আহমেদ
মর্জিনা বলল, সালুন ভালাে হইছে। অতি ভালাে হইছে। ঝাল বেশি হইছে
স্তুক স্বাদ হইছে। আফনে ব্লানছেন ?
আফনে হইলেন গুণের নাগর। হি হি হি। ভাত খাওনের সময় হাসবা না গাে। খাওয়া হইল ইবাদত। ইবাদতের য় হাসাহাসি করা ঠিক না। আল্লাহপাক নারাজ হন।
আপনে কি আইজ রাইতে থাকবেন না চইল্যা যাবেন ? বুঝতাছি না। থাকতে পারি আবার চইল্যা যাইতে পারি।
থাকেন, গফসফ করি ।
চৌকির ওপর থেকে মর্জিনার মুখ পুরােপুরি দেখা যাচ্ছে না। সে বসেছে মতির দিকে পিঠ দিয়ে। কথা বলার সময় মাঝে মাঝে মতির দিকে তাকাচ্ছে তখনি তার মুখ দেখা যাচ্ছে। গােলগাল সুন্দর মুখ। বড় বড় চোখ। চোখ ভর্তি মায়া। বাজারের মেয়েদের চোখে মায়া থাকে না। এই মেয়ের চোখে এত মায়া কেন কে জানে ? মতি বড়ই উদাস বােধ করল। মেয়েদের মায়া ভর্তি চোখ সব সময় তাকে উদাস করে ফেলে। আল্লাহপাক এই কাজটা ঠিক করেন নাই। মেয়েছেলের চোখে এত মায়া দেওয়া ঠিক হয় নাই । কিছু মায়া পুরুষের চোখে। দেওয়া উচিত ছিল।
মর্জিনা বলল, আইজ যে পাখির সালুন দিয়া ভাত খাব চিন্তাই করি। নাই। ঘরে কিছুই ছিল না। ঠিক কইরা রাখছি শুকনা মরিচের ভর্তা দিয়া ভাত খাব।
মতি বলল, রিজিক আল্লাপাকের ঠিক করা। আল্লীপাক ঠিক করেছেন তুমি আইজ পাখির সালুন দিয়া ভাত খাইবা । এইখানে তােমার আমার কিছুই করার নাই। পাখির সালুন সংসদে পাস হইয়া আছে।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৫) হুমায়ূন আহমেদ
তাও ঠিক।
মতি আধশােয়া অবস্থা থেকে উঠে বসল। উৎসাহের সঙ্গে বলল, ঘটনাটা চিন্তা কর— আল্লাহপাকের তরফ থাইক্যা তােমার রিজিক পাস হইছে— ডাহুক
পাখির সালুন দিয়া ভাত। ঠিক কি না?
রিজিক পাস হইছে বইল্যাইতাে আর পাখির সালুনের বাটি আসমান থাইক্যা নাইম্যা তােমার কোলে পড়ব না ? অন্য ব্যবস্থা লাগব। ঠিক কি না চিন্তা কইরা বল।
হু ঠিক।