তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৫) হুমায়ূন আহমেদ

বাংলা ঘরে প্রচুর লােক সমাগম হয়েছে এটা বুঝা যাচ্ছেজুম্মাঘরের ইমাম সাহেবের সুরেলা গলা শােনা যাচ্ছে, মিলাদ হচ্ছে 

বালেগাল উলা বে কামালিহি।

তেঁতুল বনে জোছনা 

হাসানুদ্দোজা বে জামালিহি চেয়ারম্যান সাহেব আরেকটা পান মুখে দিতে দিতে তিক্ত গলায় বললেনজুম্মঘরের ইমাম সাহেবের বিষয়ে একটা খুবই খারাপ কথা শুনেছিসকাল বেলা তিনি দুধ খানহাসানের ছেলে রােজ সকালে তারে এক পােয়া দুধ দিয়া আসেছেলেটার বয়স আটনয়গত সোমবারে সে দুধ নিয়া গেছেইমাম সাহেব তখন ছেলের হাত ধইরা দরজা লাগায়ে দিল... ঘটনা কি 

টল বুঝতে পারছ ডাক্তার

আনিস কিছু বলল নাচুপ করে রইল চেয়ারম্যান সাহেব পানের পিক মুছতে মুছতে বললেনআমি সন্ধান নিতেছি ঘটনা যদি সত্যি হয় এই ইমামরে আমি নেংটা করাইয়া গ্রামের চারদিকে চক্কর দেওয়াবএই অঞ্চলে খারাপ লােক আমি একলা থাকব আর কাউরে থাকতে দিব নাডাক্তার যাও মিলাদে সামিল হওআমি সামিল হতে পারব নামদ্যপান করেছিএই 

অবস্থায় মিলাদে যােগ দেয়া যায় না। 

ডাক্তার উঠে দাঁড়ালচেয়ারম্যান সাহেব ইশারা করে আবার তাকে বসতে 

বললেন। 

ডাক্তার বসলচেয়ারম্যান সাহেব সামান্য ঝুঁকে এসে বললেনহেনার বিষয়ে আরাে কিছু কথা আছেতােমারে পরে বলব। 

জ্বি আচ্ছাআমার কথাবার্তা কি তােমার কাছে আউলা লাগতেছে ? জ্বি না। 

ঝড়ের সময় এমন ভয় পাইছিআধা বােতল খেয়ে ফেলেছিকাজেই কথা বার্তা আউলা কিছু মনে নিবা নাআমি যে তােক খারাপ এই খবর কি 

তুমি পেয়েছ

ডাক্তার চুপ করে রইলনেশাগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলা সহজপ্রশ্ন করলে জবাব দিলেও চলে, জবাব না দিলেও চলেনেশাগ্রস্ত মানুষ নিজের কথাই শুনেঅন্যে কী বলছে, না বলছে তা তার মাথায় ঢােকে না। 

তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৫) হুমায়ূন আহমেদ

আমি লােক খুবই খারাপ বুঝছ ডাক্তারঅত্যধিক খারাপএমন সুন্দরী এক মেয়ে নিজের কাছে এনে রেখেছি কেন? মেয়ের উপকারের জন্যে ? এইটা ভাববা নাযা বলার বলেছি এরচেখােলাসা করে বলতে পারব নাতবে আমার মনে স্নেহ মমতা আছেএই মেয়েরে আমি নিজ খরচায় বিবাহ দিবগলা-কানহাতের গয়না দিব। 

ডাক্তার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললমাতাল মানুষ কথা বলতেই থাকবেশেষ পর্যন্ত আলাপ কোন দিকে যাবে কে জানেইমাম সাহেব সম্পর্কে যে কথাগুলাে বলা হয়েছে তা মনে হয় মাতাল হবার কারণে বলাকিছু কিছু মানুষকে দেখলেই মনে হয় মানুষটা ভালােইমাম সাহেব সে রকম একজনসরল মুখ, সরল কথাবার্তাএকবার আনিস রােগী দেখে ফিরছিল, ইমাম সাহেবের সঙ্গে দেখা হলােইমাম সাহেব বিনয়ের সঙ্গে সালাম করে বললেন, ডাক্তার সাহেবের মনটা মনে হয় খারাপকী হয়েছে জনাব

আনিস বলল, একজন রােগী দেখে এসেছিরােগীর অবস্থা ভালাে নাতাকে শহরে নিয়ে যেতে পারলে বাঁচানাের সম্ভাবনা ছিলএখন সম্ভাবনা নাই বললেই হয়মনটা এই কারণেই খারাপ। 

ইমাম সাহেব বললেন, রােগীর নাম কী ? আনিস বলল, নাম দিয়ে কী করবেন

তার জন্যে খাস দিলে আল্লাহপাকের দরবারে দোয়া করবআপনি রােগীর অবস্থা দেখে মন খারাপ করেছেনদেখে কষ্ট পেয়েছিআজ সারারাত বাদত বন্দেগী করে রােগীর জন্যে দোয়া করব। 

তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৫) হুমায়ূন আহমেদ

রােগীর নাম সাদেক। পেটে আলসার আছে, পেট ফুটো হয়ে গেছেরক্ত বমি করছে। 

ডাক্তার সাব, আপনি মনটা ঠিক করেনআমি আল্লাহপাকের দরবারে হাত উঠাইতেছি। সাদেক নামের সেই রােগী বেঁচে গিয়েছিলআনিস ইমাম সাহেবকে খবরটা দেবার পর তিনি আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেনএই প্রকৃতির মানুষ বড় কোনাে অন্যায় করতে পারে না। 

মতি আছে মর্জিনার ঘরেতার ঘরটা ছােটঘর ভর্তি বিরাট এক চৌকিচৌকিতে শীতল পাটি পাতা আছেগৃহস্থালীর যাবতীয় সরঞ্জাম চৌকির নিচে চুকানােহাঁড়িপাতিল, বালতি, টিনের ট্রাঙ্ক, পানির কলসিদর্শনীয় বস্তুর মধ্যে আছে দুটা ফুলতােলা ওয়ারের বালিশমর্জিনা ময়লা বালিশে ঘুমুতে পারে না দুটা বালিশই পরিষ্কার ঝকঝক করছেবালিশের ওয়ারে ফুল হাই তােলাএকটা ফুলের নিচে ইংরেজিতে লেখা MARZINA BEGUM

চিকর্মে তার দক্ষতা আছে এটা বুঝা যায়| মতি বালিশে আধশােয়া হয়ে আছেতার হাতে বিড়িসে আয়েশ করে বিড়ি টানছেমর্জিনা মেঝেতে পিড়ি পেতে খেতে বসেছেসে যে খুব তৃপ্তি করে খাচ্ছে তা বুঝা যাচ্ছেমতি বলল, পাখির সালুন কেমন হইছে কিছুতে বলা না। 

তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৫) হুমায়ূন আহমেদ

মর্জিনা বলল, সালুন ভালাে হইছেঅতি ভালাে হইছেঝাল বেশি হইছে 

স্তুক স্বাদ হইছেআফনে ব্লানছেন ? 

আফনে হইলেন গুণের নাগরহি হি হিভাত খাওনের সময় হাসবা না গােখাওয়া হইল ইবাদতইবাদতের য় হাসাহাসি করা ঠিক নাআল্লাহপাক নারাজ হন। 

আপনে কি আইজ রাইতে থাকবেন না চইল্যা যাবেন ? বুঝতাছি নাথাকতে পারি আবার চইল্যা যাইতে পারি। 

থাকেন, গফসফ করি । 

চৌকির ওপর থেকে মর্জিনার মুখ পুরােপুরি দেখা যাচ্ছে নাসে বসেছে মতির দিকে পিঠ দিয়েকথা বলার সময় মাঝে মাঝে মতির দিকে তাকাচ্ছে তখনি তার মুখ দেখা যাচ্ছেগােলগাল সুন্দর মুখবড় বড় চোখচোখ ভর্তি মায়াবাজারের মেয়েদের চোখে মায়া থাকে নাএই মেয়ের চোখে এত মায়া কেন কে জানে ? মতি বড়ই উদাস বােধ করলমেয়েদের মায়া ভর্তি চোখ সব সময় তাকে উদাস করে ফেলেআল্লাহপাক এই কাজটা ঠিক করেন নাইমেয়েছেলের চোখে এত মায়া দেওয়া ঠিক হয় নাই কিছু মায়া পুরুষের চোখেদেওয়া উচিত ছিল। 

মর্জিনা বলল, আইজ যে পাখির সালুন দিয়া ভাত খাব চিন্তাই করিনাইঘরে কিছুই ছিল নাঠিক কইরা রাখছি শুকনা মরিচের ভর্তা দিয়া ভাত খাব। 

মতি বলল, রিজিক আল্লাপাকের ঠিক করাআল্লীপাক ঠিক করেছেন তুমি আইজ পাখির সালুন দিয়া ভাত খাইবা এইখানে তােমার আমার কিছুই করার নাইপাখির সালুন সংসদে পাস হইয়া আছে। 

তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৫) হুমায়ূন আহমেদ

তাও ঠিক। 

মতি আধশােয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলউৎসাহের সঙ্গে বলল, ঘটনাটা চিন্তা করআল্লাহপাকের তরফ থাইক্যা তােমার রিজিক পাস হইছেডাহুক 

পাখির সালুন দিয়া ভাতঠিক কি না

রিজিক পাস হইছে বইল্যাইতাে আর পাখির সালুনের বাটি আসমান থাইক্যা নাইম্যা তােমার কোলে পড়ব না ? অন্য ব্যবস্থা লাগবঠিক কি না চিন্তা কইরা বল। 

হু ঠিক। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *