কাজেই আল্লাপাক একটা ঝড়ের ব্যবস্থা করল— বাড়ি ঘর উল্টাইল, মানুষের বিরাট ক্ষতি হইল, পশু পাখি মরল— ডাহুক পাখি মরল বইল্যা তুমি ডাহুক পাখির সালুন পাইলা। এখন ঘটনা চিন্তা কর তােমারে খাওয়ানির জন্যে আল্লাপাকরে কী যন্ত্রণা করন লাগল। যা বললাম এর মধ্যে জটিল চিন্তার বিষয় আছে। মাথা ঠাণ্ডা কইরা চিন্তা কর।
নিজের যুক্তিতে মতি নিজেই মুগ্ধ। তার চোখ চকচক করছে। নিজেকে খুবই জ্ঞানী মনে হচ্ছে। মর্জিনা খাওয়া বন্ধ করে এক দৃষ্টিতে মতির দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে যুক্তির এই দিকটা তাকেও স্পর্শ করেছে।
মতি বলল, কী চিন্তা করতেছ?
মর্জিনা থমথমে গলায় বলল, আপনে আমারে মরা পাখির গােশত খাওয়াইছেন ? ঝড়ে পাখি মরছে, হেই পাখি রাইন্ধা নিয়া আসছেন ?
রাগে মর্জিনার শরীর কাঁপছে। ব্যাপারটা যে উল্টো দিকে যেতে পারে এটা। তির কল্পনাতেও আসে নি। সে হড়বড় করে বলল, আরে কী কও তুমি! জুম্মা ঘরের মওলানা সাবরে জিজ্ঞাস কইরা আসছি। ঝড় তুফানে মরা পাখির মাংস পাওয়া জায়েজ আছে। হাদিসের বইয়ে পরিষ্কার লেখা। তুমিতাে লেখা পড়া জান না। লেখা পড়া জানলে তােমারে বই আইন্যা দেখাইতাম। তবে বজ্রপাতে মরা পশুপাখির মাংস খাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৬) হুমায়ূন আহমেদ
মর্জিনা ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় চলে গেছে। সে গলায় আঙুল দিয়ে বমি করার চেষ্টা করছে। লক্ষণ মােটেই ভালাে না। মতিকে দ্রুত সরে পড়া পকার।
আজ রাতটা এখানে থাকতে পারলে ভালাে হতাে। ডাক্তার সাহেবের সাইকেল সে চুরি করে নিয়ে এসেছে। ভােরবেলা সাইকেলের একটা গতি করা যেত। চুরি করে আনা গরু সামলানাে যেমন মুশকিল, সাইকেল সামলানাে ঠিক সে রকমই মুশকিল। একবার গরু চুরি করে সে এমন বিপদে পড়েছিল। রাখার জায়গা নাই। শেষে খােয়াড়ে জমা দিয়ে কুড়ি টাকা পেয়েছে। লাভের মধ্যে লাভ কুড়ি টাকা। তার দিনটা ভালােমতাে যাচ্ছিল শেষের দিকে এসে সব কেমন এলােমেলাে হয়ে গেল।
মর্জিনা বারান্দা থেকে গজগজ করছে– তুই আমারে মরা পাখির গােশত খাওয়াইছস, তােরে আমি যদি গু না খাওয়াই তাইলে আমি সতী মায়ের কন্যা।
আমি বেজন্মা। তরকারির চামুচ দিয়া তরে আমি এক চামুচ কাচা ও খাওয়ামু। তুই আমারে অখনাে চিনস নাই।
মতি ঘর থেকে বের হয়ে পড়ল। আর থাকা ঠিক না। তার মনটা খুবই থাপ হয়েছে। মর্জিনা তুই তােকারি করছে। ভালােবাসার মানুষকে আদর করে তুই তােকারি করা যায় তাতে দোষ হয় না, কিন্তু গালাগালি করে তুই
তােকারি করা যায় না। মরা পাখির গােশত খেয়েছে তাে কী হয়েছে। জ্যান্তপাখির গােশত কেউ কোনাে দিন খেয়েছে ? হারামজাদি মরা পাখি শুধু দেখল। মরা পাখির পিছনের ভালােবাসাটা দেখল না ?
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৬) হুমায়ূন আহমেদ
নবনীর ঘুম ভাঙ্গে সকাল দশটায়।
সপ্তাহে দু‘দিন, মঙ্গলবার এবং বৃহস্পতিবারে তার ক্লাস থাকে ন’টায়। এই দু‘দিন ঘড়িতে এলার্ম দেয়া থাকে। যথাসময়ে এ্যালার্ম বাজে। ঘুমের ঘােরে নবনী হাত বাড়িয়ে ঘড়ি হাতে নেয়। এ্যালার্ম বন্ধ করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। অ্যালার্মের পর তার ঘুম গাঢ় হয়। খুব শান্তি শান্তি লাগে। তার ঘুম ভাঙ্গে যথারীতি সকাল দশটায়। ক্লাস করা হয় নি এ নিয়ে তাকে মােটেও চিন্তিত মনে হয় না। দরজা খুলে সে বের হয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলে, আমার চা কোথায় ? বলেই সে আবার নিজের ঘরে ঢুকে বিছানায় এলিয়ে পড়ে। বড় কাপ ভর্তি চা আসবে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে আস্তে আস্তে ঘুম কাটাবে। তারপর আসবে দাঁত ব্রাস করার প্রশ্ন। হাত মুখ ধােয়ার প্রশ্ন।
আজ বৃহস্পতিবার সকালের ক্লাস মিস হয়েছে। একটা টিউটোরিয়েল ক্লাস আছে দুপুর দু’টায় । এডগার এলেন পেপার কবিতা নিয়ে আলােচনা।
It was many and many a years ago In a Kingdom by the sea, That a maiden there lived whom you may know By the name of Annabel Lee; And this maiden she lived with no other thought
Than to love and be loved by me. আচ্ছা এই কবিতাটার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতা একই গাঁয়ের খুব মিল আছে না?
আমার নাম তাে জানে গাঁয়ের পাঁচজনে
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা । এডগার এলান পাের এনাবেল লীই কি রবীন্দ্রনাথের রঞ্জনা ? স্যারকে এই প্রশ্ন করলে কেমন হয় ? স্যার কি খুব রেগে যাবেন ? স্যার
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৬) হুমায়ূন আহমেদ
আবার অস্বাভাবিক রবীন্দ্রভক্ত। ইংরেজির অধ্যাপকরা রবীন্দ্রভক্ত হন না। শহীদ স্যার রবীন্দ্রভক্ত। শহীদ স্যারের ক্লাসটা না করলে আজ ছুটি। শুক্র শনি এম্নিতেই ছুটি। তিনদিনের ছুটি। নবনী চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে, দ্রুত চিন্তা করছে দুপুরের ক্লাসটা করবে কী করবে না। মন স্থির করতে পারছে না। ক্লাস করাটা জরুরি আবার পরপর তিনদিনের ছুটিটাও জরুরি। কোন জরুরিটা বেশি জরুরি?
নবনীর শীত লাগছে । সারারাত এসি চলেছে। ঘর এখন ডীপ ফ্রীজের মতাে ঠাণ্ড। ভােররাতে শীতে কাঁপতে কাঁপতে একবার ঘুম ভেঙ্গেছে। সে হাত বাড়িয়ে এসি বন্ধ করার রিমােট কনট্রোল খুঁজেছে। পাওয়া যায় নি। বিছানা থেকে নেমে এসির রিমােট কনট্রোল খোজার কোনাে মানে হয় না। সে কুঁকড়ি মুকড়ি দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। কাল শেষ রাতে নবনীর মনে হয়েছে সে এই পৃথিবীতে আগে আগে এসে পড়েছে। আরাে বিশ পঁচিশ বছর পর তার জন্ম হলে যন্ত্রণা কম হতাে। তখন বিজ্ঞান আরাে অনেকদূর এগিয়ে যেত। ঘর বেশি ঠাণ্ডা হয়ে গেলে হাত বাড়িয়ে রিমােট কনট্রোল খুঁজতে হত না। সে মুখে বলবে–– এসি বন্ধ।
ওমি এসি বন্ধ।
টিভির চ্যানেল বদলাবার জন্যে বােতাম টিপাটিপি করতে হবে না। মুখে বললেই হবে— চ্যানেল নাম্বার সেভেন, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি। গুন্নি চ্যানেল বদলে যাবে। শুরু হয়ে যাবে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির চ্যানেল।
তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৬) হুমায়ূন আহমেদ
রাতে শােবার সময় নবনী সবকিছু হাতের কাছে নিয়ে ঘুমায়। এক বােতল পানি, এসির রিমােট কনট্রোল, টিভির রিমােট কনট্রোল, পছন্দের একটা গল্পের বই এবং একটা খাতা–কলম। বিশেষ ধরনের কলম, লেখার সময় কলম থেকে। আলাে বের হয়। সেই আলােয় রাতেও লেখা যায়। খাতাটা সে রেখেছে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গলে স্বপ্নটা সঙ্গে সঙ্গে লিখে ফেলার জন্য। কারণ দিনের বেলায় রাতের কোনাে স্বপ্নই তার মনে থাকে না। ইদানীং প্রতি রাতেই নবনী ভয়ঙ্কর সব স্বপ্ন দেখছে। নবনীর দূরসম্পর্কের এক চাচা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাইকিয়াট্রির প্রফেসর । তিনি তাকে শােবার সময় খাতা–কলম নিয়ে শুতে বলেছেন। নবনীর চিকিৎসা করার সময় তার স্বপ্নগুলাে জানা না–কি বিশেষ প্রয়ােজন।
গত রাতে কোনাে স্বপ্ন দেখেছে কি-না নবনী মনে করতে পারল না। শেষ রাতে একবার যখন ঘুম ভেঙ্গেছে তাহলে ধরে নেয়া যায় স্বপ্ন দেখেই ঘুম
ভঙ্গেছে। নবনী হাত বাড়িয়ে খাতাটা নিল। পাতা উল্টাল। হ্যা, স্বপ্ন দেখেছে। সেটা গােটা করে স্বপ্ন লেখা আছে।