এমিতে নবনীর হাতের লেখা জড়ানাে কিন্তু আধাে ঘুম আধাে তন্দ্রার সময়ের হাতের লেখা বেশ পরিষ্কার। নবনী লিখেছে—
স্বপ্নে দেখলাম পানির ওপর দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি। পানি বরফ শীতল। যতই সামনের দিকে এগুচ্ছি ততই পানি বাড়ছে। মনে হচ্ছে আমি গভীর পানির দিকে যাচ্ছি। দৌড়ানাে বন্ধ করে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। যে দিকে দৌড়াচ্ছিলাম তার উল্টোদিকে দৌড়াতে শুরু করলাম । সেদিকেও পানি বাড়ছে। আমি ক্রমাগত গভীর পানির দিকে যাচ্ছি। আবারাে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
আমার চারদিকে হিম শীতল পানি। দিগন্তরেখা বলে কিছু নেই। আমি দাঁড়িয়ে আছি এক দিকচিহ্নহীন সমুদ্রের মাঝখানে। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানটা গভীর না। পানি আমার কোমর পর্যন্ত। কিন্তু যে দিকে যাওয়া যায়— গভীরতা বাড়ে। হঠাৎ শোঁ শোঁ শব্দ হওয়া শুরু হলাে। আমার চারদিক থেকে উঁচু হয়ে পানি আসছে। যে–কোনাে মুহূর্তে আমাকে ডুবিয়ে
দেবে। ঘুম ভেঙ্গে গেল। নবনী ছােট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। স্বপ্নটা রাতে যত ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছিল আসলে তত ভয়ঙ্কর না। এই স্বপ্ন দেখার পেছনে কারণ আছে। সে স্বপ্নে দেখেছে হিম শীতল পানি। এর কারণ ঘর এসির জন্যে খুব ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। সে শীতে কাঁপছিল। এক্সটার্নেল স্টিমুলাই স্বপ্ন তৈরি করেছে। চারদিক থেকে পানি এসে তাকে গ্রাস করছে— এর পেছনেও কারণ আছে। ঘুমুতে যাবার আগে সে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির চ্যানেল দেখছিল।
দক্ষিণমেরু নিয়ে প্রােগ্রাম। দক্ষিণমেরুতে পানি পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা এই নিয়ে মহা চিন্তিত। দক্ষিণমেরুতে পানি পাওয়ার কথা না। তাহলে কি বরফ গলতে শুরু করেছে ? দি দক্ষিণ মেরুর বরফ গলে যায় তাহলে পুরাে পৃথিবী চব্বিশ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যাবে। এ রকম ভয়ঙ্কর প্রতিবেদন দেখে ঘুমুতে গেলে রাতে পানিতে ডুবে যাবার স্বপ্ন দেখাইতাে স্বাভাবিক।
স্বপ্নের খাতায় কিছু ফুটনােট লিখে রাখা কি দরকার ? স্বপ্ন প্রসঙ্গে তার
- জের ব্যাখ্যাও থাকল। এই ব্যাখ্যা সাইকিয়াট্রিস্ট সাহেবের কাজে লাগলেও ফাগতে পারে। যে সাইকিয়াট্রিস্ট নবনীকে দেখছেন তার নাম এ, কে, হােসেইন। আইনস্টাইনের চেহারার সঙ্গে ভদ্রলােকের চেহারার খুব মিল আছে। মাথাভর্তি
ধবধবে সাদা চুল। আইনস্টাইনের গোঁফ ছিল, ভদ্রলােকের গোঁফ নেই। সাইকিয়াট্রিস্টরা উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করেন এই রকম কথা শােনা যায়। এই
দ্রলােকের বেলায় সে রকম মনে হয় না। ভদ্রলােকের প্রশ্নগুলাে সুন্দর তবে প্রশ্নের ধরন দেখে বুঝা যায় দ্রলােক কিছু না জেনেই নবনীর দুঃস্বপ্নের একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন। প্রশ্নগুলাে করা হচ্ছে সেদিক থেকে। নবনীর ধারণা প্রফেসর এ. কে. হােসাইন মােটামুটি নিশ্চিত, যে ডাক্তার ছেলের সঙ্গে নবনীর বিয়ে হয়েছে তার সঙ্গে বনিবানা হচ্ছে না।
নবনী দুঃস্বপ্নগুলাে এই কারণে দেখছে। সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলােক প্রশ্ন করার সময় চোখ বন্ধ করে প্রশ্ন করেন। এটা নবনীর কাছে খুব অস্বস্তিকর মনে হয়। কয়েকবার সে ভেবেছে সেও জবাব দেবার সময় চোখ বন্ধ করে রাখবে। দু’জন কথা বলছে, দু‘জনেরই চোখ বন্ধ মজার ব্যাপার।
আচ্ছা মা নবনী, দুঃস্বপ্নগুলাে কি তুমি বিয়ের আগেও দেখতে ? মাঝে মাঝে দেখতাম। বিয়ের পর বেশি দেখছ তাই না ?
প্রায় রােজ রাতেই দেখছ ?
তােমার ডাক্তার হাসবেন্ড আনিসও তাে শুনেছি গ্রামের দিকে কোথায় কাজ করছে।
ঠিকই শুনেছেন চাচা।
তুমি ওর সঙ্গে থাকছ না? কীভাবে থাকব ইউনিভার্সিটি তাে খােলা। ওর কাছে যাও না? একবার গিয়েছি, গত মাসের এগারাে তারিখ । তিন দিন ছিলাম। তখনাে কি দুঃস্বপ্ন দেখেছ ?
কী দেখেছ মনে আছে?
একটা শুধু মনে আছে। বাড়িতে আগুন লেগে গেছে। আমরা বের হতে পারছি না, কারণ দরজা খুঁজে পাচ্ছি না।
কাঠের বাড়ি, না দালান ?
মনে নেই। আগুনের সঙ্গে প্রচুর ধোয়া ছিল না কি শুধুই আগুন ? তাও মনে নেই।
সেই স্বপ্নে তুমি একা ছিলে, না–কি তােমার সঙ্গে তােমার হাসবেন্ডও ছিল ?
মনে নেই চাচা। আমার স্বপ্ন মনে থাকে না। রাতে যা দেখি সকালবেলা ভুলে যাই।
তাহলে এই স্বপ্নটা মনে আছে কীভাবে ? কিছু কিছু স্বপ্ন মনে থাকে। তােমার শ্বশুরবাড়ি তাে ঢাকাতেই, তাই না?
শ্বশুরবাড়ি ঢাকায় না, তবে আমার শ্বশুর শাশুড়ি ঢাকায় থাকেন। কলাবাগানের একটা ফ্ল্যাটে।
তুমি তাদের সঙ্গে থাক না ? জি না। মাঝে মাঝে দেখা করতে যাই কিন্তু থাকি না। থাক না কেন ? | নিজের ঘর ছাড়া আমার ঘুম হয় না। তাছাড়া ওদের বাড়িতে এসি নেই । আমার খুব একটা খারাপ অভ্যাস হয়েছে। রাতে ঘুমুতে যাবার সময় এসি লাগে। শীতের সময়ও আমি এসি ছেড়ে রাখি। ডাবল লেপ গায়ে দিয়ে ঘুমাই।
শ্বশুর শাশুড়ি তােমার কেমন লাগে ? মােটামুটি লাগে। খারাপও না, আবার ভালােও না। এই দুজনের মধ্যে কাকে তােমার বেশি অপছন্দ ? আমার শ্বশুরকে । উনি বেশি কথা বলেন। উনি কাউকে কথা বলতে দেবেন । নিজে কথা বলবেন। অন্য কেউ কথা বললে তিনি কেমন জানি বিরক্ত হন। ভ্রু কুঁচকে তাকান।
কী নিয়ে কথা বলেন ? | বেশির ভাগ সময় হােমিওপ্যাথি নিয়ে। রিটায়ার করার পর হােমিওপ্যাথির বই পড়ছেন তাে। হােমিওপ্যাথি মাথার ভেতর ঢুকে গেছে।
চিকিৎসা করছেন ?
নিজের আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে করছেন। আমি যে ক’বার তার কাছে গিয়েছি তিনি জোর করে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছেন।
কী ওষুধ ?
ইপিকাক। আপনি যদি কিছুক্ষণ তার সামনে থাকেন তাহলে আপনাকেও হয়তাে কোনাে ওষুধ খাইয়ে দেবেন।
তুমি যে সব দুঃস্বপ্ন দেখ তার মধ্যে তােমার শ্বশুরকে কখনাে দেখেছ ? মনে নেই চাচা।
মা শােন, মাথার কাছে সব সময় একটা খাতা রাখবে আর কলম রাখবে। খাতাটা হলাে স্বপ্ন–খাতা। স্বপ্ন দেখে যদি ঘুম ভেঙ্গে যায় সঙ্গে সঙ্গে খুব গুছিয়ে স্বপ্নটা লিখে ফেলবে। অবশ্যই তারিখ দেখে। সময় লিখে রাখবে। আপাতত ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি – ডরমিকাম। সাইড এফেক্ট নেই বললেই হয়। বিছানায় যাবার আধঘণ্টা আগে একটা ডরমিকাম খাবে।
চাচা আমারতাে ঘুমের কোনাে সমস্যা নেই, বিছানায় যাওয়া মাত্র আমার ঘুম পায়। ঘুমের ওষুধ খাব কেন ?
ঘুমের ওষুধটা খাবে যাতে সাউন্ড স্লীপ হয়। ঘুম গাঢ় হলে দুঃস্বপ্ন দেখবে না।
দুঃস্বপ্ন না দেখলে স্বপ্নের খাতায় দুঃস্বপ্নগুলাে লিখব কীভাবে ? আমার সমস্যাটা কী তা বুঝার জন্যেই তাে স্বপ্নগুলাের বিষয়ে আপনার জানা দরকার।
নবনীর কথায় প্রফেসার এ. কে. হােসাইন এমনভাবে বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকালেন যে নবনীর হাসি পেয়ে গেল। সে হাসি চাপা দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, চাচা আপনি ভুরু টুরু কুঁচকে ফেলেছেন কেন? আপনি কি আমার কথায় বিরক্ত হয়েছেন ?
সামান্য হয়েছি। কেউ যখন তুচ্ছ কথা নিয়ে পেঁচায় আমার ভালাে লাগে । তােমার মধ্যে এই অভ্যাসটা আছে।
নবনী আগের চেয়েও গম্ভীর গলায় বলল, চাচা আপনার মেজাজ খিটখিটেতাে, এই জনেই আমার কথা পেঁচানাে মনে হচ্ছে। আমি মােটেও পেঁচানাে কথা বলছি না। আপনার নাক্সভূমিকা খাওয়া উচিত। খিটখিটে মেজাজের মানুষদের প্রধান ওষুধ হলো নাক্সভূমিকা। দুইশ পাওয়ারের নাক্সভূমিকা সকালে চারটা আর রাতে চারটা করে খাবেন। এই ওষুধ আমি শিখেছি আমার শ্বশুরের কাছ থেকে । আপনি বললে আমি আমার শ্বশুরের কাছ
থেকে ওষুধ এনে দেব।
ভদ্রলােক কিছু বললেন না। স্থির চোখে নবনীর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সেদিন তাঁর দৃষ্টি দেখে নবনীর মনে হয়েছিল নবনীর মতাে রােগী তিনি খুব বেশি দেখেন নি। দেখার ব্যাপারে তার উৎসাহও নেই।
ভারী গম্ভীর গলায় কে যেন ডাকল, নবনী!