নবনী – কুচকাল। গলাটা কার চিনতে পারল না। এ বাড়িতে এ রকম গম্ভীর গলাতাে কারাে নাই। তারপর মনে হলাে এটা তার বাবার গলা।
খুব চেনা মানুষকে মাঝে মাঝে যেমন অচেনা মনে হয়, দীর্ঘদিনের পরিচিত গলাও হঠাৎ হঠাৎ খুবই অপরিচিত লাগে। বিস্মিত হয়ে ভাবতে হয় কে কথা বলছে ।
নবনীর বাবা ফরহাদ সাহেব সকাল নটার মধ্যে বের হয়ে যান। তাঁর কোনাে ছুটি ছাটা নেই। সপ্তাহের যে দু‘দিন অফিস বন্ধ সে দুদিন তিনি যান কারখানায়। তাঁর দু’টা সুতার কারখানা আছে।
গাজীপুরে জাপানি কোলাবরেশনে চিনামাটির কারখানা দিচ্ছেন। প্রডাক্টের নাম হবে নবনী। আজ বের হন নি তার মানে কোনাে সমস্যা আছে। নবনীর সমস্যা ভালাে লাগে না। নিজের সমস্যা তাে ভালাে লাগেই না। আশেপাশের মানুষদের সমস্যাও ভালাে লাগে না। সে চায়ের কাপ হাতে শােবার ঘর থেকে বের হলাে। এই কাজটা করতেও তার ভালাে লাগছে না। দিনের প্রথম চা সে আরাম করে নিজের ঘরে বসে খেতে ভালােবাসে। দিনের প্রথম অংশ এবং দিন শেষের অংশটি তার নিজের। বাকি অংশগুলাে অন্যরা ভাগাভাগি করে নিক।
ফরহাদ সাহেব মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছেন। তার খালি গা, পরনে লুঙ্গি। গৌর বর্ণের মানুষ। মাথা ভর্তি ধবধবে সাদা চুল। তিনি অত্যন্ত মিষ্টভাষি, কারাে সঙ্গেই উঁচুগলায় কথা বলেন না; তারপরেও তাকে মনে হয় দূরের মানুষ। কাছের কেউ না। ফরহাদ সাহেবের সামনে খবরের কাগজ বিছানাে। নবনীকে দেখে তিনি হাসি মুখে বললেন, তাের বয়েসী একটা মেয়ে সকাল দশটা পর্যন্ত কী করে ঘুমায় আমিতাে ভেবেই পাই না।
নবনী গম্ভীর গলায় বলল, তুমি যেমন আমার ব্যাপারটা ভেবে পাও না, আমিও ভেবে পাই না তুমি কী করে দিনের পর দিন ভাের পাঁচটায় উঠ। তােমার বয়েসী মানুষদের মধ্যে আলস্য থাকবে। ভােরবেলায় ঘুম ভেঙে গেলেও কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করবে। ঘুম ভাঙা মাত্র লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামবে না। | ফরহাদ সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, অভ্যাস করলেই হয়। চার পাঁচ দিন চেষ্টা করলেই দেখবি ভাের পাঁচটায় ঘুম ভাঙ্গার অভ্যাস হয়ে যাবে।
এরকম বিশ্রী অভ্যাস করার দরকার কী ?
ভােরবেলায় ঘুম ভাঙ্গা বিশ্রী অভ্যাস ?
অবশ্যই বিশ্রী অভ্যাস। শরীরকে আরাম দিতে হয় বাবা। শরীরকে কষ্ট দেবার মানে কী ? শরীরকে কষ্ট দেবার মানে হলাে, শরীরের ভেতর যে আত্মা বাস করে তাকে কষ্ট দেয়া।
ফরহাদ সাহেব হাসি মুখে বললেন, ভুল লজিকে তাের মাথাটা ভর্তি। তাের যেটা করা উচিত সেটা হচ্ছে একটা চিমটা দিয়ে তাের মাথা থেকে এক এক করে ভুল লজিক বের করে ফেলা।
নবনী বাবার পাশে বসতে বসতে বলল, তুমি আজ অফিসে যাবে না? ফরহাদ সাহেব বললেন, না। যাবে না কেন? শরীর খারাপ ?
শরীর ঠিকই আছে। যে মানুষ ভাের পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে তার শরীর এত সহজে খারাপ হয় না । তুই কি মুখ না ধুয়েই চা খাচ্ছিস ?
তােকে দেখেইতাে মা আমার কেমন ঘেন্না ঘেন্না লাগছে। কিছু করার নেই বাবা, আমি এ রকমই।
ফরহাদ সাহেব আগ্রহ নিয়ে বললেন, তাের এমন অদ্ভুত আচার আচরণ। দেখে শ্বশুরবাড়ির লােকজন কিছু বলে না ?
এখনাে বলে নি। নতুন বউতাে, চক্ষুলজ্জায় কিছু বলতে পারছে না। লজ্জাটা কেটে গেলে বলবে।
এরা বােধহয় তাের ব্যাপার স্যাপার টের পায় নি। তুইতাে থাকিস এখানে। শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে তাের বােধহয় দেখাই হয় না?
সপ্তাহে একদিন যাই। আজ যাবি?
এক কাজ কর আজ যা ।। আজ যেতে বলছ কেন ?
ওদের একটা সারপ্রাইজ দে। আমি বিরাট এক মাছ কিনে এনে দেব। মাছ নিয়ে যা। তাের শ্বশুর শাশুড়ি খুশি হবে। আমি নিউমার্কেটে লােক পাঠাচ্ছি। বাজারের সবচে‘ বড় মাছটা কিনে আনবে। বাংলাদেশে এমন কোনাে মানুষ নেই
যে বড় মাছ দেখে খুশি হয় না।
তাদের খুশি করার আমার দরকার কী ?
মানুষকে খুশি করার মধ্যে আনন্দ আছে। সেই মানুষ যদি শ্বশুর শাশুড়ি হয় তাহলেতাে কথাই নেই। মাছ কিনতে পাঠাব?
সেকেন্ড থট দিবি?
সেকেন্ড শুধু না আমি ফোর্থ থট পর্যন্ত দিয়ে ফেলেছি। মাছ নিয়ে আমি শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি এটা ভাবতেই ঘেন্না লাগছে। চারদিকে মাছ মাছ গন্ধ পাচ্ছি। এই যে চা খাচ্ছি চায়ের মধ্যেও মাছের আঁশটে গন্ধ।
নবনীর চা শেষ হয়ে গেছে। কথা বলতে বলতে চা খাওয়া হয়ে গেছে বলে চা খাওয়ার মজাটা ঠিক পাওয়া যায় নি। আরেক কাপ খেতে পারলে ভালাে হতাে। তার জন্যে যন্ত্রণা করতে হবে। দোতলা থেকে একতলায় নামতে হবে। তাদের বাড়ির রান্নাঘর, খাবার ঘর, বসার ঘর, লাইব্রেরি সবই এক তলায়। দুতলাটা স্লীপিং কোয়ার্টার। দু‘টা প্রকাণ্ড শােবার ঘর ।
একটা তার, অন্যটা তার বাবার। মাঝখানে ছােটখাট খেলার মাঠের মতাে ফ্যামিলি লাউঞ্জ আছে। সেখানে টিভি, মিউজিক সেন্টার। ফ্যামিলি লাউঞ্জে মােটা গদির ডিভান আছে। শুয়ে শুয়ে ছবি দেখা হলাে নবনীর ছােটবেলাকার অভ্যাস। মানুষের কিছু ছােটবেলাকার অভ্যাস বড়বেলাতেও থেকে যায়। নবনীর এই অভ্যাসটি রয়ে গেছে।
দ্বিতীয় কাপ চায়ের জন্যে নবনীকে এক তলায় রান্নাঘরে যেতে হবে। যতক্ষণ ফরহাদ সাহেব আছেন ততক্ষণ কাজের লােকদের কেউই দোতলায় আসবে না। তাদের সে রকম নির্দেশ দেয়া আছে। নবনীর এক তলায় নামতে ইচ্ছা করছে না। ফরহাদ সাহেব বললেন, মুখ শুকনা করে বসে আছিস কেন?
নবনী জবাব দিল না। ফরহাদ সাহেব পত্রিকা ভাজ করতে করতে বললেন— আজ ইউনিভার্সিটি নেই ?
দু’টার সময় একটা ক্লাস আছে। যাবি না ? এখনাে বুঝতে পারছি না। কখন বুঝতে পারবি ? ক্লাস শুরু হবার আধঘন্টা আগে বুঝতে পারব।