কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ শব্দ করে হেসে ফেললেন।
নবনী বলল, হাসছ কেন?
তাের অভিনয় দেখে হাসছি ? নবনী বিস্মিত হয়ে বলল, অভিনয় কী করলাম ?
ইনডিসিশনের একটা সুন্দর অভিনয় তুই সব সময় করিস। প্রায়ই দেখি তাের মধ্যে একটা দিশাহারা ভাব— কাজটা করব কি করব না।
আমি একশ ভাগ নিশ্চিত ভাবটা লােক দেখানাে। কেন এরকম করিস?
নবনী জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ফরহাদ সাহেব বললেন, কোথায় যাচ্ছিস ?
চা আনতে যাচ্ছি। তুমি দোতলায় আছ— এখন হাজার ডাকাডাকি করেও কাউকে আনা যাবে না। বাবা, তােমাকে কি এক কাপ চা দিতে বলব ? খাবে ?
তাের দুঃস্বপ্ন দেখা কেমন এগুচ্ছে ? ভালােই এগুচ্ছে। কাল রাতেও দেখেছিস ?
খাতায় সব লিখছিস ? ই লিখছি। সাইকিয়াট্রিস্টকে খাতাটা দেখতে দিয়েছিস ?
দিসতাে আমাকে খাতাটা। পড়ে দেখব ঘটনা কী।
ফরহাদ সাহেব হঠাৎ সামান্য গম্ভীর হয়ে গেলেন। তবে মুখের হাসি আগের মতােই রইল। চোখ গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করি— সরাসরি জবাব দিবি। নকল কনফিউশান না। স্ট্রেইট আনসার— ইয়েস নাে টাইপ। প্রশ্নটা হলাে— আনিস ছেলেটাকে কি তাের পছন্দ হয়েছে ?
নবনী সঙ্গে সঙ্গে বলল, না। পছন্দ হয় নি কেন? কারণগুলো নিয়ে চিন্তা করি নি। পছন্দ হয় নি এইটুক জানি। সে কি তােকে পছন্দ করেছে ? হ্যা করেছে। আমার যত সমস্যাই থাকুক আমি পছন্দ করার মতাে মেয়ে।
আনিসের সঙ্গে তাের কি এখন যােগাযোেগ নেই ? আছে। সে সপ্তাহে দু’টো করে চিঠি পাঠায়। তুই চিঠি লিখিস না ? আমিও লিখি। তুই কটা চিঠি লিখিস? আমিও সপ্তাহে দু’টো। আর কিছু জিজ্ঞেস করবে ?
আমি কি এখন চায়ের সন্ধানে এক তলায় যেতে পারি ?
ফরহাদ সাহেব জবাব দিলেন না। মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাকে খুবই চিন্তিত মনে হলাে। আজ তিনি অফিসে যান নি মেয়েকে এই কথাগুলাে জিজ্ঞেস করার জন্যে। কথা জিজ্ঞেস করা হয়েছে–– এখন তিনি যেতে পারেন। দুপুর একটায় জাপানি ডিজাইনার মি. ওসাকু সানের সঙ্গে তাঁর লাঞ্চের ব্যবস্থা আছে।
ওসাকু সান চিনামাটির বাসনকোসনের ডিজাইন দেখাবেন। এই জাপানি শিল্পী না–কি বাংলাদেশী মটিফ নিয়ে কাজ করেছেন। ফরহাদ সাহেবের দুপুরের লাঞ্চে যেতে ইচ্ছা করছে না। তিনি নিজের ওপর সামান্য বিরক্ত বােধ করছেন। তার মেয়ের বয়স বাইশ। সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে পারে। তার বয়স সাতান্ন । তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে পারেন না।
নবনী নিজেই চা বানাল। নিজের হাতে বানানাে চা তার নিজের কখনাে পছন্দ হয় না। আজ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মন ভালাে হয়ে গেল। চমৎকার চা হয়েছে। লিকার ঘন হয় নি আবার পাতলাও হয় নি। চিনি যতটুকু দেয়া হয়েছে তারচে একদানা বেশি হলে চা মিষ্টি হয়ে যেত। একদানা কম হলেও মিষ্টি কম লাগত। চা হলাে এমন এক পানীয় যার সব অনুপাত নির্দিষ্ট এবং
একেক জনের জন্যে একেক রকম।
নবনীর মন এখন ভালাে। মন ভালাে থাকা অবস্থায় ছােটখাট কিছু অপ্রিয় কাজ করে ফেলা যায়। তেমন খারাপ লাগে না। নবনী ঠিক করে ফেলল কলাবাগানে তার শ্বশুরবাড়িতে যাবে। মাছ সঙ্গে নিয়েই যাবে। দুপুরে ঐ বাড়িতেই খাবে। বাবাকে বলে মাছ কিনতে হবে। কাউকে ফার্মেসিতে পাঠিয়ে এক পাতা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট আনাতে হবে। শ্বশুর সাহেবের সঙ্গে কথা বলার সময় অবশ্যই তার মাথা ধরবে। হাতের কাছে মাথা ধরার ট্যাবলেট থাকা দরকার। আজ একটা ছােটখাট এক্সপেরিমেন্টও করা যেতে পারে মাথা ধরার
ট্যাবলেট আগেভাগে খেয়ে রাখা। মাথা ধরার সুযােগই হবে না। শরীরে আগে থেকেই ওষুধ বসে আছে।
দরজা খুললেন নবনীর শ্বশুর সালেহ সাহেব। নবনীর মনে হলাে তিনি খুবই চিন্তিত, বিরক্ত এবং উদ্বিগ্ন। মানুষটা ছােটখাট, দুশ্চিন্তায় এবং উদ্বেগে আরাে ছােট হয়ে গেছেন। এই ভদ্রলােককে নবনীর কাছে কার্টুন চ্যানেলে দেখায় এমন কোনাে কার্টুন ক্যারেক্টারের মতাে মনে হয়। কোন ক্যারেক্টার এটা মনে পড়ছে
সালেহ সাহেব নবনীকে দেখে গলা নামিয়ে বললেন, বৌমা তুমি স্ট্রেইট আমার ঘরে চলে যাও | তােমার শাশুড়ির সঙ্গে কোনাে কথা বলবে না। আগে আমার কথা শুনবে— তারপর তুমি যদি তার কথা শুনতে চাও শুনবে। তুমি এসে ভালাে করেছ। আমি তােমাকে টেলিফোন করে আবার ব্যবস্থা করছিলাম। নাম্বার ভুলে গেছি বলে টেলিফোন করতে পারছিলাম না। নাম্বার তােমার শাশুড়ির কাছে। তার কাছেতাে আর নাম্বার চাইতে পারি না।
নবনী চিন্তিত গলায় বলল, নাম্বার চাইতে পারেন না কেন ?
অবস্থা সে রকম না। আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ। তুমি নতুন বউ। তােমার চোখে যেন কিছু না পড়ে এই জন্যে ঢাকা দিয়ে রাখি। ঢাকাঢ়াকি আর সম্ভব না। এনাফ ইজ এনাফ।
নবনী বলল, আপনাদের জন্যে একটা মাছ এনেছিলাম। গাড়িতে আছে । রাখ তােমার মাছ। আস, আমার ঘরে আস। সালেহ সাহেব উত্তেজনায় কাঁপছেন। কথাও ঠিকমতাে বলতে পারছেন —শব্দ জড়িয়ে যাচ্ছে। চোখ লাল মনে হচ্ছে গত রাতে ঘুমান নি।
সালেহ সাহেব নবনীর হাত ধরে প্রায় টানতে টানতে তার নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। ছােট্ট ঘর। লেখার টেবিল আর বুক শেলফ ভর্তি ম্যাগাজিন ছাড়া আর কিছু নেই। রিটায়ার করার পর থেকে প্রতি দুপুরে এই ঘরের মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে তিনি ঘুমান। স্ত্রীর সঙ্গে মন কষাকষি হলে রাতেও তাকে এই ঘরে থাকতে হয়।
ঘরে একটা মাত্র চেয়ার। সেই চেয়ারে নবনীকে তিনি বসালেন। হাত নাড়তে নাড়তে হড়বড় করে কথা বলতে লাগলেন।
মা, খুব মন দিয়ে ঘটনাটা শােন। ঘটনার সূত্রপাত দুই দিন আগে। হঠাৎ আমি লক্ষ করলাম তােমার শাশুড়ি তার মুখের ওপর সব সময় একটা বই
আছে বইটার নাম হলাে ‘সাত কাহন‘। সমরেশ মজুমদারের লেখা। মা তুমি বইটা পড়েছ ?
জ্বি না।
আমিও পড়ি নাই। তােমার শাশুড়ি যা করে তার মধ্যে বাড়াবাড়ি থাকে। এই যে পড়ছে এর মধ্যেও বাড়াবাড়ি আছে। সবসময় মুখের সামনে বই ধরে রাখা চাই। রাতে ঘুমাতে যাচ্ছি সে বাতি জ্বালিয়ে বই পড়ছে। বাতি জ্বালানাে থাকলে আমার ঘুম হয় না। এটা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। বই নিয়ে ঢং করতে পারলেই হলাে। সকালে নাশতা খাচ্ছি সেখানেও মুখের সামনে বই।