তেঁতুল বনে জোছনা-পর্ব-(৯) হুমায়ূন আহমেদ

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ শব্দ করে হেসে ফেললেন। 

নবনী বলল, হাসছ কেন

তাের অভিনয় দেখে হাসছি ? নবনী বিস্মিত হয়ে বলল, অভিনয় কী করলাম

ইনডিসিশনের একটা সুন্দর অভিনয় তুই সব সময় করিসপ্রায়ই দেখি তাের মধ্যে একটা দিশাহারা ভাবকাজটা করব কি করব নাতেঁতুল বনে জোছনা

আমি একশ ভাগ নিশ্চিত ভাবটা লােক দেখানােকেন এরকম করিস

নবনী জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়ালফরহাদ সাহেব বললেন, কোথায় যাচ্ছিস

চা আনতে যাচ্ছিতুমি দোতলায় আছএখন হাজার ডাকাডাকি করেও কাউকে আনা যাবে নাবাবা, তােমাকে কি এক কাপ চা দিতে বলব ? খাবে

 তাের দুঃস্বপ্ন দেখা কেমন এগুচ্ছে ? ভালােই এগুচ্ছেকাল রাতেও দেখেছিস

খাতায় সব লিখছিস ? লিখছিসাইকিয়াট্রিস্টকে খাতাটা দেখতে দিয়েছিস

দিসতাে আমাকে খাতাটা। পড়ে দেখব ঘটনা কী। 

ফরহাদ সাহেব হঠাৎ সামান্য গম্ভীর হয়ে গেলেনতবে মুখের হাসি আগের মতােই রইলচোখ গম্ভীর হয়ে গেলতিনি ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করিসরাসরি জবাব দিবিনকল কনফিউশান নাস্ট্রেইট আনসারইয়েস নাে টাইপ। প্রশ্নটা হলােআনিস ছেলেটাকে কি তাের পছন্দ হয়েছে

নবনী সঙ্গে সঙ্গে বলল, নাপছন্দ হয় নি কেন? কারণগুলো নিয়ে চিন্তা করি নিপছন্দ হয় নি এইটুক জানিসে কি তােকে পছন্দ করেছে ? হ্যা করেছেআমার যত সমস্যাই থাকুক আমি পছন্দ করার মতাে মেয়ে। 

আনিসের সঙ্গে তাের কি এখন যােগাযোেগ নেই ? আছেসে সপ্তাহে দু’টো করে চিঠি পাঠায়তুই চিঠি লিখিস না ? আমিও লিখিতুই কটা চিঠি লিখিস? আমিও সপ্তাহে দুটোআর কিছু জিজ্ঞেস করবে

আমি কি এখন চায়ের সন্ধানে এক তলায় যেতে পারি

ফরহাদ সাহেব জবাব দিলেন নামেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেনতাকে খুবই চিন্তিত মনে হলােআজ তিনি অফিসে যান নি মেয়েকে এই কথাগুলাে জিজ্ঞেস করার জন্যে। কথা জিজ্ঞেস করা হয়েছেএখন তিনি যেতে পারেনদুপুর একটায় জাপানি ডিজাইনার মি. ওসাকু সানের সঙ্গে তাঁর লাঞ্চের ব্যবস্থা আছে

ওসাকু সান চিনামাটির বাসনকোসনের ডিজাইন দেখাবেনএই জাপানি শিল্পী নাকি বাংলাদেশী মটিফ নিয়ে কাজ করেছেনফরহাদ সাহেবের দুপুরের লাঞ্চে যেতে ইচ্ছা করছে নাতিনি নিজের ওপর সামান্য বিরক্ত বােধ করছেনতার মেয়ের বয়স বাইশসে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে পারেতার বয়স সাতান্ন তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে পারেন না। 

নবনী নিজেই চা বানাল। নিজের হাতে বানানাে চা তার নিজের কখনাে পছন্দ হয় না। আজ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মন ভালাে হয়ে গেলচমৎকার চা হয়েছেলিকার ঘন হয় নি আবার পাতলাও হয় নি। চিনি যতটুকু দেয়া হয়েছে তারচে একদানা বেশি হলে চা মিষ্টি হয়ে যেতএকদানা কম হলেও মিষ্টি কম লাগতচা হলাে এমন এক পানীয় যার সব অনুপাত নির্দিষ্ট এবং 

একেক জনের জন্যে একেক রকম। 

নবনীর মন এখন ভালােমন ভালাে থাকা অবস্থায় ছােটখাট কিছু অপ্রিয় কাজ করে ফেলা যায়তেমন খারাপ লাগে না। নবনী ঠিক করে ফেলল কলাবাগানে তার শ্বশুরবাড়িতে যাবে। মাছ সঙ্গে নিয়েই যাবে। দুপুরে বাড়িতেই খাবে। বাবাকে বলে মাছ কিনতে হবেকাউকে ফার্মেসিতে পাঠিয়ে এক পাতা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট আনাতে হবেশ্বশুর সাহেবের সঙ্গে কথা বলার সময় অবশ্যই তার মাথা ধরবেহাতের কাছে মাথা ধরার ট্যাবলেট থাকা দরকার। আজ একটা ছােটখাট এক্সপেরিমেন্টও করা যেতে পারে মাথা ধরার 

ট্যাবলেট আগেভাগে খেয়ে রাখামাথা ধরার সুযােগই হবে নাশরীরে আগে থেকেই ওষুধ বসে আছে। 

দরজা খুললেন নবনীর শ্বশুর সালেহ সাহেবনবনীর মনে হলাে তিনি খুবই চিন্তিত, বিরক্ত এবং উদ্বিগ্নমানুষটা ছােটখাট, দুশ্চিন্তায় এবং উদ্বেগে আরাে ছােট হয়ে গেছেনএই ভদ্রলােককে নবনীর কাছে কার্টুন চ্যানেলে দেখায় এমন কোনাে কার্টুন ক্যারেক্টারের মতাে মনে হয়কোন ক্যারেক্টার এটা মনে পড়ছে 

 সালেহ সাহেব নবনীকে দেখে গলা নামিয়ে বললেন, বৌমা তুমি স্ট্রেইট আমার ঘরে চলে যাও | তােমার শাশুড়ির সঙ্গে কোনাে কথা বলবে নাআগে আমার কথা শুনবেতারপর তুমি যদি তার কথা শুনতে চাও শুনবেতুমি এসে ভালাে করেছআমি তােমাকে টেলিফোন করে আবার ব্যবস্থা করছিলামনাম্বার ভুলে গেছি বলে টেলিফোন করতে পারছিলাম নানাম্বার তােমার শাশুড়ির কাছেতার কাছেতাে আর নাম্বার চাইতে পারি না। 

নবনী চিন্তিত গলায় বলল, নাম্বার চাইতে পারেন না কেন

অবস্থা সে রকম নাআমাদের অবস্থা খুবই খারাপতুমি নতুন বউতােমার চোখে যেন কিছু না পড়ে এই জন্যে ঢাকা দিয়ে রাখিঢাকাঢ়াকি আর সম্ভব নাএনাফ ইজ এনাফ। 

নবনী বলল, আপনাদের জন্যে একটা মাছ এনেছিলাম। গাড়িতে আছে । রাখ তােমার মাছআস, আমার ঘরে আসসালেহ সাহেব উত্তেজনায় কাঁপছেনকথাও ঠিকমতাে বলতে পারছেন শব্দ জড়িয়ে যাচ্ছেচোখ লাল মনে হচ্ছে গত রাতে ঘুমান নি। 

সালেহ সাহেব নবনীর হাত ধরে প্রায় টানতে টানতে তার নিজের ঘরে নিয়ে গেলেনছােট্ট ঘরলেখার টেবিল আর বুক শেলফ ভর্তি ম্যাগাজিন ছাড়া আর কিছু নেইরিটায়ার করার পর থেকে প্রতি দুপুরে এই ঘরের মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে তিনি ঘুমানস্ত্রীর সঙ্গে মন কষাকষি হলে রাতেও তাকে এই ঘরে থাকতে হয়। 

ঘরে একটা মাত্র চেয়ারসেই চেয়ারে নবনীকে তিনি বসালেনহাত নাড়তে নাড়তে হড়বড় করে কথা বলতে লাগলেন। 

মা, খুব মন দিয়ে ঘটনাটা শােনঘটনার সূত্রপাত দুই দিন আগেহঠাৎ আমি লক্ষ করলাম তােমার শাশুড়ি তার মুখের ওপর সব সময় একটা বই 

 আছে বইটার নাম হলাে সাত কাহনসমরেশ মজুমদারের লেখামা তুমি বইটা পড়েছ

জ্বি না। 

আমিও পড়ি নাইতােমার শাশুড়ি যা করে তার মধ্যে বাড়াবাড়ি থাকেএই যে পড়ছে এর মধ্যেও বাড়াবাড়ি আছেসবসময় মুখের সামনে বই ধরে রাখা চাইরাতে ঘুমাতে যাচ্ছি সে বাতি জ্বালিয়ে বই পড়ছেবাতি জ্বালানাে থাকলে আমার ঘুম হয় নাএটা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেইবই নিয়ে ঢং করতে পারলেই হলােসকালে নাশতা খাচ্ছি সেখানেও মুখের সামনে বই

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *